ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নূরুল আম্বিয়া চৌধুরী

কালো রেখার উৎসব ॥ ইংকটোবার শোডাউন চারুকলা-২০১৯

প্রকাশিত: ০৮:১৩, ৮ নভেম্বর ২০১৯

কালো রেখার উৎসব ॥ ইংকটোবার শোডাউন চারুকলা-২০১৯

ব্যপ্তির কথা চিন্তা করলে ২০১৯-এর ইংকটোবার শোডাউন চারুকলা গতবারের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ! আটচল্লিশজন তরুণ শিল্পীর কাজ জমা পড়েছে প্রদর্শনীতে, হিসেবে প্রায় এক হাজার চার শ’ চিত্রকর্ম। চোখের জন্য ক্লান্তিকর, চিত্তের জন্য প্রক্রিয়াজাত করতে কিছুটা কষ্টকর। তবুও, দেখে আনন্দ পেয়েছে দর্শক। উন্মুক্ত পরিসরে একের পর এক কাজ কখন যেন শেষও হয়ে গেল টেরই পেলাম না! বিচিত্র সেটি অবয়বে, ভিন্ন সেটি মাত্রায় কিন্তু ঐক্য গড়েছে একটি জায়গায়- ‘ভাবনায়’। ইংকটোবারের নির্দিষ্টতা বলতে প্রম্পটলিস্ট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুরো অক্টোবর মাসজুড়ে হ্যাশট্যাগ আর মাস শেষে নিজের ঝুলিতে ইংকে করা একত্রিশটি কাজ। এর বাহিরে ইংকটোবারের আর নির্দিষ্ট কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। তবে সুফল রয়েছে দু’ধরনের। প্রথমত, কাজের চর্চা; একত্রিশ দিন একজন আঁকিয়ে একত্রিশটি চিত্র আঁকছেন। দ্বিতীয়ত, নিজের প্রতি দৃঢ় আত্মবিশ্বাস, যেটি তৈরি হতে বা গড়ে তুলতে শিল্পীদের একটু বেগ পেতে হয়। কেন যে কেউ শিল্পী হতে পারে না? আত্মবিশ্বাস ও চর্চার অভাব বোধকরি। সে যাই হোক, ২০১৯-এর ইংকটোবার শোডাউন ছিল ভিন্নমাত্রার নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী এক শিল্প প্রদর্শনী। এ যাত্রা দিন দিন যেন সহচরী নিয়ে আরও ফুলে ফেঁপে উঠছে। বিষয়টি ইতিবাচক, আবার নেতিবাচকও বটে। সেটি আলোচনা করব বিদায়ের আগে। ইংকটোবার শোডাউন চারুকলা ২০১৯-এ নজরকাড়ার মতো কিছু দিক ছিল। বেশিরভাগ তরুণ আঁকিয়ের আগ্রহ ছিল দেশীয় ও ঐতিহ্যগত বিষয়াবলীতে। যেমন বাংলাদেশ কেন্দ্রিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আঁকিয়ে। এ দেশের পৌরাণিক গল্পকথা, ভূতপ্রেত নিয়ে এঁকেছেন তরিকুল ইসলাম হীরক, জনপ্রিয় সাহিত্যিক ও লেখক নিয়ে সিরিজ এঁকেছেন নিলয় রায়, বাংলা চলচ্চিত্রের কালজয়ী সব অভিনেতা নিয়ে সিরিজ এঁকেছেন প্রসূন হালদার, বাংলাদেশের প্রাণের স্পন্দন- ক্রিকেটারদের উপস্থাপন করেছেন শাগুফতা নওরিন, ষড়ঋতু নিয়ে এঁকেছেন আঁকিয়ে জ্যোতি, হিন্দু শাস্ত্রের দেবী সিরিজ নিয়ে এঁকেছেন নবীন আঁকিয়ে অমøান দাস, বঙ্গদেশের ফুল-লতা-পাতা নিয়ে এঁকেছেন বেশ কিছু আঁকিয়ে। তাছাড়া, আরও দেখা মেলে ঐতিহ্যবাহী