ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তোফায়েল হোসেন খান

অভিমত ॥ পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন

প্রকাশিত: ০৯:০১, ৬ নভেম্বর ২০১৯

অভিমত ॥ পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন

সবুজে সবুজে ছাওয়া বাংলাদেশের পার্বত্য বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি। যেন ক্যামেরাবন্দী স্বর্গীয় অনুপম নিসর্গ। নৈসগিক বটে, তবে তা দুর্গম, অতিদুর্গম। কোন দুর্গম এলাকাকে যদি আপনি হাতে রাখতে চান, তাহলে তাকে করতে হবে সবচেয়ে সুগম, অগ্রসর ও উন্নত। বঞ্চনা আর বৈষম্য ক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। যে কোন জনপদকে। এ কথা সত্য যে, সমতলের তুলনায় পাহাড়ী ওইসব এলাকা পিছিয়ে আছে। ওখানে পর্যাপ্ত সুবিধা বাড়িয়ে ঐ জনপদকে এগিয়ে আনতে হবে। ঐ জনপদ এবং জনগণকে জনসম্পদে সহজে বশে রাখার সাধারণ কৌশল হচ্ছে, ঐ জনপদের জনগণের চাওয়া-পাওয়ার চেয়েও বেশি সুযোগ-সুবিধার বিস্তৃতি ঘটানো। বঞ্চনা আর বৈষম্যকে কোন অবস্থাতেই প্রকট হতে না দেয়া। কাউকে বোঝা নয়, সবাইকে প্রয়োজনীয় করে তোলাই জ্ঞানীর কাজ। তাহলে কোন জনপদ কখনো বেয়াড়া হয়ে ওঠে না; থাকে হাতের মুঠোয়। পার্বত্য এলাকার উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-কারখানা নির্মাণ করা যায়। প্রয়োজনে গার্মেন্টস শিল্পকে করা যায় সম্প্রসারিত। এতে করে ওখানকার বাঙালী-অবাঙালী সব মানুষের কর্মসংস্থান হবে। প্রয়োজনে সেখানকার মানুষের ঐতিহ্যবাহী বস্ত্র বয়ন শিল্পের মানউন্নয়ন ঘটিয়ে কুটির শিল্পকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে ধাবিত করা যায়। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও সমগ্র দেশ, এমনকি বহির্বিশ্বের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে। বাংলা হরফগুলো যেহেতু যে কোন ভাষায় উচ্চারিত শব্দরাশিকে হুবহু প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে, তাই প্রয়োজনে বাংলা বর্ণলিপির মাধ্যমে তাদের ব্যবহৃত সকল শব্দের অভিধান সংকলন এবং ব্যাকরণ প্রকাশ করা যায়। উদ্যোগটি বাংলা একাডেমিও হাতে নিতে পারে বা আলাদাভাবে করা যেতে পারে উপজাতীয় ভাষা একাডেমি। স্থানীয় সংস্কৃতির বিকাশ সাধনে তাদের লোকায়ত কৃষ্টি-সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে লোকায়ত অভিধান বের করা যেতে পারে। স্থানীয় লোকসংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য লোকসংস্কৃতি জাদুঘর প্রতিটি পার্বত্য জেলা এবং উপজেলায় গড়ে তোলা যায়। যদিও সীমিত আকারে বর্তমানে তা এক প্রকারের আছে বলা যায়। এ কথা অনস্বীকার্য, শিক্ষা যে-কোন সমাজের অগ্রগতির প্রধান সোপান। তাই পার্বত্য এলাকার প্রতিটি জেলায় একটি করে পূর্ণাঙ্গ সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, উপজাতীয় নন্দন সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করা যায়। প্রয়োজনে সমগ্র বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবাকে বিশ্বমানে পৌঁছাতে, রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ওখানে নার্সিং বিশ্ববিদ্যালয়ও গড়ে তোলা যায়। কেননা এক্ষেত্রে সেবাব্রতী ওখানকার মা-বোনদের নিপুণ হাত প্রায় প্রবাদতুল্য। এছাড়াও কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা সম্প্রসারণে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর আওতায় স্থানীয় লোকজন, বিশেষ করে উপজাতীয় লোকজনদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করলে ঐ এলাকার দ্রুত আর্থিক উন্নয়ন করা সম্ভব। পাহাড়ে বাঁশ কাঠের প্রাচুর্য আছে। বাঁশ, কাঠ শিল্পকে সামনে রেখে ব্যাপক বনাযন কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়। কাগজ শিল্পের উন্নয়নে বাঁশ ও নরম কাঠের উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। গড়া যায় কাগজ কারখানা। গড়ে তোলা যায় রফতানি উপযোগী বড় বড় ফার্নিচার শিল্প কারখানা। পাহাড়ে বিভিন্ন