ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

'ভালো-বাসা' নামের বাড়িটির গৃহকত্রী নবনীতা দেব সেনের বিদায়

প্রকাশিত: ০১:৪৭, ৮ নভেম্বর ২০১৯

'ভালো-বাসা' নামের বাড়িটির গৃহকত্রী নবনীতা দেব সেনের বিদায়

অনলাইন ডেস্ক ॥ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল নবনীতা দেব সেন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কলকাতায় মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি। কয়েকদিন আগেই কলকাতার একটি সংবাদপত্রে তিনি ফিচার লিখেছিলেন কীভাবে ক্যান্সারের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি লড়াই করে চলেছেন। সেই লড়াইয়ের শেষে সন্ধ্যা সাতটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতেই তার মৃত্যু হয়। তার দুই কন্যা নন্দনা এবং অন্তরা সেই সময়ে পাশেই ছিলেন। তার বাড়িটির নাম ছিল 'ভালো-বাসা'। কলকাতার একটি পত্রিকার রবিবারের ম্যাগাজিনে 'ভালো-বাসার বারান্দা' নামে তার ধারাবাহিক রচনা অতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, যেটি পরে বই হিসাবেও প্রকাশিত হয়। ৭২ নম্বর হিন্দুস্তান পার্কের ওই 'ভালো-বাসা' বাড়িটি তৈরি করিয়েছিলেন নবনীতা দেব সেনের বাবা সাহিত্যিক নরেন্দ্র দেব। সেখানেই ১৯৩৮ সালের ১৩ জানুয়ারি জন্ম হয় কবি-সাহিত্যিক নরেন্দ্র দেব আর সেকালের নারী সাহিত্যিক হিসাবে রীতিমতো বিপ্লব ফেলে দেওয়া রাধারানী দেবের মেয়ে 'খুকু'র। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সদ্যজাতর নাম রাখলেন নবনীতা। আরও একটি নামকরণ হয়েছিল তার। স্নেহের 'রাধু'র [ রাধারানী দেবী] মেয়ের নাম শেষ শয্যায় শুয়েও দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও - অনুরাধা। তবে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নামটাই আনুষ্ঠানিক নাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল নবনীতা দেবসেনের। নামকরণের তিন দিন পরেই প্রয়াত হন শরৎচন্দ্র। বাবা-মা দুজনেই কবি - সাহিত্যিক। নিবিড় যোগাযোগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে প্রমথ চৌধুরী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, জলধর সেন প্রমুখ সমসাময়িক সব সাহিত্যিকের সঙ্গেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্যের পরিবেশেই বড় হয়ে উঠছিলেন নবনীতা। কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম প্রত্যয়' দিয়ে শুরু হলেও উপন্যাস, গদ্য, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, রম্যরচনা - সাহিত্যের প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই তার ছিল অবাধ বিচরণ। সেসবের সঙ্গেই অনায়াসে লিখতেন ছোটদের জন্যও। 'লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস'এর সাউথ এশিয়ান লিটারেরি রেকর্ডিংস্ প্রজেক্ট নবনীতা দেবসেনের লেখা সম্বন্ধে মন্তব্য করেছে "তার রসবোধ আর মজা করার ক্ষমতা, একই সঙ্গে নিঃস্পৃহতা আর হৃদয়ে ছুঁয়ে যাওয়ার মানসিকতা তার লেখাগুলোকে অনন্য করে তুলেছে।" আর সেইসব অনন্য রচনাই তাকে এনে দিয়েছে দেশ-বিদেশের নানা সম্মান আর পুরষ্কার। আত্মজীবনীমূলক রম্যরচনা 'নটী নবনীতা'র জন্য ১৯৯৯ সালে ভারতের সাহিত্য একাডেমী সম্মান পান, পরের বছর ভারত সরকার তাকে দেন 'পদ্মশ্রী' সম্মান। শুধু যে সাহিত্য রচনাই তিনি করেছেন, তা নয়। প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বিদেশে যান। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর ছাত্রী ছিলেন। উচ্চশিক্ষার পরে দেশে ফিরে এসে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়েতেই শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। সেখানে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপনা করতেন চাকরিজীবনের শেষ অবধি, আবার পড়াতে যেতেন অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়তেও। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়তেই মানববিদ্যা বা উইমেন্স স্টাডিজের চর্চা শুরু হয় আশির দশকের মাঝামাঝি। নবনীতা মানববিদ্যা চর্চা কেন্দ্রে যেমন বেশ কয়েকবার লেকচার দিয়েছেন, তেমনই হাতে-কলমেও মানববিদ্যা-চর্চা করেছেন তিনি। ২০০০ সালে, মা রাধারানী দেবীর জন্মদিনে গড়েছিলেন বাংলা ভাষায় নারী লেখিকাদের নিজস্ব গোষ্ঠী 'সই'। সম্ভবত বিশ্বের প্রথম আর এখনও পর্যন্ত একমাত্র নারী লেখিকা, প্রকাশকদের নিয়ে 'সইমেলা' নামে নারী বইমেলা নবনীতা দেবসেনেরই সৃষ্টি। মানববিদ্যা চর্চাকে তিনি সময়োপযোগীও করে তুলেছেন। তৈরি করেছেন ওয়েবসাইট, আর নারী লেখিকাদের জন্য ব্লগ। নারী চর্চা যে শুধু তার 'অ্যাক্টিভিজম'এ সীমাবদ্ধ থেকেছে, তা নয়। মানবীবিদ্যার চর্চা প্রকাশ পেয়েছে তার নানা সাহিত্য কীর্তিতেও। তিনি দীর্ঘ দিন রামকথা নিয়ে কাজ করেছেন। সীতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি রামকথার বিশ্লেষণ করেছেন। গবেষণার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর দুই নারী কবিকে - একজন বাংলার, অন্যজন অন্ধ্র প্রদেশের। একেবারে সাধারণ, কিন্তু ব্রাহ্মণ পরিবারের ওই দুই নারী কবি কীভাবে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন বাংলা আর তেলেগু ভাষায়, সেই গবেষণা করেছিলেন নবনীতা দেবসেন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীকে ওই রামায়ণ রচনা নিয়ে গবেষণার কাজেই যেমন খুঁজে পেয়েছিলেন নবনীতা, তেমনই মোল্লা নামের সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা তেলেগু ভাষার ওই নারী কবির সাহিত্য কীর্তিও খুঁজে বার করেছিলেন তিনি। তারপরে দুই নারী কবির লেখা রামায়ণের বিশ্লেষণ করেছিলেন তিনি। একজন নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাহিত্যকে বিচার বিশ্লেষণ করার রসদ তিনি জুটিয়েছিলেন তার মায়ের জীবন এবং সাহিত্যচর্চা থেকে। নবনীতা দেবসেনের মা রাধারানী দেবীর মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল ইলাহাবাদে কর্মরত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নামে এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। ঘটনাচক্রে, কয়েকমাসের মধ্যেই এশিয়াটিক ফ্লু'য়ে মৃত্যু হয় তার। সেই সময়ে যা একরকম অভাবনীয় ছিল, সেটাই ঘটেছিল রাধারানী দেবীর জীবনে। স্বামীর মৃত্যুর পরে শাশুড়ির উৎসাহেই লেখালেখি আর বিদ্যাচর্চা শুরু করেন রাধারানী দেবী। গোঁড়ায় নিজের নামেই কবিতা ছাপা হলেও একটা পর্যায়ে 'অপরাজিতা দেবী' নামে তার নানা লেখা বেরতে শুরু করে। যেসব কবিতা বেরত তখনকার পত্র-পত্রিকায়, সেগুলোর তীক্ষ্ণ মতামত দেখে অনেকেরই মনে হয়েছিল যে সেসব হয়ত নারীর ছদ্মনামে কোনও পুরুষেরই লেখা। রবীন্দ্রনাথকে এই মতামত জানিয়েছিলেন কেউ কেউ। তবে তিনি বিশ্বাস করেন নি তা। সেই পর্যায়েই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ হয় রাধারানী দেবীর। তারপরে ঘনিষ্ঠতা এতটাই নিবিড় হয়েছিল যে বিধবা হয়েও সাহিত্যচর্চার সূত্রে পরিচিত কবি নরেন্দ্র দেবকে যখন বিয়ে করার মনস্থির করেছিলেন 'বিধবা' রাধারানী দেবী, তখনও অনুমতি নিতে গিয়েছিলেন কবিগুরুর কাছেই। শরৎচন্দ্র আর প্রমথ চৌধুরীর অনুমতিও নিয়েছিলেন। ১৯৩১ সালে এক বিধবা নারী নিজের ইচ্ছায় দ্বিতীয়বার বিয়ে করছেন, এ ছিল অভাবনীয় ঘটনা। তাই বিয়ের পরেই কাগজে শিরোনাম হয়েছিল 'রাধারানী-নরেন্দ্র দেব বিবাহ: কন্যার আত্ম সম্প্রদান'! সেই বিয়েতে আবার সম্পূর্ণ মদত ছিল তার প্রথম স্বামীর মায়ের। নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে সংসার পাতার কিছুদিন পরে রাধারানীর প্রথম সন্তান - পুত্রসন্তান মারা যায়। তারপরেই চিকিৎসকের পরামর্শে ৭২ নম্বর হিন্দুস্তান পার্কের জমিটি কিনে সেখানে একটি বাড়ি তৈরি করেন নরেন্দ্র দেব। ওই বাড়ির নাম দেওয়া হয় 'ভালো-বাসা। সেখানেই ১৯৩৮ এ জন্ম নেন নবনীতা। উল্টোদিকেই জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই কাটিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ওই 'ভালো-বাসা' বাড়িতেই তোলা সপ্তাহ দুয়েক আগের একটি ছবিই মোটামুটিভাবে নবনীতা দেবসেনের শেষ হাস্যোজ্বল ছবি হিসাবে সাধারণ মানুষের মনে থেকে যাবে। অক্টোবরের ২২ তারিখ ওই বাড়িতেই তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন সদ্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিত বিনায়ক ব্যানার্জী, মাত্র একদিনের জন্য কলকাতায় এসেও। অর্থনীতি এবং নোবেলের সঙ্গে নবনীতা দেব সেনের আরও একটি সম্পর্ক রয়েছে। আরেক বাঙালী নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয় ১৯৫৯ সালে। তবে ১৯৭৬ এ তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×