ট্যাপাপুতুল ও লোকজ মোটিফ ইত্যাদি। তবে, কেউ কেউ ঝুঁকেছেন বিদেশী বিষয়বস্তুর দিকে। যেমন আঁকিয়ে শাহানা সরওয়ারের আকর্ষণ ছিল জাপানের বিখ্যাত কাঠের ককেশি পুতুল, প্রকৃতি সরকার ও রাফিউজ্জামান রিদম এঁকেছেন হলিউডের বিখ্যাত সব থ্রিলার মুভির চরিত্র। ইংকটোবারের প্রম্পটলিস্ট অনুসরণ করেছেন ঠিকই কিন্তু এঁকেছেন সম্পূর্ণ দেশীয় ভাবনায়, এমন একজন আঁকিয়ে সোহেল আশরাফ খান। তার পুরো সিরিজের প্রথম দিককার চিত্রকর্মে রয়েছে নারীর একচ্ছত্র অবস্থান। মুখাবয়বে আংশিক বিমূর্তায়নের ছোঁয়া রেখে দৃঢ় কনট্যুর রেখায় এঁকেছেন বেশ কিছু নারী অবয়ব। শৈশবের স্মৃতিকাতরতা, মনের দোলাচল অবস্থার পাশাপাশি স্থান পেয়েছে সামাজিক কিছু অসঙ্গতিও। বাংলাদেশের মানচিত্রে চেপেছেন ব্যান্ডেজ; প্রতীকী আহত বাংলাদেশ! এঁকেছেন প্রিয় অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের অভিনীত ‘বাকের ভাই’ চরিত্রটি। কাকতালীয় হলেও সত্য অক্টোবরেই সেই অভিনেতার জন্ম। ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় নাচের বিখ্যাত কিছু ফর্ম হিসেবে কত্থক, ভরতনাট্যম, মণিপুরী, ওড়িসি, গৌড়ীয় ইত্যাদি বেশ পরিচিত। আবু ইবনে রাফি এঁকেছেন এই পাঁচটি ফর্মকে কেন্দ্র করে, যার মধ্যে গৌড়ীয় আমাদের বঙ্গ দেশের নাচ, মণিপুরীকে কেউ কেউ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের নৃত্য বলে মনে করেন- আর বাকি তিনটি ভারতীয়দের শাস্ত্রীয় নৃত্য। অপরদিকে, সামিরা আফরিন এঁকেছেন শুধু ভারতনাট্যম ফর্মকে কেন্দ্র করে একত্রিশটি মুদ্রার চিত্র। ঐকতান ছিল সব চিত্রকর্মে; ইচ্ছাকৃতভাবে মুখের অবয়ব বর্জন করেছেন, রেখেছেন শুধু চোখ- যেটি আঁকিয়ের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। একান্ত নিজের বৈশিষ্ট্য কেন্দ্রিক চিত্রকর্মের দেখা মেলে প্রায় আঁকিয়ের কাজে। একটি বিষয় বেশ লক্ষণীয় ছিল- বেশকিছু আঁকিয়ের কাজে দেখা মেলে টানাপোড়েন। টানাপোড়েনগুলো ব্যক্তিগত ও মানসিক, কিংবা সামাজিক। দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার দৃশ্যও চোখে পড়ার মতো। অনাদিনি মগ্ন নিজের চিত্রে ফুটিয়ে তোলেন নিজেকে ও প্রাত্যহিক জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে। পুরো সিরিজজুড়েই ছিল নিজের আত্মপ্রতিকৃতি। আশপাশের বন্ধু-বান্ধবের প্রতিকৃতি অঙ্কনের মধ্য দিয়ে কেউ কেউ আবেগের জায়গাটুকু ফুটিয়ে তোলেন। শিফা তাসনিম আঁকেন ‘ইন লাভিং মেমোরি’ সিরিজ। সেখানে প্রাধান্য পায় প্রিয় মিউজিক ব্যান্ড ‘লিনকিন পার্কে’র অন্যতম প্রধান ভোকালিস্ট প্রয়াত- চেস্টার বেনিংটন। আঁকিয়ে রাশমি আঁকেন ভারতের বিখ্যাত সব দর্শনীয় স্থান যেমন কলকাতা, সিকিম, দার্জিলিং, গোয়া, গুজরাট ইত্যাদি। