ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চাহার যা স্বপ্নেও ভাবেননি

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ১৩ নভেম্বর ২০১৯

চাহার যা স্বপ্নেও ভাবেননি

আমি স্বপ্নেও ভাবিনি, এমন পারফর্মেন্স করব। আমার একটাই মন্ত্র, ছোটবেলা থেকেই কঠিন পরিশ্রম করে যাওয়া। বাকিটা সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ।Ñ দীপক চাহারের এমনটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ভারতের হয়ে মাত্র সপ্তম টি২০ খেলতে নেমেই কি না বিশ্ব রেকর্ড। অজন্তা মেন্ডিস-যুবেন্দ্র চাহালদের ছাড়িয়ে যাওয়া। নাগপুরে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে চাহারের বোলিং বিশ্লেষণ ৩.২-০-৭-৬; প্রথম ভারতীয় হিসেবে ছেলেদের টি২০তে হ্যাটট্রিকসহ গড়েছেন সেরা বোলিংয়ের নতুন বিশ্ব রেকর্ড। আগে যেটি ছিল অজন্তা মেন্ডিসের। ২০১২ সালে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে লঙ্কান স্পিনারের বোলিং ফিগার ছিল ৪-২-৮-৬। অন্ধ্র প্রদেশ থেকে উঠে আসা ২৭ বছর বয়সী ডানহাতি পেসার জানিয়েছেন, বিশ্ব রেকর্ড গড়বেন, স্বপ্নেও ভাবেননি। সেই চাহার। এক সময় যাকে ‘বাতিল’ বলে ছুড়ে ফেলেছিলেন তার কোচ কোচ গ্রেগ চ্যাপেল। কিন্তু ওই যে রতনে রতন চেনেন। চ্যাপেল যাকে বাতিল করে দিয়েছিলেন তাকেই আইপিএলে খেলিয়েছেন চেন্নাই সুপার কিংস অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। আজ তিনি ইতিহাস। সিরিজে ভারপ্রাক্ত অধিনায়ক রোহিত শর্মার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে দীপক চাহার আরও বলেন, ‘রোহিত ভাই আমায় গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বল দেবে বলে দিয়েছিল। দল ম্যানেজমেন্টেরও সেটাই ভাবনা ছিল। আমি নিজেকে সেভাবে তৈরি রেখেছিলাম। ভাল লাগছে, দলের কাজে লাগতে পেরে।’ ছেলেদের মধ্যে প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে টি২০ হ্যাটট্রিক করেছেন চাহার, গড়েছেন ইনিংসে সেরা বোলিংয়ের বিশ্বরেকর্ড। তারপরেও কেন এত কম উচ্ছ্বাস? হেসে চাহারের উত্তর, ‘আসলে ওভার শেষের জন্য অপেক্ষা করি। প্রত্যেক বলের পরেই ভাবি, এর পরের বলটায় কিন্তু ব্যাটসম্যান আমাকে ছক্কা মেরে দিতে পারে। তাই সংযত থাকি।’ এই ছেলে আসলেই বহুদূর যাবে। ২০০৮ সালে এই দীপক চাহারকেই বাতিল করে দিয়েছিলেন তখনকার কোচ গ্রেগ চ্যাপেল। মাত্র ১৮ বছরে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেকেই হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে ১০ রানে ৮ উইকেট নিয়ে চমকে দিয়েছিলেন তিনি। রাজস্থানের পরপর দু’বার রঞ্জি জয়েও বড় ভূমিকা ছিল চাহারের। ধারাবাহিক ভাল খেলার রহস্য জানিয়ে কঠোর পরিশ্রমকেই বার বার সামনে এনেছেন। টি২০তে ভারতের সেরা বোলার কে? পরিসংখ্যান