ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন আজ

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ১৩ নভেম্বর ২০১৯

নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন আজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের আশ্রয়ে সাহিত্যের আকাশে জ্বলে উঠেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়েছিল মধ্যবিত্ত জীবনের চালচিত্র আঁকা গ্রন্থটি। সহজ-সরল ভাষার সঙ্গে সংলাপধর্মী উপন্যাসটি সহজেই আকৃষ্ট করেছিল সাহিত্যানুরাগীদের মনন। পরের গল্প থেকে শুধুই এগিয়ে যাওয়ার। টানা চার দশক আপন সৃষ্টিশীলতায় মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন পাঠককে। সেই সূত্রে ধারণ করেছেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জননন্দিত কথাসাহিত্যিকের পরিচয়। কীর্তিমান এই মানুষটি একইসঙ্গে হেঁটেছেন সাহিত্য ও শিল্পের বর্ণময় পথে। সরলরেখার মতোই সহজ ছিল তাঁর লেখার ভাষা। গল্প ও উপন্যাসের উদ্দীপক কিংবা রহস্যময় বুনটে বিভোর করে রেখেছিলেন পাঠককে। দেশের সাহিত্যভুবনে ভারতীয় লেখকদের একচেটিয়া আধিপত্য ম্লান করে অনবদ্য আপন লেখনীর গড়ে দিয়েছেন সৃজনশীল প্রকাশনাশিল্পের ভিত্তিভূমি। গল্প-উপন্যাসের সমান্তরালে বিচিত্র বিষয়ের নাটক কিংবা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শিল্পরসিকদের দিয়েছেন বিশুদ্ধ বিনোদনের খোরাক। আজ ১৩ নবেম্বর বুধবার বাংলা সাহিত্যের এই জননন্দিত লেখক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকারের ৭২তম জন্মদিন ও ৭১তম জন্মবার্ষিকী। ’৪৮ সালের এ দিনে তিনি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। এই কথাশিল্পীর জন্মদিনে বিশেষ প্রবন্ধ, নিবন্ধসহ নানা প্রতিবেদন ছেপেছেন পত্রিকাওয়ালারা। টিভি চ্যানেলগুলোর পর্দায় দিনভর দেখা যাবে তাঁর নির্মিত নাটক, সিনেমাসহ নানা অনুষ্ঠান। বিকেলে ঢাবির টিএসসি মিলনায়তনে হুমায়ূন জন্মোৎসবের আয়োজন করেছে হিমু পরিবহন। এর বাইরে লেখকের জন্মদিনে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচী। মঙ্গলবার রাত বারোটার পর লেখকের ধানম-ির ‘দখিন হাওয়া’ ফ্ল্যাটে কাটা হয়েছে জন্মদিনের কেক। হুমায়ূনকে স্মরণ করে দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিতকে নিয়ে কেক কাটেন লেখকের সহধর্মিণী মেহের আফরোজ শাওন। আজ ভোরে শাওন তার দুই ছেলেকে নিয়ে চলে যান হুমায়ূনের স্মৃতিধন্য গাজীপুরের পিরুজালী গ্রামের নূহাশপল্লীতে। সেখানে লেখকের সমাধিতে নিবেদন করবেন শ্রদ্ধাঞ্জলি। মিলাদ মাহফিলের পাশাপাশি এতিমদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হবে। লেখকের জন্মদিনে প্রতিবছরই ছোট ভাই আহসান হাবীবসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা নূহাশপল্লীতে হুমায়ূনের সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আজ বুধবার বিকেলে সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে শুরু হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের একক বইমেলা। এ মেলার আয়োজক হুমায়ূনের বইয়ের প্রকাশকরা। হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে আজ চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে হবে ষষ্ঠ ‘হুমায়ূন মেলা’। বেলা এগারোটা ৫ মিনিটে এ মেলার উদ্বোধন করা হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন হুমায়ূন আহমেদ পরিবারের সদস্যসহ নাট্যব্যক্তিত্ব, কবি-সাহিত্যিক, চ্যানেল আইর পরিচালকবৃন্দ ও বিশিষ্ট সাংবাদিকবৃন্দ। মেলায় থাকবে হুমায়ূন আহমেদের বই, চলচ্চিত্র, নাটকে ধারণকৃত ডিভিডির স্টল। মেলায় পরিবেশিত হবে হুমায়ূন আহমেদের লেখা গান। স্মৃতিচারণ করবেন মেলায় আগত বিশিষ্টজনেরা। হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নবেম্বর নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন। এই লেখকের রতœগর্ভা জননীর নাম আয়েশা ফয়েজ। পাঠক বিবেচনায় হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। উপন্যাসে নিজের প্রতিভার বিস্তার ঘটলেও তাঁর শুরুটা ছিল কবিতা দিয়ে। এরপর নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর। হুমায়ূন আহমেদকে বাংলা সাহিত্যের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনকও বলা চলে। ’৭২ সালে প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের পরপরই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। উপন্যাসে ও নাটকে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো বিশেষ করে ‘হিমু’, ‘মিসির আলী’, ‘শুভ্র’ তরুণ-তরুণীদের কাছে হয়ে ওঠে অনুকরণীয়। বলা হয়, তাঁর লেখা পছন্দ করেন না এমন মানুষও তাঁর নতুন লেখাটি গোপনে পড়ে থাকেন। দেশে এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়, যারা তাঁর অন্তত একটি নাটক দেখেনি কিংবা তাঁর কোন বই পড়েনি। হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাসের সংখ্যা দুই শতাধিক। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খনীল কারাগার, মন্দ্রসপ্তক, দূরে কোথায়, সৌরভ, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, বাসর, গৌরীপুর জংশন, নৃপতি, অমানুষ, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচীনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, বৃষ্টি ও মেঘমালা, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, জোছনা ও জননীর গল্প, দেয়াল, বাদশাহ নামদার প্রভৃতি। বহু একক ও ধারাবাহিক নাটক রচনা ও পরিচালনা করেছেন। পরিচালনা করেছেন চলচ্চিত্রও। তাঁর সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র জন্য জয় করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। হুমায়ূন আহমেদের দীর্ঘ চার দশকের সাহিত্যজীবনে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে একুশে পদক (১৯৯৪), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮) ইত্যাদি। দেশের বাইরেও সম্মানিত হয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। জাপানের ‘এনএইচকে’ টিভি তাঁকে নিয়ে ‘হু ইস হু ইন এশিয়া’ শিরোনামে পনেরো মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করে। ’১২ সালে ১৯ জুলাই বর্ষার রাতে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ক্যান্সার আক্রান্ত হুমায়ূন আহমেদ চলে যান। আকাশচুম্বী জনপ্রিয় এ লেখকের মৃত্যুতে সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। নিউইয়র্ক থেকে ২৩ জুন দেশে ফিরিয়ে আনা হয় হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ। বিমানবন্দর থেকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে। সেখানে লাখো মানুষের অশ্রুসিক্ত শ্রদ্ধা ভালবাসায় সিক্ত হন তিনি। পরদিন লেখককে সমাহিত করা হয় তাঁর গড়ে তোলা নন্দনকানন নূহাশপল্লীর লিচুতলায়। সেখানেই চির ঘুমে শায়িত হয়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ।
×