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আঁকিয়ের বিষয়বস্তু ছিল লোকজ মোটিফ ও ঐতিহ্যগত ফর্ম, ট্যাপাপুতুল, লোকজ খেলনা, লোকজ ডিজাইন ইত্যাদি। ভারতীয় উপমহাদেশের মিথিলা রাজ্যের মধুবনি পেইন্টিং নিয়ে আঁকেন নিশাত সুবহা নিতি। আধা বিমূর্ত ও শুদ্ধ বিমূর্ত ফর্মেও ছবি আঁকেন কেউ কেউ। বুক ইলাস্ট্রেশনের ছাপও দেখা যায় কিছু নবীন শিল্পীর কাজে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অন্যতম প্রধান অবদান ‘রোবট’। প্রাণহীন অথচ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স) সাহায্যে প্রায় প্রাণীদের মতো কাজ করে রোবট। আঁকিয়ে ফয়সাল আবিরের কাজে আছে এমনই মজার একটি কমিক চরিত্র রোবট- ‘নর’। পশ্চিমের শিল্পী এডভারড মাঞ্চের ‘দ্য স্ক্রিম’ দেখে থাকলে দর্শক নিমিষেই নরের চেহারাকে তার সঙ্গে তুলনা করতে পারবেন। কিছুটা কৌণিক ফর্মের চেহারায় রোবট নরের অজৈব চোখে এক ধরনের জৈব আকাক্সক্ষা। নর মূলত একটি শিশু রোবট, যে কিনা কৌতূহলী, যে অনেক কিছু শিখতে চায়, ভাবতে চায় মানুষের মতো করে। আঁকিয়ে ফয়সাল নরের নামটি নিয়েছেন সংস্কৃত শব্দ ‘নর’ থেকে, যার অর্থ মানুষ। নরের একত্রিশটি কাজের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিদরূপ উপস্থিত ছিল। প্রশাসনের জনগণের প্রতি কৌশলী নিপীড়ন, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অনৈতিক হত্যাকাণ্ডকে এই ক্ষুদ্র রোবট আঙ্গুল তুলে প্রশ্ন করেছে। নর মূলত একটি হাস্যরসাত্মক চরিত্র। কিউবিজম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চিত্র এঁকেছেন এমন শিল্পী বাংলাদেশে অসংখ্য। তবে কিউবিজমের সম্পূর্ণ প্রভাব থেকে বের হয়ে কিন্তু সেটির মতো করে তলকে ভেঙ্গে চিত্র এঁকেছেন শিল্পী জুবায়ের বিন আজিম। তার কাজে তিনি রেখাকে মুখ্য করে ফর্মের সিমপ্লিফিকেশনের ওপর জোর দিয়েছেন। শুদ্ধ বিমূর্তায়নেও যাননি আবার ফর্মের সলিডিটিতে থাকতে চাননি। তার কাজের বিষয়বস্তু ছিল মূলত রিক্সা, যেটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি বাহন। ফর্মকে বিভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে দেখার অভিজ্ঞতাটি আঁকিয়ের মিনিয়েচার শিল্প থেকে নেয়া। তার কাজে কনসেপ্টের চেয়েও বস্তুর এক্সপ্রেশন বেশি প্রকাশ পেয়েছে। চারুকলায় ইংকটোবারের এই যাত্রাটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আঁকিয়ের সংখ্যা গাণিতিক হারে বেড়েছে সেটি গত