ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দিশেহারা কৃষক

যশোরে ধানখেতে কারেন্ট পোকার আক্রমণ

প্রকাশিত: ০৯:৪২, ৯ নভেম্বর ২০১৯

যশোরে ধানখেতে কারেন্ট পোকার আক্রমণ

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ মাঠে পাকতে শুরু করেছে আমন ধান। কার্তিকের হিমেল হাওয়ায় দোল খাচ্ছে ধানের সোনালি শীষ। সেই সঙ্গে দোল খাচ্ছে কৃষকের রঙিন স্বপ্ন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে অগ্রহায়ণের প্রথম সপ্তাহে কৃষকরা ঘরে তুলবেন সোনালি ফসল। ভরে যাবে গোলা, মুখে ফুটবে নবান্নের হাসি। কিন্তু গত ৩ মাস ধরে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর নিবিড় পরিচর্যার পর শেষ মুহূর্তে এসে ভেস্তে যেতে বসেছে যশোরের কৃষকদের সোনালি স্বপ্ন। ধানে কারেন্ট পোকার আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন বহু কৃষক। সরেজমিনে যশোর সদর উপজেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে এ ক্ষতির সেই দৃশ্য দেখা গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র মতে, যশোরের আবহাওয়া আমন চাষের উপযোগী। এবারও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আমন চাষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি অর্জিত হয়েছে। চলতি মৌসুমে যশোর জেলার ৮ উপজেলায় আমনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৯৭৫ হেক্টর। যা অর্জিত হয়েছে অর্থাৎ চাষ হয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ১২৫ হেক্টর জমিতে। তবে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আমন ধানের কারেন্ট পোকার আক্রমণ দেখা গেছে। কিন্তু সদর উপজেলার বেশির ভাগ ইউনিয়নে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি ছাতিয়ানতলা গ্রামের চাষী কবির সর্দার বলেন, চলতি আমন মৌসুমে ৪ বিঘা ধান চাষ করেছি। এর মধ্যে প্রায় দেড় বিঘা জমিতে কারেন্ট পোকা ধরেছে। বৃহস্পতিবার কীটনাশক দিয়েছি। এখন কী হবে জানি না। একই এলাকার চাষী আলতাফ শেখ জানান, রোপা আমনের ক্ষেতে কারেন্ট পোকা আক্রমণ করেছে। আক্রান্ত ধানক্ষেত দূর থেকে দেখলে মনে হচ্ছে পেকে গেছে। ধানের শীষ ও গাছ সম্পূর্ণ সোনালি রং ধারণ করেছে। কিন্তু আক্রান্ত গাছের ধানের ভেতরে কোন দানা নেই। ধানে চিটা হয়ে যাওয়ায় এ নিয়ে তিনি বিপাকে পড়েছেন। একই এলাকার চাষী জামশেদ, তোতা, খালেকরা অভিযোগ করে বলেন, কারেন্ট পোকা এক ধরনের ছোঁয়াচে পোকা। এক জমিতে লাগলে অন্য জমিতেও আক্রমণ হয়। কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বা তাদের কোন কৃষি কর্মকর্তা মাঠে কৃষকদের এ রোগ থেকে মুক্তির জন্য কোন প্রকার তথ্য বা চিকিৎসা দিচ্ছে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক সুশান্ত কুমার তরফদার সাংবাদিকদের জানান, অন্ধকারাচ্ছন্ন ও আলো-বাতাস কম থাকে এমন জমিতে এই পোকার আক্রমণ হয়। প্রাথমিক অবস্থায় কীটনাশক ছিটিয়ে এটি দমন করা যায়। অন্যবারের তুলনায় এ জেলায় কারেন্ট পোকা আক্রমণ কম। যেসব খেতে ধান পেকে যাচ্ছে, আমরা সেগুলো কৃষকদের কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছি। স্টাফ রিপোর্টার নীলফামারী থেকে জানান, জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকায় হঠাৎ করে আমন ধান ক্ষেতে শেষ মুহূর্তে বাদামি গাসফড়িংয়ের (কারেন্ট পোকা) আক্রমণ দেখা দিয়েছে। এতে ধানগাছ মরে যাচ্ছে। এ কারণে পুরোপুরি পাকার আগেই অনেক কৃষক ধান কেটে ঘরে তুলছেন। অপরদিকে আমন ধান ক্ষেতে ইঁদুরের উপদ্রব দেখা দিয়েছে। এই সময়ে আমন খেতে পাতা ঝলসানো রোগসহ বিভিন্ন রোগের পাশাপাশি ইঁদুরের উপদ্রবে চাষীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। শুক্রবার সদর উপজেলা খোকসাবাড়ী ইউনিয়নের হালিরবাজার মাস্টারপাড়া এলাকার কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেসব আমন ক্ষেতে পানি জমে