মশলা, চন্দন, আগর, রাবার, সেগুন, মেহগনি, গজারি গাছের আবাদ করা যায়। বরই-আম-লেবু-কমলা, আনারস উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। আচার তৈরির কারখানা বা জ্যামজেলি তৈরির রফতানি উপযোগী শিল্প-কারখানা গড়া যায়। শুঁটকি এদেশে সবার প্রিয়। উপজাতীয় মানুষদের কাছে আরও জনপ্রিয় খাদ্য শুঁটকি। এই শুঁটকিকে ঘিরেও গড়ে তোলা যায় শুঁটকি প্রসেসিং এলাকা। অধিকন্তু জুমচাষ পদ্ধতিকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপায় অবলম্বন করে কতটুকু সামনে এগিয়ে নেয়া যায়, সে চিন্তাভাবনা করা যায়। মৎস্য চাষের জন্য জীববৈচিত্র্য ক্ষুণœ না করে কোন কোন পাহাড়কে কেন্দ্র করে জলাশয় নির্মাণ করে রুই-কাতলা-মহাশোল জাতীয় মাছ চাষের অভয়াশ্রম গড়ে তোলা যায়। উপজতাীয় এলাকায় সূর্য ডোবার পর পর পরিবারগুলোতে অন্ধকার নামে। পাড়ায়-পাড়ায় সৌরবিদ্যুত প্লান্ট গড়ে সেখান থেকে ঘরে-ঘরে সৌর বিদ্যুত সরবরাহ করলে, তাদের ঘরের অন্ধকার এবং জীবনের অন্ধকারও অনেকটা কাটে। বর্জ্য ব্যবস্থা থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে রান্নাবান্নার কাজকে সহজ করে দেয়া যায়। স্বাস্থ্যসম্মত উন্নত নিরাপদ টয়লেট করে দিয়ে তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমিয়ে আনা যায়। পাহাড়ে বসবাসকারীদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু করলে আরও ভাল। পাহাড়ী জনপদের মানুষেরা বড় কষ্টে দৈনন্দিন পানি সংগ্রহ করে থাকে। তাদের সে অবর্ণনীয় কষ্ট নিজ চোখে না দেখলে কাউকে বিশ্বাস করানো যাবে না। প্রত্যন্ত এলাকার মানুষজনের পানি সংগ্রহ পদ্ধতির জন্য বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মতো জলাধার নির্মাণ করে দিলে তারা উপকৃত হবে নিঃসন্দেহে। ঝরনা বা ঝিরি বা ছড়ার পানি সংগ্রহের জন্য তাদেরকে নিয়মিত পাহাড়ে ওঠানামা করতে হয়। সে কষ্ট থেকে রেহাই দিতে ঝরনা/ছড়ার পথে পাকা সিঁড়ি তৈরি করে দিলে তাদের কষ্ট লাঘব হয়। ছড়া বা ঝরনার মুখে পানি ওপরে তোলার জন্য পাম্পের সংযোগ লাগিয়ে দিলে পানি সংগ্রহ করার কাজটি সহজ হয়। পাহাড়গুলোর গায়ে গতরে আছে ঝরনা ঝিরি ছড়া। কোথাও কোথাও আছে নয়নাভিরাম জলপ্রপাত। সেসব ঝরনা শৈলপ্রপাতের উদ্দাম উল্লাসে অবিরাম ছুটে চলার ভঙ্গিটি দেখার মতো। যেন কোন তন্বী তরুণীর নাচের ভঙ্গিতে হেঁটে যাওয়া। ‘রাঙামাটির পথে লো, বাদল বাজে, বাজে বাঁশের বাঁশিÑ এ শুধু গানের কথা না, বাস্তব সত্যি। পর্যটক আকর্ষক এসব স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা যায় নানাবিধ বিনোদন পার্ক বা থিমপার্ক। প্রয়োজনে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়ার জন্য রোপওয়ে/ক্যাবলকার বা ঐতিহ্যবাহী বার্মা ব্রিজ তৈরি করে দিলে তাদের পারস্পরিক যোগাযোগের সেতুটি মজবুত হয়। রবীন্দ্রনাথের কথায় শেষ করিÑ যারে তুমি নিচে ফেল/সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে/পশ্চাতে রেখেছ যারে/ সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে। তাই তাদের পশ্চাতে ঠেললে তারাও অমোঘ নিয়মে আমাদের পেছনে টানবে। তাদেরকে পশ্চাৎবর্তী না করে অগ্রবর্তীদের সঙ্গে একসঙ্গে চলা শেখাতে হবে। সমাজের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলার মহান ব্রতে আমরা পথ চলব এক সঙ্গে। সেই লক্ষ্যে পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ অতীব জরুরী। পাহাড়ে বসবাসকারীদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্থিতিকে বিচলিত না করে পার্বত্য এলাকার উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করা হোক। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ে এখন যে স্বস্তিটুকু আছে, তার পুরো কৃতিত্বের দাবিদার স্বপ্ন সারথী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দুরদর্শী সুযোগ্য নেতৃত্বে পার্বত্য এলাকার শান্তি ও উন্নয়ন আরও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে, এই আশা রাখছি। লেখক : প্রভাষক, সরকারী আনন্দমোহন কলেজ, ময়মনসিংহ
×