ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা ও জাপা মহাসচিব পদ থেকে রাঙ্গার বহিষ্কার দাবি

প্রকাশিত: ১১:২১, ১৩ নভেম্বর ২০১৯

নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা ও জাপা মহাসচিব পদ থেকে রাঙ্গার বহিষ্কার দাবি

সংসদ রিপোর্টার ॥ জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও সংসদে বিরোধীদলের চীফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গার সম্প্রতি দেয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্বৈরচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে কটূক্তি ও ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য নিয়ে মঙ্গলবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল জাতীয় সংসদ। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন সরকারদলীয় প্রবীণ সংসদ সদস্যরা। তাঁরা অবিলম্বে জাতীয় সংসদে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানানোর পাশাপাশি তাঁকে জাতীয় পার্টির মহাসচিবের পদ থেকে বহিষ্কারেরও দাবি জানান। পাশাপাশি এক সময়ে যুবদল করে আসা রাঙ্গার সংসদে বিরোধী দলের চীফ হুইপের পদ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। তীব্র ক্ষোভ, উত্তেজনা ও অসন্তোষের মধ্যে দলের পক্ষ থেকে মশিউর রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্যের জন্য দুঃখ ও ক্ষমা চেয়ে জাতীয় পার্টির দু’জন সিনিয়র সদস্য দাঁড়িয়ে বলেন, এটি জাতীয় পার্টির নয়, মশিউর রহমান রাঙ্গার একান্তই ব্যক্তিগত বক্তব্য। এর দায় জাতীয় পার্টি নেবে না। তবে তাঁর এই লজ্জাজনক বক্তব্যের কারণে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি, ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এক পর্যায়ে সরকারী দলের সিনিয়র নেতাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদও মহাসচিব রাঙ্গার কর্মকা-ের কঠোর সমালোচনা করে তাঁকে তুলোধুনো করেন। এক সময় যুবদল করে আসা মশিউর রহমান রাঙ্গা কীভাবে জাপা মহাসচিব, সাবেক প্রতিমন্ত্রী হলো তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। এ নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক চলার সময় সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও বিতর্ক চলাকালে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে নিজ আসন থেকে উঠে গিয়ে অধিবেশনে থাকা সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কিছু সময় কথা বলতে দেখা যায়। তবে অধিবেশনে এ নিয়ে কোন কথা বলেননি জি এম কাদের। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে মঙ্গলবার মাগরিবের নামাজের বিরতির পর পয়েন্ট অব অর্ডারে অনির্ধারিত এ বিতর্কের সূত্রপাত করেন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী। এ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে তুলোধুনো করেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, গণফোরামের সুলতান আহমেদ মনসুর আহমেদ, তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভা-ারী এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ও মুজিবুল হক চুন্নু। তাঁরা সবাই জাপা মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গার কটূক্তিমূলক বক্তব্যের কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি তাঁকে সংসদে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানান। অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। মশিউর রহমান রাঙ্গা সেই চেষ্টা করেছেন। নূর হোসেন যখন হত্যা হয় তখন দেশে ফেনসিডিল, ইয়াবা ছিল না। ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু’র কথা বলা হয়। এই ভোট ডাকাতি-মিডিয়া ক্যু’র মূল হোতা ছিলেন প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আজ সেটাকে ঢাকার জন্য রাঙ্গা এত বড় দুঃসাহস দেখাতে পারেন না। তিনি বলেন, এরশাদের সময় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নির্যাতন ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। এরশাদকে শুধু আওয়ামী লীগ স্বৈরাচার বলে না, সারাদেশের মানুষ তাকে স্বৈরাচার বলে অভিহিত করেছে। সারাবিশ্বে এরশাদ স্বৈরাচার বলে পরিচিত। তাই জাপা মহাসচিব রাঙ্গাকে অবশ্যই তাঁর কুরুচীপূর্ণ বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। অপর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও মশিউর রহমান রাঙ্গাকে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, মশিউর রহমান রাঙ্গা এমন একটি বক্তব্য দিয়েছেন, তা বাংলার মানুষের হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। নূর হোসেন হত্যার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয়, দেশের মানুষ রুখে দাঁড়ায়। অথচ রাঙ্গা সাহেব ভুলে গেছেন, এরশাদ সাহেব নূর হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তাঁর মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, সংসদে ক্ষমা চেয়েছিলেন। অথচ রাঙ্গা শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে ত্চ্ছু-তাচ্ছিল্য করেছেন। এই বক্তব্যের জন্য তাঁকে ধিক্কার জানাই। তিনি বলেন, মশিউর রহমান রাঙ্গার এমন বক্তব্যের কারণে সারাদেশে স্বৈরাচার শব্দটি উচ্চারণ হচ্ছে, তার কুশপুতুল দাহ হচ্ছে। তাই রাঙ্গা যে বক্তব্য দিয়েছে সেজন্য অবশ্যই তাকে ক্ষমা চাইতে হবে। আর তিনি যে এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, সেই এলাকায় আওয়ামী লীগ না থাকলে নির্বাচিত হতে পারতেন কিনা, তা বলতে চাই না। তবে জাপা মহাসচিব খুবই খারাপ বক্তব্য দিয়েছেন। একজন সুস্থ মানুষ, তিনি যদি স্বাভাবিক থাকেন তার (রাঙ্গা) পক্ষে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী ও শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে এমন বক্তব্য দেয়া সম্ভব নয়। আমি তাঁর বক্তব্যের ঘৃণা জানাই। