ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঐতিহ্যবাহী রাসমেলা শুরু

মণিপুরী নৃত্যগীতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম, বর্ণিল উৎসব

প্রকাশিত: ১১:৩৩, ১৩ নভেম্বর ২০১৯

মণিপুরী নৃত্যগীতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম, বর্ণিল উৎসব

মোরসালিন মিজান ॥ রাজধানী শহরে উৎসব অনুষ্ঠানের শেষ নেই। কত শত আয়োজন! এসব আয়োজন ঢাকার বাইরের সংস্কৃতি চর্চাকে বরাবরই প্রভাবিত করে। তবে কিছু আচার অনুষ্ঠান ঢাকার বাইরে হলেও, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। একেবারেই আলাদা। স্থানীয়ভাবে লালন করা ঐতিহ্য এবং বর্ণিল আয়োজনের কারণে বিশেষ দৃষ্টি কাড়ে। ঢাকা থেকেও অনেকে সেসব উৎসব উপভোগ করতে যান। আশপাশের মানুষেরা যোগ দেন। তেমনই এক আয়োজনের নাম রাসমেলা বা রাস উৎসব। রাসলীলা নামেও পরিচিত। বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণের আধ্যাত্মিক রাসলীলার অনুকরণে রাসমেলার আয়োজন করা হয়। সময়টি কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথি। সে অনুযায়ী, এরই মাঝে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়ে গেছে উৎসব। দেশের একাধিক স্থান থেকে রাসমেলার খবর আসছে। লোকসংস্কৃতির গবেষক ড. শেখ গাউস মিয়ার মতে, ‘রস’ থেকে ‘রাস’। রস অর্থ সার, নির্যাস, আনন্দ, অমৃত। বৈষ্ণব দর্শনে রস বলতে মধুর রসকে বোঝায়। উপনিষদে ব্রহ্মাকে রসস্বরূপ বিবেচনা করা হয়। এই অদেখা অলৌকিক রস যখন মূর্তিরূপ পরিগ্রহ করে তখন তা হয় রাস। রস-আস্বাদনের লক্ষ্যে রাস উৎসব উদ্যাপিত হয়। যতদূর তথ্যÑ ১৯২৩ সালে হরিচাঁদ ঠাকুরের বনবাসী ভক্ত হরিভজন এ মেলা শুরু করেন। আবার অনেকের মতে, শত বছর আগে শ্রীকৃষ্ণ কার্তিকের পূর্ণিমা রাতে গঙ্গাস্নানের আদেশ পান। পাপমোচন ও পুণ্যলাভের আশায় এই স্নান শুরু হয়। তখন থেকেই রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আরও মত আছে। যেমনÑ কার্তিকের পূর্ণিমা রাতে শ্রীকৃষ্ণ বনবাসী গোপীদের সঙ্গে রাসলীলা করেছিলেন। সেই থেকে রাসমেলা। এখন তা সার্বজনীন উৎসবের রূপলাভ করেছে। এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সুন্দরবনের দুবলারচরের আয়োজন কিছুটা সংকুচিত করা হলেও অন্যান্য স্থানে আগের মতোই আচার অনুষ্ঠান পালন করা হচ্ছে। তবে আলাদা করে বলতে হয় মৌলভীবাজারের আয়োজনটির কথা। জেলার কমলগঞ্জের মাধবপুরে আয়োজিত এই রাসমেলা ঘিরে সবচেয়ে বেশি কৌতূহল। ইতিহাসটি ঘেটে দেখা যায়, বাংলাদেশে মণিপুরীদের স্থায়ী বসতি স্থাপনের পর ১৮৪২ খ্রীস্টাব্দ থেকে মাধবপুর জোড়াম-পে নিয়মিতভাবে এ উৎসব উদ্যাপিত হচ্ছে। মণিপুরী সমাজে রাস উৎসবের প্রবর্তন করেন মণিপুরের রাজা মহারাজ জয়সিংহ (রাজত্ব : ১৭৬৪-১৭৯৯ খ্রী.)। মেলার প্রধান আকর্ষণ শিশুদের রাখাল নৃত্য ও তরুণীদের রাসনৃত্য। ট্র্যাডিশনাল মণিপুরী পোশাক পরে তরুণীরা বিশেষ এই নৃত্য পরিবেশন করেন, যা দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। উৎসবে মণিপুরী সঙ্গীত ও নৃত্যনাট্যের মাধ্যমে কৃষ্ণ-অভিসার, রাধা-গোপী অভিসার, রাগ আলাপন ইত্যাদি তুলে ধরা হয়। মৌলভীবাজার থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা সৈয়দ হুমায়েদ শাহীন জানান, মঙ্গলবার রাতে শুরু হয়েছে এবারের উৎসব। মহারাসলীলার মূল পর্ব শুরু হবে বেলা ১১টা থেকে ‘গোষ্ঠলীলা বা রাখালনৃত্যের মধ্য দিয়ে। গোধূলী পর্যন্ত চলবে রাখালনৃত্য। এর আগে রাত ১১টা থেকে পরিবেশিত হবে শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ। এই রাসনৃত্য বুধবার ভোর (ব্রাহ্ম মুহূর্ত) পর্যন্ত চলবে। তারও আগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা উৎসবে যোগ দিয়েছেন। অসংখ্য মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে গোটা এলাকা। তিন দিনের রাসমেলা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলবে। দিনাজপুর থেকে স্টাফ রিপোর্টার সাজেদুর রহমান শিলু জানান, জেলার কাহারোলে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী কান্তনগর (কান্তজিউ) মন্দির প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী রাস উৎসব শুরু হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় উৎসবের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। মন্দির প্রাঙ্গণে বসেছে মাসব্যাপী রাসমেলা। অবাক হওয়ার মতো তথ্য হচ্ছে, ১৭৫২ সাল থেকে এখানে রাস উৎসব ও মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২৬৭ বছরের পুরনো মেলায় বিভিন্ন জেলাসহ দেশ-বিদেশের ভক্ত-পুণ্যার্থী ও পর্যটকরা সমবেত হচ্ছেন। অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, রাস উৎসব বহু বছরের ঐতিহ্য। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও, এটি বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকেই তুলে ধরছে। কলাপাড়া থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা মেজবাহউদ্দিন মাননু জানান, মঙ্গলবার ভোরে কুয়াকাটায় পাঁচ দিনের রাসলীলা শুরু হয়েছে। রাস উদযাপন কমিটির সভাপতি ও কলাপাড়া পৌরসভার মেয়র বিপুল চন্দ্র হাওলাদার জানান, পুণ্যস্থানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে রাস। এই স্থানের মধ্য দিয়ে সারা বছর জমা হওয়া পাপ পঙ্কিলতা দূর হবে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে অনুষ্ঠান কিছুটা সংকুচিত করা হলেও উৎসব চলবে বলে জানান তিনি।
×