ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিকশিত হোক পুষ্প পল্লবে

প্রকাশিত: ০৯:০১, ৬ নভেম্বর ২০১৯

বিকশিত হোক পুষ্প পল্লবে

অটিস্টিক শিশু জন্ম দেয়া অপরাধ নয়, অপরাধী নয় আক্রান্ত শিশুটিও। কারণ সন্তান জন্ম দেয়ার পুরো প্রক্রিয়া বা লালন-পালনে মা-বাবার অসতর্কতার জন্য অটিজম হয়েছে- বিজ্ঞানভিত্তিক এমন প্রমাণ নেই। যৌথ পরিবার কাঠামো ভেঙ্গে একক পরিবারে শিশুর নিঃসঙ্গ বেড়ে ওঠাও এর জন্য দায়ী নয়। বরং চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের আসল সন্দেহ বংশগতির দিকে। রক্ত সম্পর্কীয়দের মধ্যে অটিজম প্রবণতা বেশি হওয়া চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের এই সন্দেহের কারণ। এ নিয়ে সারা পৃথিবীতে গবেষণা চলছে। গবেষণা চলছে পরিবেশগত প্রভাব নিয়েও। কিন্তু স্পেসিফিক কারণ জানা যায়নি এখনও। এখনও পর্যন্ত চিকিৎসকরা একে বলছেন মাল্টিফ্যাক্টরিয়াল ডিজিস। বিত্তের সঙ্গেও এর সম্পর্ক নেই। বিত্তহীন থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের আর্থিক পটভূমি এ জন্য দায়ী নয়। ঢাকা শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের প্রধান, শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ নায়লা জামান খান জানিয়েছেন অন্যরকম তথ্যÑ মেয়েদের চেয়ে ছেলে শিশুরা এতে তিন-চারগুণ বেশি আক্রান্ত। শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে। ছেলেদের ডায়াগনোসিস তাড়াতাড়ি হয় এবং এতে তাদের সোশ্যালাইজেশনও ভাল হয়। মেয়েরা যখন আসে সমস্যা তখন অনেক গভীর। বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুর হার বাড়ছে নাকি মানুষ সচেতন হচ্ছে? তিনি সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিলেন। আগে অটিজমকে সব ধরনের প্রতিবন্ধিত্বের সঙ্গে এক করে দেখা হতো, এখন আলাদা করে চিহ্নিত হচ্ছে। এর ম্যানেজমেন্টও আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রযুক্তির প্রসার শিক্ষা ও সচেতনতা কুসংস্কারের জাল একটু একটু করে ছিঁড়ছে। অন্ধকারে ভূতের ভয়। ভূত তো থাকে আসলে মানুষের মনে। অশিক্ষা আর কুসংস্কারের অন্ধকারে তার বাস। শিক্ষার আলো জ্বললে ভূত উড়ে যায় দূরে। বিজ্ঞানের আলোয় তখন পরিষ্কার দেখা যায়, ভূত নয়, যৌক্তিক এক কার্যকারণের সূত্রায়ন রয়েছে সবকিছুতে। অটিজমের সূত্রবদ্ধ জ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় আমাদের দেশে খুব বেশি হলে তিন সাড়ে তিন দশকের অথবা তার চেয়েও কম সময়ের। এর আগে তার পরিচিতি ছিল ‘ভূতে ধরা’ বা ‘জিনের আছর’ নামে। বিজ্ঞানের আলো পৌঁছানোর পর এ সম্পর্কে জানা গেল অনেক কিছু। অটিজম শিশুদের বিকাশজনিত একটি স্থায়ুবিক সমস্যা, যা অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার নামে সামগ্রিক বিকাশজনিত সমস্যার বিশেষ ধরন। অটিজম বিষয়ে আমাদের দেশে তেমন পরিপূর্ণ পরিসংখ্যান নেই। তবে ২০০৯ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঢাকা বিভাগের ১৫টি জেলায় পাঁচ থেকে ৬ বছরের শিশুদের ওপর জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা যায়, প্রতি হাজারে আটজন শিশুর অটিজম সমস্যা রয়েছে, যা উন্নত বিশ্বের প্রায় কাছাকাছি। বিকাশজনিত অন্যান্য সমস্যা থেকে অটিজম সম্পূর্ণ আলাদা ও বিশেষ ধরনের। জন্মের পর অন্যান্য শিশুর বেড়ে ওঠার সঙ্গে অটিস্টিক শিশুর বেড়ে ওঠার কিছু সুনির্দিষ্ট পার্থক্য থাকে। স্বাভাবিক শিশু সাধারণত ছ’মাসে হাসতে শেখে। ন’মাসে ডাকলে সাড়া দেয়। শব্দের উৎসের দিকে তাকায়। এক বছরে দা-দা-বা-বা ইত্যাদি শব্দ করে কথা বলতে শেখার পূর্বাভাস দেয়। অটিস্টিক শিশুরা এর প্রায় কোনটাই নির্ধারিত সময়ে