তিন বছরের পরিসংখ্যান দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়- ২০১৭ সালে চারজন, ২০১৮ সালে চব্বিশজন, আর ২০১৯-এ এসে সেটি আটচল্লিশ। সংখ্যাই কি সব? বোধকরি না। এক হাজার চার শ’ চিত্রকর্ম অনেক ব্যাপ্তি নিয়ে দেখা প্রয়োজন, সে হিসেবে এবারের প্রদর্শনীর ব্যাপ্তি ছিল যথারীতি মাত্র তিনদিন। বিষয়টি এমন যে- ‘ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে তাড়াতাড়ি খা!’ সময় আরও বাড়ানো যেত, অন্তত একদিন। পাবলিক আর্ট ও পাবলিক শো মেনে চলা এই প্রদর্শনীর সবকিছুই পাবলিক কেন্দ্রিক ছিল। তবে, অল্প স্থানে বেশি কাজের ঘনত্ব কিছুটা অস্বস্তিকর। দর্শকের চোখ কাজের ভিন্নতা ও মাত্রাবহুলতায় শান্তি পেলেও কাজের প্রাচুর্যতায় ক্লান্ত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর তাছাড়া কিছু আঁকিয়ের কাজ অন্ধকারে থাকায় অনেক দর্শক সেগুলো বাদ দিয়ে চলে গেছেন অন্যত্র যেটি শিল্পীর জন্য কিছুটা অপ্রত্যাশিত বলে আমি মনে করি। আঁকিয়েরা প্রায় সবাই কাজের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা দেখিয়েছেন। কেউ কেউ ধারণাগত জায়গায় অনেক শক্তিশালী ছিলেন। লোকজ ভাবনা, ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও দেশজ ভাবনা দর্শককে এক ধরনের প্রশান্তি দিয়েছে। প্রতিকৃতি অঙ্কনের বিষয়টি বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। কেউ কেউ এঁকেছেন নিজের স্টাইলে। ডিজাইন কেন্দ্রিক শিল্পের ছড়াছড়িও ছিল চোখে পড়ার মতো। গত বছর ইংকটোবার নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছিলাম বাংলাদেশে ইংকটোবারের গ্রাহ্যতা ও বাংলাদেশী আঁকিয়েদের বিদেশী সংস্কৃতি নির্ভরশীলতা নিয়ে। তবে, এবারের প্রদর্শনী দেখে সেটি নিয়ে আশঙ্কামুক্ত হলাম। আঁকিয়েদের হাতে ইংকটোবারের প্রম্পটলিস্ট থাকলেও সেটিকে তারা পদ্মার পবিত্র জল দিয়ে ধুয়ে পুরোদমে বাঙালী করে নিয়েছে। এঁকেছেন দেশের বিষয়বস্তুকে তুলে ধরার জন্য। শিকড়ের সন্ধানে হাতড়িয়ে বেড়িয়েছেন প্রাচ্য ধারা, লোকশিল্প, ঐতিহ্যগত মোটিফ ইত্যাদি। দর্শকের সময়-স্বল্পতার অনুপাতে কাজের ঘনত্ব, প্রদর্শনীর নিয়ম অনুযায়ী যথার্থ স্থান সঙ্কুলান না হওয়া, আলো স্বল্পতায় মুখ থুবড়ে পড়া কিছু ভাল চিত্রকর্ম, আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কেন্দ্রিক দর্শকের সেলফি তোলার যন্ত্রণা একপাশে ঝেড়ে ফেলে দিলে এবারের ইংকটোবার মানে, গুণে, ব্যাপ্তি ও অর্থে সত্যই ছিল অনবদ্য। সকল আঁকিয়ের প্রতি শুভকামনা। আসছে বছর নতুন কিছু দেখব, এই প্রত্যাশা।
×