বলে রবিচন্দ্রন আশ্বিন। ৪৬ আন্তর্জাতিক ম্যাচে তার উইকেট ৫২টি। ৪২ ম্যাচে ৫১ শিকারে দ্বিতীয় স্থানে সেনসেশনাল পেসার জাসপ্রিত বুমরাহ। ৩৪ ম্যাচে ৫০ উইকেট যুবেন্দ্র চাহালের। সেখানে ক্যারিয়ারের মাত্র সপ্তম টি২০ খেলতে নেমে ভারত তো বটেই ছোট্ট ফরমেটের ইতিহাসটাই বদলে দিলেন দীপক চাহার। ঘটনা নাগপুরে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় ও শেষ ম্যাচের। ভারতের ১৭৪/৫Ñএর জবাবে বিধ্বস্ত মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের দল অলআউট ১৪৪ রানে। ম্যাচের নায়ক চাহারের বোলিং বিশ্লেষণ ৩.২-০-৭-৬; প্রথম ভারতীয় হিসেবে ছেলেদের টি২০তে হ্যাটট্রিকসহ গড়েছেন সেরা বোলিংয়ের নতুন বিশ্ব রেকর্ড। আগে যেটি ছিল অজন্তা মেন্ডিসের। ২০১২ সালে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে লঙ্কান স্পিনারের বোলিং ফিগার ছিল ৪-২-৮-৬। অন্ধ্র প্রদেশ থেকে উঠে আসা ২৭ বছর বয়সী ডানহাতি পেসার জানিয়েছেন, বিশ্ব রেকর্ড গড়বেন, স্বপ্নেও ভাবেননি। নিজের তৃতীয় ওভারের শেষ বলে এবং চতুর্থ ওভারের প্রথম দুই বলে যথাক্রমে শফিউল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান ও আমিনুল ইসলামকে আউট করে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন দীপক চাহার। ৪ বল বাকি থাকতে বাংলাদেশকে গুটিয়ে দিয়ে দলকে ম্যাচের পাশাপাশি সিরিজ জয়ের আনন্দে ভাসান ভারতের নবীন এই ডানহাতি মিডিয়াম পেসার। তার আগে তুলে নেন লিটন দাস, সৌম্য সরকার ও মোহাম্মদ মিথুনকে। ৩ ওভার ২ বল করে কোনো মেডেন না পেলেও মাত্র ৭ রান দিয়ে ঝুলিতে ৬ উইকেট। চাহারের জন্য এ তো স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যাওয়া। ভারতের হয়ে এর আগে টি২০তে ইনিংসে ৬ উইকেট ছিল যুবেন্দ্র চাহালের। ২০১৭ সালে বেঙ্গালুরুতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার বোলিং ফিগার ছিল ৪-০-২৫-৬। তবে আন্তর্জাতিক টি২০তে সেরা দুটি বোলিং ছিল মেন্ডিসেরই। ২০১২ সালে হাম্বানটোটায় জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ৮ রান দিয়ে ৬ উইকেট নেয়া লঙ্কান রহস্য স্পিনার। ২০১১ সালে পাল্লেকেলেতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৬ রানের বিনিময়ে সমান ৬ উইকেট। নাগপুরে চাহার-কীর্তিতে এখন তালিকায় দুটি পজিশনেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে নেমে গেছেন তিনি। ভারতের হয়ে মেয়েদের টি২০তে চাহারের আগেই হ্যাটট্রিক করেছিলেন নারী দলের সদস্য একতা বিস্ত। পরশু দীপকের ওই কীর্তির পর ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) যখন ‘প্রথম ভারতীয় হিসেবে টি২০তে’ বলে টুইট করে, অনেকে সেটি দেখে হাসি-ঠাট্টাও করেন। তারা স্মরণ করিয়ে দেন ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি২০তে