ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কৃতিজন ॥ শৈবাল কুমার ঘোষ

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৭ নভেম্বর ২০১৯

সংস্কৃতিজন ॥ শৈবাল কুমার ঘোষ

ঢাকায় তাঁর সংগঠনের পরিবেশনা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সে কথা লিখেছিলামও ‘ঢাকার দিনরাত’ কলামে। তবে সংগঠনের প্রাণপুরুষ শৈবাল কুমার ঘোষ ও তাঁর সহধর্মিণী পিয়ালি ঘোষের সঙ্গে আলাপচারিতার সুযোগ হয় কলকাতায়। শৈবাল ঘোষ, দীর্ঘদেহী সুদর্শন এই ভদ্রলোক সিরিয়াস ধরনের সংস্কৃতিজন; প্রধানত সংগঠক তিনি, মঞ্চের দীর্ঘ পরিবেশনার মূল পরিকল্পনার কাজটি তিনি করে থাকেন। নিজে নাটক লেখেন। তবে আমার কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে তাঁর মানবতাবাদী শিল্পমনা পরিচয়টি। প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রশিক্ষণ ও পরিবেশনার কেন্দ্রীয় সংগঠকের কাজটি করেন তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে। প্রশিক্ষণ, সাধনা এবং অঙ্গীকারবোধ একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বহুদূর নিতে পারে- তারই দৃষ্টান্ত দেখেছিলাম ঢাকার মঞ্চে। ভারতের সাংস্কৃতিক সংগঠনের পরিবেশিত প্রতিটি নৃত্য দর্শকদের বিপুল আনন্দ দিয়েছিল। ভারতের ফামোচি (FAMOCHI) সংগঠনের নাম হয়েছে ফাদার-মাদার-চিলড্রেনের সংক্ষিপ্ত রূপ নিয়ে। এটি একটি সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সংস্থা, যার হাল ধরে আছেন শৈবাল ঘোষ। বঙ্গীয় লেখক শিল্পী সম্মেলনের সমাপনী সন্ধ্যায় পরিবেশন করেছিল দশটি ভিন্ন স্বাদের নৃত্য। শুরুতে ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’- ১৩ জন নৃত্যশিল্পীর পরিবেশনা। পরেরটিও রবিঠাকুরের গানের নৃত্য রূপায়ণ- বিপুল তরঙ্গ রে, এরপর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতনির্ভর নৃত্য। ভুপেন হাজারিকার বিখ্যাত গান ‘বিস্তীর্ণ দুপাড়ে অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও- এটি সৃজনশীল নৃত্যের উদাহরণ। এছাড়াও তাদের পরিবেশিত ওডিসি ধ্রুপদী নৃত্য, কত্থক ধ্রুপদী নৃত্য, ভরতনাট্টম ও কুচিপুড়ি ধ্রুপদী নৃত্য এবং কবি কাজী নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা অবলম্বনে নৃত্য দর্শকদের সমীহ আদায় করে নেয়। নৃত্যের আগে পিয়ালী ঘোষের সঞ্চালনা ছিল প্রাসঙ্গিক তথ্যনির্ভর। সামগ্রিক পরিচালনায় ছিলেন আলোচিত শৈবাল কুমার ঘোষ। কিছুকাল আগেও শৈবাল ঘোষ ঢাকায় এসেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বাংলার নাট্যদলের অংশগ্রহণে প্রথমবারের মতো আয়োজিত ‘বঙ্গ মিলন নাট্যোৎসব’ উপলক্ষে। ফামোচি পরিবেশন করে তাঁর লেখা কমেডি ‘উল্টে গেল’। সুকুমার রায়ের ‘পাজি পিটার’ এবং উপেন্দ্রকিশোরের ‘রাজা ও টুনটুনি’ থেকে মূল ভাবনা নিয়ে শৈবাল ঘোষ লিখেছেন আরেকটি হাসির নাটক ‘কাবাব’। কলকাতার মনোহরপুকুরের উত্তম মঞ্চে অভিনীত হয়েছে নাটকটি। শৈবাল ঘোষের বিশেষ মানবতাবাদী শুদ্ধতামুখী শিল্পঅন্তপ্রাণ ভূমিকার পরিচয় পেতে তাঁর সঙ্গে অনেকটা আলাপ করতে হয়েছে। তিনি বলছিলেন, আমাদের সমাজে সবচেয়ে অবাঞ্ছিত হলো শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী শিশু, অটিস্টিক শিশু। বেশ ক’বছর আগে আমরা একটি প্রজেক্ট হাতে নিই এ কথাই জোরেশোরে বলতে যে, এই শিশুরা অবাঞ্ছিত নয়। সঠিক প্রশিক্ষণ পেলে তারাও অন্যান্য শিশুর মতোই সব ধরনের কাজকর্ম করতে পারে। আমরা মনোচিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে, এসব শিশুর বড় চিকিৎসা হতে পারে তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করার ব্যবস্থা করে দিলে। কলকাতায় প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুদের প্রশিক্ষণদান ও লেখাপড়ার কাজ করে থাকে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। আমাদের ফামোচির নৃত্য-গীত ও নাটকের সঙ্গে যুক্ত প্রশিক্ষকরা সেসব বিদ্যালয়ে গিয়ে তাদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক শাখায় প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে অনুষ্ঠানের বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই। এসব শিশুর প্রশিক্ষণদানের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের উপলব্ধি হয়েছে যে, এরা মোটেই অক্ষম নয়। এরা বিশেষভাবে সক্ষম। আমাদের প্রতিষ্ঠান আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সামনে এরা নাচ-গান পরিবেশন করে, নাটিকায় অভিনয় করে। এসব শিশু যখন পারফর্মেন্স করে নানা মাধ্যমে তাদের সেই অনুষ্ঠান দেখে সাংবাদিক এবং গুণীজনরা বিস্ময় প্রকাশ করে থাকেন। কেননা তারা বহু নামী-দামী শিল্পীদের পারফর্মেন্স দেখেছেন, কিন্তু শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে প্রতিবন্ধকতার শিকার শিশুরাও যে এত ভাল পরিবেশনা করতে পারে, সেটি তাদের কল্পনাতেও ছিল না। ভরতনাট্যমের বিশ্বখ্যাত শিল্পী থাংকুমুনি কুট্টি বিশেষ অতিথি হয়ে এসেছিলেন একবার। তিনি অনুষ্ঠান দেখে বলেন, আজ আমার চোখ খুলে গেল। আমি তো এতকাল সুস্থ সবল শিশুদের দিয়ে নাচের অনুষ্ঠান করিয়েছি। আগে থেকে বলে না দিলে বুঝতামই না যে এরা প্রতিবন্ধী। স্কুলের অনুষ্ঠানে একটি বিশেষ প্রাপ্তি হলো আদান-প্রদান এবং একজনের পারফর্মিং ক্ষমতা দেখে আরেকজনের প্রেরণালাভ ও আত্মবিশ্বাসের জায়গাটি তৈরি হওয়া। আলাপের উপসংহারে জানা গেল ফামোচি থেকে কয়েকশ’ দুস্থ শিশুর মায়েদের হাতে বার্ষিক অনুদান তুলে দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ফলে শুধু শিল্পচর্চাই নয়, আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে সমাজসেবার কাজটিও করছেন শৈবাল ঘোষ।
×