ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হলুদ ফলের ভেতরের রং পাকা পেঁপের মতো- খেতে মিষ্টি

প্রকাশিত: ১১:১৩, ১০ নভেম্বর ২০১৯

হলুদ ফলের ভেতরের রং পাকা পেঁপের মতো- খেতে মিষ্টি

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ সৌদি আরবসহ মরুপ্রধান দেশের বেশ জনপ্রিয় ফল সাম্মাম। ফলটি সাধারণত দুই ধরনের হয়। হলুদ মসৃণ আবৃত খোসার ফলটির ভেতরের রং পাকা পেঁপের মতো। অন্যটি খোসার অংশ খসখসে ও ভেতরের অংশে হালকা হলুদ এবং বাদামি বর্ণের। খেতেও খুব মিষ্টি। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের মাধ্যমে পরিচিত এ ফলটি এখন চাষ হচ্ছে বরিশাল নগরীতে। নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের করমজা এলাকায় শৌখিন চাষী মোঃ গিয়াস উদ্দিন লিটু (৪৫) এবার সাম্মামের চাষ করেছেন। প্রথমবারের মতো তার ফলনও ভাল হয়েছে। তাই পাইকারি বিক্রির পাশাপাশি লিটু নিজেও এ ফলটি খুচরা বাজারে বিক্রি করছেন। হলুদ রঙের এ ফলটি দেখতে ভিন্নরকম হওয়ায় এবং খেতে খুবই মিষ্টি হওয়ায় অনেকেই কিনছেন সাম্মাম। তবে এদেশের মানুষের কাছে রহস্যে ঘেরা এ ফলটি একনজর দেখতেই বেশি মানুষ ভিড় করছেন চাষী লিটুর কাছে। গিয়াস উদ্দিন লিটু একসময় পল্লীবিদ্যুতের চুক্তিভিত্তিক ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ছিলেন। চাষাবাদে বিশেষ করে সবজি ও ফল চাষে তার দীর্ঘদিনের আগ্রহ। গত কয়েকবছর ধরে ভিন্ন ও নতুন নতুন জাতের ফল এবং সবজি উৎপাদন করে তিনি বেশ আলোচনায় রয়েছেন। তার এ কর্মকা- দেখে উৎসাহিত হয়ে অনেক শৌখিন চাষীও ভিন্ন ও নতুন নতুন জাতের ফল উৎপাদনে ঝুঁকছেন। লিটু জানান, নিজের ও বাড়ির পাশের কিছু জমিতে তিনি চাষাবাদ করেন। তিন-চার বছর আগে অফসিজনের তরমুজ চাষ করে সাফল্য পেয়ে তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেন। তারই ধারাবাহিকতায় সবজির পাশাপাশি পেয়ারা, মাল্টা, বিভিন্ন জাতের (কানিয়া, সনিয়া, সুইট ব্লাক-২), সুইট মেলন বা সাম্মাম বা ফ্রুটিরও বেশ কয়েকটি জাতের চাষ করেন। যার প্রত্যেকটিতেই তিনি উৎপাদনে সফলতা পেয়েছেন। তিনি জানান, গত দুই সপ্তাহে তিনি দুইশ’ কেজি সাম্মাম বিক্রি করেছেন। পাইকারি দেড়শ’ টাকা কেজি দরে ফল বিক্রেতারা সাম্মাম কিনছেন। পাইকারদের কাছে এ ফল বিক্রি করার পাশাপাশি নিজেও নগরীর লাইন রোডের মেসার্স বাকেরগঞ্জ বীজ ভা-ারের সামনে ও নগরীর বগুরা রোডের খামার বাড়ির সামনে বসে এ ফল বিক্রি করছেন। তবে ফলটি কেনার চেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা নিয়ে। ফলে প্রতিনিয়ত লোকজন যাচ্ছে তার বাড়িতে সাম্মাম ক্ষেত দেখতে। গিয়াস উদ্দিন লিটু চাষাবাদ সম্পর্কে বলেন, সাম্মাম ফল সাধারণত খোলা মাঠে চাষ করা বা উৎপাদন করা অনেক কঠিন কাজ। খোলা মাঠে চাষ করতে গেলে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। কারণ এটি অনেক স্পর্শকাতর একটি ফসল। এটা মরুর দেশের ফল হলেও আমাদের এখানে এর সফল চাষ হলো। তবে চাষে লক্ষণীয় মাটি অবশ্যই ঝুরঝুরে হতে হবে, যাতে তলদেশ পর্যন্ত সেচের ব্যবস্থা হয়, মাটির ওপরের অংশে কোনভাবেই পানি জমতে দেয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, সাম্মাম ফলের রোগবালাই তেমন নেই বললেই চলে, গাছে খুব সামান্য