বা নিচু, সেসব ক্ষেতে ইঁদুরের দল ধান গাছের গোড়া কেটে নষ্ট করছে। তারা ইঁদুর তাড়াতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও সফল হতে পারছেন না। নদী ও পুকুর এলাকার পাশের জমিতে এই উপদ্রব বেশি। ইঁদুরগুলো আকারে বেশ বড়। চাষীরা ইঁদুরের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা হিসেবে ক্ষেতের মধ্যে বাঁশের কঞ্চি গেড়ে তাতে পলিথিন টাঙিয়ে দিয়েছেন। কৃষক মতিয়ার রহমান বলেন, এবার এলাকায় ইঁদুরের উপদ্রব সব থেকে বেশি। আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। এদিকে কৃষকেরা জানান, কারেন্ট পোকার উপদ্রব দেখা দেয়ায় ধান গাছ পুড়ে যাওয়ার রং ধারণ করে মরে যাচ্ছে। এ কারণে অনেকে আধাপাকা ধান কাটতে শুরু করেছেন। অনেকে স্থানীয় বাজারের দোকানদারদের পরামর্শে ধানে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। সদর উপজেলার পঞ্চপুকুর ও কচুকাটা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কিছু কিছু অংশের ধানগাছ পুড়ে গিয়ে মরে গেছে। কচুকাটা ইউনিয়নের মহব্বত বাজিতপাড়া গ্রামে ধান কাটছিলেন হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, তিন বিঘা জমিতে ধান করেছি। ধান পুরো পাকতে আরও ৭ দিন সময় লাগল। কিন্তু ক্ষেতে কারেন্ট পোকা দেখা দিয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে আগেভাগে ধান কেটে নিতে হচ্ছে। ওই গ্রামের মাসুদ রানা বলেন, তিনি দেড় বিঘা জমিতে এবার আমন আবাদ করেছেন। এর মধ্যে আধা বিঘা জমিতে কারেন্ট পোকা ধরেছে। কীটনাশক দিছি কি হবে জানিনা। এখন ধান পাকার সময় প্রায় ১০ দিন ধরে এলাকায় কারেন্ট পোকার আক্রমণ দেখা দিল। বাজিতপাড়া গ্রামের সহিদুল ইসলাম বলেন, চার বিঘা জমিতে এবার আমন আবাদ করেছি। দুই বিঘায় ১১ জাতের এবং দুই বিঘায় মামুন স্বর্ণ জাতের ধান লাগিয়েছি। মামুন স্বর্ণ ধান কেটেছি। বাকি দুই বিঘায় কারেন্ট পোকা দেখা দিয়েছে। এক বিঘায় কীটনাশক ছিটাতে লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন শ’ টাকা। অথচ ধানের দাম নেই। শুকিয়ে ৭৫ কেজির এক বস্তা ধান বিক্রি করেছি আট শ’ টাকায়। পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের উত্তর পাড়া গ্রামের শামসুল হক বলেন, আমি এ বছর ১৪ বিঘা জমিতে আমন আবাদ করেছি। এসব জমিতে বিচ্ছিন্নভাবে কারেন্ট পোকা ধরেছে। এখন কীটনাশক ছিটাচ্ছি। কী হবে জানি না। তিনি আরও বলেন, এ ইউনিয়নের মানুষমারা, চেংমারী, মিলের বাজারসহ সব এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে কারেন্ট পোকা দেখা দিয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নীলফামারীতে এ বছর ১ লাখ ১২ হাজার ৩৭৫ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে ১ লাখ ১২ হাজার ৬৬২ হেক্টর জমিতে ধানের চাষ হয়েছে; যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৮৭ হেক্টর বেশি। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ১৮২ মেট্রিক টন চাল। এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক আবুল কাশেম আজাদ বলেন, ইঁদুর দমনের জন্য সবচেয়ে ভাল উপায় ক্ষেতে এমন কিছুর ব্যবস্থা করা, যাতে সব সময় শব্দ হতে থাকে। শব্দ হলে ইঁদুর ভয়ে আর ক্ষেতে ঢুকবে না। এজন্য সাদা পলিথিন বাতাসে দুললে শব্দ হয়। এতে ইঁদুর পালিয়ে যায়। আমরা এ নিয়ে কৃষকদের সচেতন করেছি। অপরদিকে কারেন্ট পোকার বিষয়ে তিনি বলেন, কৃষকেরা যাকে কারেন্ট পোকা বলছেন, সেটি হলো বাদামি গাসফড়িং। অন্ধকারাচ্ছন্ন ও আলো-বাতাস কম থাকে এমন জমিতে এই পোকার আক্রমণ হয়। প্রাথমিক অবস্থায় কীটনাশক ছিটিয়ে এটি দমন করা যায়। এ জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে বাদামি গাসফড়িং অল্প বিস্তার লাভ করেছে। তা খুবই কম। যেসব ক্ষেতে ধান পেকে যাচ্ছে, আমরা সেগুলো কৃষকদের কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছি।
×