ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাতগুণ বেশি গাড়ি

প্রকাশিত: ০৯:১১, ৯ নভেম্বর ২০১৯

সাতগুণ বেশি গাড়ি

বিস্ময়ের হলেও সত্য যে, আন্তর্জাতিক মানদ-ের চেয়ে সাতগুণ বেশি গাড়ি চলাচল করছে রাজধানীতে। বিআরটিএর নিবন্ধন তথা পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় উঠে এসেছে এই তথ্য। গত দশ বছরে গাড়ি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ, যার মধ্যে প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলই ৬৫ শতাংশ। অভিযোগ রয়েছে যে, বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ উপেক্ষা ও অগ্রাহ্য করে বিআরটিএ বিশেষ করে ছোট গাড়ি ও মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দিয়েছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী অর্থাৎ রাস্তার তুলনায় গাড়ি চলার হার ঢাকায় সর্বোচ্চ দুই লাখ ১৬ হাজার হলেও বিআরটিএতে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়েছে ১৪ লাখ ৯৯ হাজার ২৩৩টি যানবাহন। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসের নিবন্ধন থেকে দেখা যায়, ঢাকায় প্রতিদিন রাস্তায় নামছে ৪৫০টি গাড়ি অথচ দুই বছর আগে দিনে নিবন্ধিত হতো ৩০৩টি গাড়ি। রাজধানীর আয়তন, জনসংখ্যা, রাস্তাঘাট বাসস্থান ইত্যাদি অনুপাতে এত বিপুল সংখ্যক যানবাহনের নৈমিত্তিক চলাচলের তাৎক্ষণিক কুফল হলো ভয়াবহ ও অসহনীয় যানজট, শ্রমঘণ্টা নষ্ট, ভয়ানক বায়ুদূষণ সর্বোপরি জনস্বাস্থ্য সমস্যা ইত্যাদি। যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত-সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। চীন ও সিঙ্গাপুরে গাড়ি কেনার নীতি করা হয়েছে লটারি পদ্ধতিতে। যুক্তরাজ্যে গাড়ি পার্কিং কর বাড়ানো হয়েছে অবিশ্বাস্য হারে। ভারতের দিল্লীতে যানজট নিয়ন্ত্রণ ও বায়ুদূষণ কমাতে জোর-বিজোড় পদ্ধতিতে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ চালু করা হয়েছে। আর বাংলাদেশ তথা রাজধানী ঢাকায় মেলে উল্টো চিত্র। এখানে যে কেউ টাকা থাকলে যখন-তখন গাড়ি কিনতে নিবন্ধন পেতে এমনকি লাইসেন্স বাগিয়ে নিতে পারে। গাড়ির মালিক ব্যক্তিটি নিয়মিত কর পরিশোধ করে কিনা, তার জীবন-জীবিকা, আয়-ব্যয়ের উৎস, টাকা সাদা না কালো- সে সব আদৌ খতিয়ে দেখা হয় না। এর ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার উপদ্রবের মতো রয়েছে অগণিত ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন। ফলে সড়ক দুর্ঘটনাসহ তীব্র যানজট, সেই সঙ্গে ভয়াবহ বায়ুদূষণ বাড়ছেই, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। উল্লেখ্য, রাজধানী ঢাকা বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বে প্রায় শীর্ষে অবস্থান করছে। বিশ্বে প্রতি বছর ১৩ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে সড়ক দুর্ঘটনায়। পঙ্গু ও আহত ততোধিক। এর এক-তৃতীয়াংশ ঘটে দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে। গত দুই দশকে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার হয়েছে তিনগুণ, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। সর্বোপরি সড়ক দুর্ঘটনা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত তথা শ্লথগতি করে দেয়। সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ৬৭ শতাংশ বাংলাদেশী ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী। এ ছাড়া ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর চতুর্থ বৃহত্তম কারণ হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা। ফলে সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত পরিবারগুলোতে একদিকে যেমন নেমে আসে মানবিক বিপর্যয়, অন্যদিকে হতে হয় সমূহ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন। এমতাবস্থায় যানজটে অচল রাজধানীকে সচল করতে এবং সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বাংলাদেশকে সাহায্য সহযোগিতা করতে স্বতপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসেছে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক। এটি নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক খবর। রাজধানীসহ সারাদেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলেও ফিটনেস নবায়ন না করা গাড়ির সংখ্যা চার লাখ ৭৯ হাজার ৩২০টি। এর বাইরেও রয়েছে লাইসেন্সবিহীন অথবা ভুয়া বা জাল কাগজপত্রের যানবাহন। মাঝে মধ্যে ঢাকা ও অন্যত্র বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে যানবাহন পরীক্ষা করে ফিটনেসবিহীন গাড়ি শনাক্তকরণসহ যানবাহন জব্দ, মামলা দায়েরসহ জেল জরিমানা ইত্যাদি করে না, তা নয়। তবে যানবাহনের সংখ্যার তুলনায় এর পরিমাণ নগণ্য বলা চলে। জাতীয় মহাসড়কগুলোতে ১৫৪টি ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান রয়েছে। বেশকিছু স্থানে নিরাপত্তা চিহ্ন ফলক বসানো হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যথাযথ মান বজায় রাখা হয়নি। রেলক্রসিংগুলো প্রায় অরক্ষিত। সড়কচিহ্ন ও মার্কিংসহ নানা ত্রুটি সর্বত্র। ১৮১ কোটি ২ লাখ টাকা ব্যয়ে জাতীয় মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলোয় সড়ক নিরাপত্তা উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মহাসড়কে গাড়ির সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার করার সিদ্ধান্ত ফাইলবন্দী রয়েছে। ফলে দুর্ঘটনা বাড়ছেই। দুর্ঘটনার অনেক কারণের মধ্যে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো একটি। সড়ক-মহাসড়কে ইজিবাইক, হোন্ডা, ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান, নসিমন, করিমন, লেগুনা চলছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এসব ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে বিশ্বব্যাংক-জাতিসংঘ। এর পাশাপাশি ২০১৮-এর ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে অনুমোদিত সড়ক পরিবহন আইনটি যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা জরুরী।
×