হ্যাটট্রিক করেছিলেন স্পিনার একতা। বিসিসিআই রি-টুইপে পরে ভুল সংশোধন করে নেয়। সে যাই হোক ২০০৭ থেকে সর্বোপরি টি২০ ইতিহাসে এটি ১২তম হ্যাটট্রিক। এর মধ্যে চলতি বছরই টি২০তে হ্যাটট্রিক হয়েছে ৪টি, গত বছর ২টি। অর্থাৎ ১২ হ্যাটট্রিকের ৬টিই এসেছে গত দুই বছরে। কেবল হ্যাটট্রিকই নয়, রেকর্ডে টানা চার বলে ৪ উইকেটের বীরল কীর্তি রয়েছে রশীদ খান ও লাসিথ মালিঙ্গার দখলে। ছেলেদের টি২০তে চাহার ভারতের ‘প্রথম’ হ্যাটট্রিকম্যান হলেও দেশটির হয়ে টেস্ট ও ওয়ানডেতে অনেকেরই এমন কৃতিত্ব রয়েছে। টেস্টে ভারতীয়দের মধ্য প্রথম হ্যাটট্রিক করেছিলেন হরভজন সিং। ২০০১ সালে ইডেনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই কীর্তি গড়েছিলেন সাবেক অফস্পিনার। কয়েক মাস আগে কিংস্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট হ্যাটট্রিক করেন বুমরাহ। ওয়ানডেতে ভারতের হয়ে হ্যাটট্রিক করেন চেতন শর্মা, কপিল দেব ও কুলদীপ যাদব। তিন ম্যাচের এই সিরিজে ১০.২ ওভার বল করে ৫৬ রানে ৮ উইকেট নিয়েছেন চাহার। গড় ৭। ভারতের হয়ে দ্বিতীয়সেরা। ২০০৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আশ্বিনের গড় ছিল ৩.৮৮। ক্যারিয়ারে এ পর্যন্ত মাত্র ৭টি টি২০ খেলে দু’বার ম্যাচসেরা হলেন চাহার। ভারতের হয়ে টি২০ ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ দু’বার করে ম্যাচসেরা অপর বোলার বুমরাহকে সেখানে খেলেতে হয়েছে ৪২টি ম্যাচ। ২০০৮ সালে রাজস্তান ক্রিকেট এ্যাসোসিয়েশন এ্যাকাডেমির ডিরেক্টর ছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল। তখন চাহারের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হওয়ার কোন রসদ খুঁজে পাননি গ্রেগ। সেটা মুখের উপর বলেও দিয়েছিলেন তিনি। এরপরই দু’বছর ধরে নিজেকে নিয়ে ঘষামাজা শুরু করেন। চলে ফিটনেস আর বলে গতি পাওয়ার সংগ্রাম। সমালোচনা, চোট আঘাতকে অতিক্রম করে রাজস্থানের হয়ে রঞ্জি খেলেছেন। রঞ্জিতে সাফল্য পাওয়ায়, গ্রেগের সমালোচনার জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ! অতীতের ইন্টারভিউয়ে এমনটা নিজেই জানিয়েছিলেন দীপক চাহার। প্রথম লাইমলাইটে এলেন কিভাবে? হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফির অভিষেকে ১০ রান খরচ করে ৮ উইকেট তুলে নিয়ে প্রথমবার সংবাদ শিরোনামে উঠে আসেন চাহার। টার্নিং পয়েন্ট: জহুরীর চোখ চিনে নিয়েছিল চাহারকে। চাহারের কেরিয়ারের সেরা টার্নিং পয়েন্ট চেন্নাই সুপার কিংসে খেলা। ধোনিই চেন্নাইয়ের হয়ে এখন ধারাবাহিকভাবে খেলেন চাহার। হলুদ আর্মির হয়ে ১৭ ম্যাচ খেলে ২২ উইকেট তুলে নিয়েছে। ধোনির পরামর্শেই টি২০ পেসার হিসেবে নিজেকে অন্য মাত্রায় তুলে এনেছেন চাহার। তিনি এখন হ্যাটট্রিকম্যান, রেকর্ডম্যান।
×