ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মহাসঙ্কটে পেঁয়াজ বাজার

প্রকাশিত: ১১:৫৭, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

মহাসঙ্কটে পেঁয়াজ বাজার

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মধ্যে মহাসঙ্কটে রয়েছে পেঁয়াজ বাজার। চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্য কোথাও পেঁয়াজ আমদানি না থাকায় দেশের সকল স্থান থেকে পেঁয়াজের পাইকাররা এখন চট্টগ্রামমুখী। অপরদিকে পেঁয়াজের একক বৃহত্তম বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মার্কেটে সরবরাহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় বাজার পরিস্থিতি এখন মহাসঙ্কটে রয়েছে। মিয়ানমারসহ মিসর এবং চীন থেকে পেঁয়াজের বড় কোন চালান এখনও আসেনি। গত ১২ নবেম্বরের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে গ্রুপের বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দেশের কয়েকটি বড় শিল্প গ্রুপ পেঁয়াজ আমদানির যে ঘোষণা ছিল তা এখনও বাস্তবে পরিণত হয়নি। ভারত সরকার পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার পর দেশের পেঁয়াজের বাজারে মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। উল্লেখ্য, গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ভারত সরকার পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করে। বন্ধ ঘোষণার পর বাংলাদেশী আমদানিকারকদের যে সমস্ত পেঁয়াজের চালানের এলসি হয়েছিল শুধুমাত্র সেগুলো পরবর্তীতে স্থল বন্দর দিয়ে দেশে পৌঁছেছে। ভারতীয় পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ হওয়ার পর প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বহুগুণ বেড়ে গেছে বলে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। প্রতিদিন টেকনাফ থেকে ট্রাকে ট্রাকে পেঁয়াজের চালান চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু এই পেঁয়াজ চাহিদার তুলনায় কম হওয়ার কারণে দাম বেড়েই চলেছে বলে খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ আমদানি ও আড়তদার সমিতির নেতা মোঃ ইদ্রিস বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জনকণ্ঠকে জানায়। এদিকে, বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের চালানের সঙ্গে চীন এবং মিশর থেকে ছোট আকারে পেঁয়াজের চালান আসছে এবং খালাসও হচ্ছে। এ সমস্ত পেঁয়াজ বন্দর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছে। বর্তমানে সারাদেশে পেঁয়াজের চালান যাচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে। মিয়ানমারের পেঁয়াজ টেকনাফ স্থল বন্দর হয়ে আমদানির পর যেমন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে ঢুকছে তেমনি টেকনাফ থেকে সরাসরি দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। অনুরূপভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে চীন এবং মিশর থেকে আমদানির পেঁয়াজও বর্তমানে সরাসরি দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকযোগে চলে যাচ্ছে। এদিকে, বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ দিনে দেখা যায়, খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বহুলাংশে কমে গেছে। সকালে পাইকারি বাজারে মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হয় কেজি প্রতি ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। আর মিশর ও চীনের পেঁয়াজ বিক্রি হয় কেজি প্রতি ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। বিকেলে দেখা যায়, এ সমস্ত পেঁয়াজ কেজি প্রতি পাইকারি আড়তেই আরও ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে গেছে। আড়তে পেঁয়াজের কেজি প্রতি পাইকারি মূল্য ১৫০ টাকায় পৌঁছে যায়। এ পেঁয়াজ আড়ত থেকে খুচরা বাজারে যাওয়ার পর তা ২০০ টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। পেঁয়াজ নিয়ে অতীতে এ ধরনের সঙ্কট পরিস্থিতি দেখা যায়নি বলে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হচ্ছে। এছাড়া পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়েছিল তাতে কোন সুফল মেলেনি। ১০০ টাকার নিচে পেঁয়াজের মূল্য রাখার যে কথা বলা হয়েছিল সেটা ধোপে টেকেনি। পেঁয়াজের সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান, জরিমানা করার যে তৎপরতা দেখা গেছে তারপরও কোন সুফল আসেনি। ব্যবসায়ীরা আগেই জানিয়ে দিয়েছে বাজার চলবে বাজারের গতিতে। এক্ষেত্রে পচনশীল এই পেঁয়াজ নিয়ে কোন ধরনের ছলচাতুরি করার সুযোগ নেই। বাজারে পেঁয়াজের আমদানি যখন কমে গেছে তখন স্বাভাবিকভাবে চাহিদা মেটাতে অক্ষমতার কারণে মূল্য বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে দেশের বড় কয়েকটি শিল্প গ্রুপ পেঁয়াজ আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার যে কথা চাউর হয়েছিল তাতে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার আগাম আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিতে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশের কোন শিল্প গ্রুপের পেঁয়াজের আমদানির চালান চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেনি। চট্টগ্রামের একটি শিল্প গ্রুপ গণমাধ্যমকে পেঁয়াজ আমদানির কথা জানিয়েছিল। অপরদিকে, ঢাকার আরও তিনটি শিল্প গ্রুপ অনুরূপভাবে পেঁয়াজ আমদানি করছে বলে জানানো হলেও কোন গ্রুপের আমদানির পেঁয়াজ কখন আসছে তার সঠিক কোন তথ্য মিলছে না। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে, আমদানির কথা বললেও বাস্তবে এসব শিল্প গ্রুপ পেঁয়াজ আমদানি আদৌ করছে কিনা। প্রসঙ্গত, গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়ার আগে থেকে বাজার মূল্য উর্ধ্বমুখী হয়। কারণ হিসেবে জানা যায়, ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ফলন ভাল না হওয়ায় সংকট সৃষ্টি হয়। ফলে সেদেশের পেঁয়াজের বাজার উর্ধ্বমুখী হয়। ভারতের পেঁয়াজের বাজার উর্ধ্বমুখী হওয়ার জের হিসেবে তা বাংলাদেশের বাজারে আঘাত হানে। এরপর থেকে তা আর কমার লক্ষণ দেখা যায়নি। আরও পরে আসে ভারত সরকারের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষনা। এ ঘোষণার পর লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যায় পেঁয়াজের মূল্য। এমন পরিস্থিতিতে আমদানিকারকরা স্বাভাবিক তুলনার চেয়ে বহুগুণ বেশিতে মিয়ানমারমুখী হয়। টেকনাফ স্থল বন্দরে প্রতিদিন এখনও চালানে চালানে আসছে পেঁয়াজ। কিন্তু দাম কমার কোন লক্ষণ নেই। কারণ হিসেবে আড়তদারদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভারতীয় পেঁয়াজ এককভাবে বাংলাদেশের বাজারে আসত এবং মূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করত। কিন্তু ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সে স্থান পূরণ করতে পারছে না মিয়ানমার, মিশর বা চীনের পেঁয়াজ। কিছু আমদানিকারক তুরস্কের পেঁয়াজ আমদানির সঙ্গেও জড়িত। মিশর, চীন এবং তুরস্কের পেঁয়াজের গুণগত দিক বাংলাদেশী এবং মিয়ানমারের পেঁয়াজের তুলনায় কম। পাশাপাশি ভারতীয় পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও কম থাকায় এসব দেশের পেঁয়াজের চাহিদা সাধারণ গ্রাহকদের কাছে একেবারেই কম। এক্ষেত্রে পেঁয়াজ সংকটের কারণে সাধারণ মানুষ মিশর, চীন এবং তুরস্কের পেঁয়াজ ক্রয় করতে বাধ্য হয়ে থাকে। ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানানো হয়েছে, দেশীয় পেঁয়াজ বাজারে না উঠা পর্যন্ত এবং ভারতীয় পেঁয়াজ রফতানি যতদিন বন্ধ থাকবে, ততদিন দেশের পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল থাকার আশঙ্কাই বেশি। এক্ষেত্রে মিশর, তুরস্ক এবং চীন থেকে ব্যাপকহারে পেঁয়াজ আমদানি হয়ে আসলে বাজার মূল্যে মহাসংকট হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
×