সার ও কীটনাশক দিতে হয়। আর এ ফল গাছের সঠিকভাবে চাষাবাদ এবং নিয়মিত ফুলের পরাগায়ন ভালো মতো হলে একেকটি গাছ থেকে বেশ কয়েকটি ফল উৎপাদন করা সম্ভব। তবে ফলের ওজনে লতা ছিঁড়ে পড়ার ভয়ে একটু বড় হওয়ার পরপরই ফলগুলো ব্যাগিং করতে হয়। তিনি ভাদ্র মাসে ২০ শতক জমিতে সাম্মামের বীজ বপন করেন। পাশাপাশি তরমুজেরও চাষ করেছেন। বীজ বপনের মাত্র ৪০ দিনের মধ্যেই সাম্মামের গাছে ফল ধরেছে। অনেকটা শসা গাছের মতো মাচায় লতাজাতীয় সাম্মাম গাছগুলোতে ঝুলছে সাম্মাম ফল। নগরীর লাইন রোডের বাকেরগঞ্জ বীজ ভা-ারের স্বত্বাধিকারী এসএম জাকির হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা বিভিন্ন ধরনের ফলের বীজ সংগ্রহ করি। আর লিটু সেখান থেকে সম্পূর্ণ আলাদ কিছু ফলের বীজ সবসময় সংগ্রহ করেন। এসব ফলের উৎপাদন খরচের সঙ্গে মিল রেখে তিনি বিক্রির দর ঠিক করেন। তিনি আরও বলেন, পাকা সাম্মাম বাঙ্গির ঘ্রাণ সংবলিত। এ ফলটির স্বাদ অত্যন্ত সুস্বাদু। ভেতরের রং পাকা পেঁপের মতো। অনেকে এ ফল কিনছেন আবার অনেকে দেখছেন। আর ক্রেতারা বলছেন, দাম আরও কমানো সম্ভব হলে এ ফলের চাহিদা বাড়তো। বরিশাল মেট্রোপলিটন কৃষি কর্মকর্তা ফাহিমা হক জনকণ্ঠকে বলেন, সাম্মাম ফলটি মূলত মরুভূমি অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বেশি চাষ হয়। বাংলাদেশে সৌদিআরবসহ অন্য মরুভূমির দেশ থেকেই এ ফলের বীজ আনা হয়েছে। বরিশালে শুধু গিয়াস উদ্দিন লিটুই সাম্মাম ফলের চাষ করেছেন। ফলন ভালো হওয়ায় তিনি বেশ লাভবান হচ্ছেন। কারণ দেশী ফলের চেয়ে সাম্মামের দাম একটু বেশি, উৎপাদন খরচ কম। মাচায় চাষ করতে হয় সাম্মাম। পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণও কম। বরিশালের আবহাওয়া সাম্মাম চাষের জন্য যথেষ্ট অনুকূল বলেও তিনি উল্লেখ করেন। শৌখিন চাষী গিয়াস উদ্দিন লিটু জনকণ্ঠকে জানান, নতুন জাতের ফল উৎপাদনের নেশায় গত ৪/৫ মাস আগে ঢাকার সিদ্দিকবাজারের একটি বীজের দোকানে গিয়ে তিনি বাংলাদেশে উৎপাদন সম্ভব এমন বিদেশী ফলের বীজ খোঁজেন। তখন পেয়ে যান সাম্মামের বীজ। মাত্র ১০ গ্রাম বীজ কিনে আনেন ৫০০ টাকায়। তিনি আরও জানান, প্রথম চাষেই প্রচুর সাম্মাম ফলেছে। তবে প্রথম ধাপের সব ফল বিক্রি হলে আবার বীজ বপন করবেন। গত দুই সপ্তাহে তিনি প্রায় ২০০ কেজি সাম্মাম বাজারে বিক্রি করেছেন। অনেকে আকৃষ্ট হয়ে বাড়ি এসে বাগান থেকে সাম্মাম নিয়ে যাচ্ছেন খাওয়ার জন্য। ফল বিক্রেতাদের কাছে পাইকারি দেড়শ’ টাকা কেজি দরে এবং খুচরা ক্রেতাদের কাছে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। গিয়াস উদ্দিনের প্রতিবেশী মনিরুজ্জামান জানান, তিনি সাম্মাম খেয়েছেন। পাকা ফলের স্বাদ অত্যন্ত মিষ্টি। রং পাকা পেঁপের মতো। বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ জনকণ্ঠকে বলেন, বরিশালে চাহিদা অনুযায়ী ফলের আবাদ কম। তাই কৃষকদের বাণিজ্যিকভাবে দেশী-বিদেশী ফল ও ফসল উৎপাদনে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। গিয়াস উদ্দিন সাম্মাম উৎপাদন করে কৃষি বিভাগের নজর কেড়েছেন। তাকে সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নগরীসহ জেলার অন্যান্য উপজেলার কৃষকদের সাম্মাম চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
×