করতে পারে না। এরা একা থাকতে পছন্দ করে। সরাসরি চোখের দিকে তাকায় না। কাছে ডাকলে বিরক্ত হয়। অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলতে চায় না। একই ধরনের আচরণ, একই বিষয়ের প্রতি আগ্রহ, একই খেলনা দিয়ে খেলতে চায়। এ ধরনের উপসর্গ সাধারণত তিন বছরের আগে দেখা দেয়। পরিপূর্ণ লক্ষণ প্রকাশ পেতে তিন বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় লেগে যায়। অটিজমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, সামাজিক ভাব বিনিময়ে দক্ষতার অভাব। এরা বোঝে কিন্তু বোঝাতে পারে না। কোন এক বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা থাকে কারও কারও। অটিজম নিয়ন্ত্রণের উপায় বা প্রতিষেধক নেই। এ বিষয়ে পরিবারের আগাম করারও কিছু নেই। তবে চিহ্নিত হওয়ার পর অটিস্টিক শিশুর ম্যানেজমেন্টে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সে কথাই বলেলন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মোহাম্মদ জহীর উদ্দীন- সঠিক পারিবারিক পরিবেশ পেলে অটিজমের ডিসএ্যাবল ইমপ্যাক্ট কমে। শিশুর সোশ্যালাইজেশন ভাল হয়। অর্থাৎ অটিজমের প্রতিবন্ধকতাগুলো সহনীয় পর্যায়ে থেকে শিশু সমাজে চলার উপযোগী হয়ে বেড়ে উঠতে পারে। তবে এ জন্য পারিবারিক সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মাল্টি ম্যানেজমেন্ট। স্পেশাল এডুকেশন বা বিশেষ শিক্ষার শিক্ষকের ভূমিকা এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এদের জন্য স্পেশাল স্কুল থাকলে সবচেয়ে ভাল হয়। সাধারণ স্কুল হলে আলাদা কেয়ার লাগবে। বিশেষ করে হাইপার এ্যাকটিভ শিশুদের জন্য সার্বক্ষণিক মানসিক চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানী দরকার। ভাষা দক্ষতা বাড়াতে স্পিচ এ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি এবং পূর্ণ বয়সে পৌঁছলে যাতে তার বেঁচে থাকা সুন্দর হয় সে জন্য প্রয়োজন অকুপেশনাল থেরাপি। এসবের সমন্বিত প্রয়োগ অটিজমের ভয়াবহতা কমিয়ে শিশুকে স্বাভাবিক জীবনের কাছাকাছি পৌঁছাতে সাহায্য করে। অনেক ভালভাবে জীবন কাটাতে পারে তারা। যত আগে চিকিৎসা শুরু করা যায় শিশুর জন্য ততই ভাল। এ জন্য জন্মের পর থেকে শিশুর বিকাশ ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যত দেরিতে ডায়াগনোসিস হবে এর ভয়াবহতার সম্ভাবনা তত বাড়বে। তিনি জানালেন কোন কোন শিশু পাঁচ-সাত বছরে পৌঁছলে প্রাকৃতিকভাবেই অটিজম কাটিয়ে ওঠে এবং মজার ব্যাপার হলো, আমরা যারা নিজেদের সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ বলে জানি তারাও হয়ত অনেকে শৈশবে অটিজমে আক্রান্ত ছিলাম এবং প্রাকৃতিকভাবে তা কাটিয়ে উঠেছি। সরকার প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুর সেবায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পাইলট প্রকল্প চালু করেছে, যা এখন আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব জেলায় তা ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বিভিন্ন সময় অটিজমবিষয়ক আন্তর্জানিত সম্মেলন হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অটিজম সেন্টার ও অটিজম সচেতনতাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘অটিজম স্পিকস’-এর উদ্যোগে দু’হাজার এগারোয় এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে অটিজম সচেতনতা বাড়াতে এবং সার্ক দেশগুলোর মধ্যে এ সংক্রান্ত আন্তঃসম্পর্ক বাড়াতে ‘ঢাকা ঘোষণা’ নামে কিছু নীতিমালা নেয়া হয়েছিল। সেগুলো হচ্ছে- এক. অটিজম ও ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডারে আক্রান্তদের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে সমন্বিত উদ্যোগ দ্রুততর করার উদ্দেশ্য সামনে রেখে এ ঘোষণা দেয়া হয়। দুই. ডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার শিশুদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার লক্ষ্য অর্জনে যেসব বিষয় রয়েছে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমর্থন দিতে হবে। বিষয়গুলো হচ্ছে- ক. ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার শিশুদের অধিকারের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও এসব শিশুর জন্য ব্যক্তি ও সামাজিক দায়িত্ববোধের বিষয়টি আমলে আনা, খ. এ ধরনের শিশু ও তার পরিবারের প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবার মান ও সক্ষমতা বাড়ানো, গ. শিশুদের চিকিৎসাসেবার বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত পেশাজীবীদের সক্ষমতা বাড়ানো। এর মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে বিশেষায়িত সেবা পর্যায় অন্তর্ভুক্ত, ঘ. স্বাস্থ্যসেবার জনবল ও আর্থিক সম্পদ বাড়ানো এবং ধীরে ধীরে অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন, ঙ. পরিবার, বাড়ি ও স্কুলের সান্নিধ্য পেতে এবং পারিবারিক জীবন শিক্ষা অর্থাৎ সমাজে স্বাভাবিক অংশগ্রহণে সহায়তা করা, চ. সেবার মান নিশ্চিত করতে কার্যক্ষমতা বাড়ানো, ছ. সামাজিক অন্তর্ভুক্তির পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়ক জাতীয় আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন, জ. সেবা দেয়ার জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং বাস্তবায়নের জন্য দলীয় কর্মকৌশল তৈরি, ঝ. তথ্য আদান-প্রদান এবং সঠিক প্রয়োগ উন্নয়নের অগ্রগতি তুলে ধরার জন্য ধারাবাহিক আঞ্চলিক সম্মেলনের আয়োজন করা। তিন. স্থানীয় পরিস্থিতি এবং বিশেষত্ব অনুযায়ী সেবার কর্মপদ্ধতি নেয়ার বিষয়ে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশের অগ্রাধিকার এবং সহায়তার স্বীকৃতি দেয়া। চার. ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার এবং অটিজমের প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা জোরদারে সরকার বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শিক্ষা ও সমাজবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে আহ্বান ও প্রস্তুত করা। পাঁচ. শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার পরিপ্রেক্ষিতে ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার ছাড়াও অটিস্টিক শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সদস্য দেশগুলোর কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ও কারিগরি সহায়তা দিতে জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আহ্বান জানানো। ছয়. আন্তর্জাতিক, দ্বিপাক্ষিক ও এনজিওগুলোতে যারা ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার ও অটিজমের জন্য কাজ করছেন তাদের বিশেষ ক্ষমতা অনুযায়ী এ ঘোষণাকে সমর্থন করার জন্য আহ্বান জানানো। সাত. ডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার ও অটিজমে আক্রান্তদের অপরিমেয় প্রয়োজন মেটাতে এবং যতœ ও সেবার মান উন্নয়নে আর্থিক ও কারিগরি কর্মসূচীর পরিকল্পনার জন্য দাতা সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে আবেদন করা হয়। এর অনেকগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। অভিভাবকদের সচেতনতা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, থেরাপিস্ট এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এ উদ্যোগ দেশে অটিজম ম্যানেজমেন্টের দক্ষতা নিঃসন্দেহে আরও বাড়বে।
×