ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বেনাপোল কাস্টমসে রাজস্ব ঘাটতি ৭১৪ কোটি ২১ লাখ টাকা

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ৮ নভেম্বর ২০১৯

 বেনাপোল কাস্টমসে রাজস্ব ঘাটতি ৭১৪ কোটি ২১ লাখ টাকা

স্টাফ রিপোর্টার, বেনাপোল ॥ চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিনমাসেই বেনাপোল স্থলবন্দরে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ৭১৪ কোটি ২১ লাখ টাকা। এই তিনমাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। সেখানে আদায় হয়েছে ৭৫১ কোটি ২১ লাখ টাকা। সর্বশেষ অর্থবছরে (২০১৮-১৯) এই কাস্টমস হাউসে রাজস্ব ঘাটছি ছিল এক হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। ওইবছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, সেখানে আদায় হয়েছে ৪ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হয়। সেই হিসেবেই বন্দরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার অধিক রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা। অনিয়ম বন্ধ হলে রাজস্ব আয় বাড়বে। তবে বৈধভাবে বাণিজ্যেরে ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করায় রাজস্ব ঘাটতির কারণ বলে মনে করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। বন্দর সূত্রে জানা যায়, দেশের ২৩টি স্থলবন্দরের মধ্যে চলমান ১৩ বন্দরের অন্যতম বেনাপোল স্থলবন্দর। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে পণ্য আমদানির জন্য দেশে যতগুলো বন্দর রয়েছে তার মধ্যে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর হলো বেনাপোল। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের অন্য যেকোন বন্দরের তুলনায় উন্নত। বেনাপোল থেকে কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। সে কারণে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ পণ্য এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ সুবিধা পেয়ে দেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী এ বন্দর দিয়ে মালামাল আমদানি করে থাকেন। যেদিন ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয় সেই দিন থেকে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই আমদানি করা পণ্য বন্দরে প্রবেশ করে। তবে পণ্য আমদানির বেলায় এ বন্দরে চলে নানা অনিয়ম। কখনও পণ্য আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা, আবার ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য এনে সরকারের শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়। আর এসব কাজে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে সহযোগিতা করে কাস্টমসের এক শ্রেণীর কর্মকর্তারা। এতে শুল্ক আয় কমে যাচ্ছে। কাস্টমস সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে প্রথম তিনমাসে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল এক হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। সেখানে আদায় হয়েছে ৭৫১ কোটি ২১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জুলাই মাসে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৫৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা, সেখানে আদায় হয়েছে ২৫৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। আগস্টে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা, আদায় হয়েছে ২০২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এবং সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০৫ কোটি ১০ লাখ টাকা, সেখানে আদায় হয়েছে ২৯৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এরআগে গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। রাজস্ব আদায় হয়েছিল চার হাজার ১৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। তখনও একই কারণে ঘাটতি ছিল ১৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বেনাপোল সিএ্যান্ডএফ এজেন্টের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, সব বন্দরে আমদানি পণ্যের ওপর রাজস্ব পরিশোধের নিয়ম এক হতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে যে পণ্যের ওপর রাজস্ব ৪ ডলার, বেনাপোল বন্দরে ওই একই পণ্যের ওপর সাড়ে ৪ ডলার শুল্ক আদায় করা হচ্ছে। বন্দরের ধারণ ক্ষমতা ৩৮ হাজার টন। কিন্তু এখানে সব সময় পণ্য থাকে কমপক্ষে দেড় লাখ টন। জায়গার অভাবে পণ্য খালাস করতে না পেরে ভারতীয় ট্রাক বন্দরে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকছে। খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে মূল্যবান পণ্যসামগ্রী পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বৈধ সুবিধা পেলে এ বন্দর থেকে বর্তমানে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে, তখন তার দ্বিগুণ আয় হবে। আর শুল্ক ফাঁকির ঘটনা কখনও আমদানিকারকের পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয়। সাধারণ সিএ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীরা বলেন, এক শ্রেণী ব্যবসায়ীরা কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এটাও রাজস্ব ঘাটতির অন্যতম কারণ। এছাড়া বৈধ আমদানি চালান কাস্টমস কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ ছাড়া আবার বিজিবি সদস্যরা তা আটক করছে। সেখানে ২-৩ দিন পণ্য চালান আটকে থাকছে। আবার কাস্টম থেকে খালাস হবার পর শুল্ক ফাঁকির পন্য আটকের ও নজির রয়েছে বিজিবির। যে কারণে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিজিবি আর কাস্টমসের মধ্যে পরস্পরের সমন্বয় দরকার। এসব অনিয়মের কারণে দিন দিন এ বন্দরে রাজস্ব আদায়ে ধস নামছে। যশোর ৪৯ বিজিবি’র অধিনায়ক লে, কর্নেল সেলিম রেজা জানান, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে আমরা ৭৫ কোটি টাকার পণ্য আটক করেছি। যার মধ্যে বেনাপোল দিয়ে আসা কাপড়ের চালানসহ অন্যান্য পণ্য রয়েছে। বেনাপোল বন্দরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) আব্দুল জলিল বলেন, জায়গা সঙ্কটে বর্তমানে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে নতুন জায়গা অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে বেনাপোল বন্দর একটি আধুনিক বন্দরে রূপান্তরিত হবে। যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, বেনাপোল বৃহৎ বন্দর হলেও এর কোন সুফল আমরা পাচ্ছিনা। সপ্তাহে ৭ দিন বাণিজ্যসেবা চালু থাকলেও কাগজে-কলমে। বাণিজ্য প্রসার করতে হলে বৈধ সুবিধা ও অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেই। বাণিজ্য প্রসার করতে হলে বেনাপোলে সব ধরনের হয়রানিমুক্ত করা প্রয়োজন। বেনাপোল কাস্টমসের কমিশনার বেলাল হুসাইন চৌধুরী বলেন, এ বন্দরে কাস্টমস আইন এবং নিময়-কানুন যথাযথভাবে প্রয়োগ করার কারণে কিছু সুবিধাবাদী আমদানিকারকরা এ বন্দর ছেড়ে চলে গেছে। আবার উচ্চ শুল্কযুক্ত পণ্যে আমদানি কম হয়েছে। দুদকের সাবেক ডিডি আহসান আলী ভুয়া অভিযোগ করে আমাদের হয়রানি করার কারণেও অর্থবছরের প্রথম তিনমাসে রাজস্ব আহরণ কমে গেছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বৈধ সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।
×