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, মশিউর রহমান রাঙ্গা যে কথা বলেছে, এটা কোন সুস্থ মানুষ বলতে পারে না। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলার আগে তাকে চিন্তা করা দরকার ছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পাকিস্তানী আর্মির সঙ্গে একত্রিত হয়ে পাকিস্তানের স্বার্থে কাজ করেছেন। রাঙ্গার এই বক্তব্য গণতন্ত্রের ওপর আঘাত। মশিউর রহমান রাঙ্গাকে শুধু ক্ষমা চাইলেই হবে না। জাতীয় পার্টিকে তার এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে হবে। ক্ষমা তো তাকে চাইতেই হবে, তা না হলে গণতন্ত্রের জন্য ক্ষত থেকে যাবে। গণফোরাম নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী, শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলেছেন মশিউর রহমান রাঙ্গা। কথায় আছে ’রতনে রতন চেনে... ’। আমি বাকি কথাটা আর বললাম না। যে নূর হোসেনকে সামনে রেখে আমরা আন্দোলন করেছি, তাকে তিনি কটাক্ষ করেছেন। এটা করে তিনি সংসদকে অপমান করেছেন। কারণ স্বৈরাচারের পতন না হলে রাঙ্গা সাহেব সংসদে এসে বসতে পারতেন না। একথা বলে তিনি প্রমাণ করেছেন, স্বৈরাচারের দালালদের চরিত্র পরিবর্তন হয় না। তাকে অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে। তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভা-ারী বলেন, মশিউর রহমান রাঙ্গার বক্তব্য শুধু নূর হোসেনের বিরুদ্ধে নয়, দেশের স্বাধীনতা, সংসদ ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্রের ধারাকে অপমান করেছেন। তার এই বক্তব্যের জন্য যদি জাতীয় পার্টি কোন ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে জাতীয় পার্টি আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। রাঙ্গাকে ক্ষমা চাইতে হবে। তিনি ক্ষমা না চাইলে জাতীয় পার্টি থেকে তাকে বহিষ্কার করতে হবে। বিতর্কের সূত্রপাত করে তাহজীব আলম সিদ্দিকী বলেন, শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে অপমানজনক বক্তব্যের প্রতিকার চাই। মশিউর রহমান রাঙ্গা বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি করেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তার এই বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। এরজন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এমন ধরনের দম্ভোক্তি থেকে বিরত থাকে, সেই প্রতিশ্রুতিও দিতে হবে। বানরকে লাই দিলে মাথায় উঠে- কাজী ফিরোজ রশীদ ॥ শহীদ নূর হোসেন সম্পর্কে জাতীয় পার্টির মহাসচিবের বক্তব্য নিয়ে সংসদে কড়া সমালোচনা করেছেন একই দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেন, বান্দরকে লাই দিলে গাছের মাথায় ওঠে। আর এই লাই দিয়েছে জাতীয় পার্টি নয়, আওয়ামী লীগই রাঙ্গাকে প্রতিমন্ত্রী করে। আমি যতদিন রাজনীতি করি ততদিন উনার (রাঙ্গা) বয়সও না। সে এই ধৃষ্ঠতা দেখায় কিভাবে? এই দুঃসাহস সে কিভাবে পেল? তিনি বলেন, মশিউর রহমান রাঙ্গার বক্তব্যে জাতীয় পার্টির নয়, একান্তই তার ব্যক্তিগত। এটা কোন রাজনৈতিক বক্তব্য হতে পারে না। তবে এই বক্তব্যের জন্য জাতীয় পার্টি লজ্জিত, আমরা দুঃখিত ও অপমানিত অনুভব করছি। কথায় আছে- বান্দরকে (বানর) লাই দিলে মাথায় ওঠে। এই লাই আমরা দেইনি। এই লাই এই সংসদই দিয়েছে। কি ধরনের লোককে যাদের অতীত নেই, বর্তমান কিছুই ছিল না। হঠাৎ তাকে মন্ত্রী বানানো হলো, একটার পর একটা প্রমোশন দেয়া হলো। আমরা তো তাজ্জব হয়ে গেলাম। এগুলো আমরা দেইনি। এই সংসদে রাঙ্গা বসে চীফ হুইপ হয়ে। তিনি বলেন, আমি যতদিন রাজনীতি করি তত দিন ওর বয়সও না। অতীতে সে (রাঙ্গা) করেছে যুবদল, কোথায় আন্দোলন করছে? কোথায় সংগ্রাম করছে? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে, প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কটূক্তি করার ধৃষ্টতা সে পেল কোথায় থেকে? নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মশিউর রহমান রাঙ্গার পেছনে না থাকলে সে রংপুরে নামতেও পারত না। কার কত ভোট আছে আমাদের জানা আছে। জাতীয় পার্টির অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, মশিউর রহমান রাঙ্গার বক্তব্যে জাতীয় পার্টি দলীয়ভাবে সমর্থন করে না। এটা তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। শহীদ নূর হোসেনের ব্যাপারে জাতীয় পার্টির কী দৃষ্টিভঙ্গি সেটা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নূর হোসেনের বাড়িতে গিয়েই দেখিয়েছিলেন। তার মা- বাবার কাছে এরশাদ দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করেছিলেন। এটাই জাতীয় পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি। এর বাইরে কেউ কিছু বললে সেটা তার বক্তব্য। তবে দোষ-ত্রুটি থাকলেও জাতীয় পার্টি গণতন্ত্রের জন্য আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছে, নির্বাচনে সহযোগিতা করেছে। এটা মনে রাখলে ভাল হয়।
×