ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাস্টিন গোমেজ

আস্থার আশ্রয়ে

প্রকাশিত: ১২:০৮, ২৪ অক্টোবর ২০১৯

আস্থার আশ্রয়ে

বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের চেয়ে মূল্যবান সম্পদ পৃথিবীতে আর কিছু নেই। সন্তানের কল্যাণের জন্য নিজের জীবন তুচ্ছজ্ঞান করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না তারা। নিজের জীবন ক্ষয় করে বা জীবন দিয়ে সন্তানের সুরক্ষা দেয়ার অসংখ্য নজির পৃথিবীজুড়েই রয়েছে। সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের এই টান চিরন্তন। এই কিছু দিন আগেও দেখেছি, নৌকাডুবিতে মা নিজে ডুবে তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য মাথার ওপর ধরে রেখেছেন। সন্তানের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার পরও অস্বীকার করার উপায় নেই, নগর জীবনে অনেক পিতা-মাতা কর্মজীবী হওয়ায়, সন্তানের প্রতি সঠিক নজর দিতে পারেন না। এমন অনেক বাবা-মা রয়েছেন, যারা সন্তানকে ডে কেয়ার সেন্টারে রেখে লালন-পালন করেন। এভাবেই সন্তান বাবা-মায়ের সান্নিধ্যবিহীনভাবে বেড়ে উঠছে। আর যার ফলে সন্তনেরা পাচ্ছে না বাবা মায়ের নৈতিক গঠন। এখনও দেখা যায় যে, বাবা মায়ের সান্নিধ্য পেলেও সে সান্নিধ্যে থাকে অবহেলা, অযতœ কিংবা সন্তান লালন-পালনে অনীহা। অথচ সন্তানের সুষম শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সান্নিধ্যের বিকল্প নেই। আর এর প্রধান কারণ হলো, আধুনিক যুগে মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন। মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে মানুষের চাহিদার গতি বৃদ্ধি। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য অর্থের পেছনে ছোটাছুটি করা ইত্যাদি। ইউনিসেফের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বিশ্বের ২ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ছয়জনকে নিয়মিতভাবে শারীরিক শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। শারীরিক শাস্তি বলতে ইউনিসেফ বুঝিয়েছে এমন শাস্তি যেটা দিলে শিশু শরীরে ব্যথা কিংবা অস্বস্তি অনুভব করে। এমন শাস্তির মধ্যে রয়েছে শিশুর হাত, পা, মুখ, মাথা, কান কিংবা নিতম্ব ধরে ঝাঁকানো বা মার দেয়া। লক্ষণীয় হল দেশের অর্ধেকেরও বেশি নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্তার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোন মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে। অনেকটা পশ্চিমা সংস্কৃতির মতো ‘হিজ হিজ হুজ হুজ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারও সন্তানের অস্বাভাবিক আচরণ চোখে পড়লেও ডাক দেয়ার তাগিদ অনুভব করেন না। সামাজিক এই রীতিনীতি চর্চার অভাবে শিশু-কিশোররা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। সমাজের এই নেতিবাচক পরিবর্তন যেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে, তেমনি সন্তানদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার মূল দায়িত্ব পালনকারী পরিবারের অভিভাবকদের উদাসীনতাও লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সন্তানের প্রতি যথাযথ খেয়াল না রাখার প্রবণতার কারণে তারা নিঃসঙ্গ, হতাশ ও উগ্রতার কবলে পড়ছে। ফলে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা তাদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, যেসব অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে সেগুলোকে বিচ্ছিন্ন বা ব্যতিক্রমী ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। এসব ঘটনা ভেতরে ভেতরে পরিবার ও সমাজের চরম নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়েরই আলামত। ভুলে গেলে চলবে না যে, ফলের স্বাদ বা পরিচয় বোঝা যায় বৃক্ষের ধরন থেকে। বৃক্ষ ভাল হলে ফলও ভাল হয়। পিতা-মাতা যদি সন্তানকে যথাযথভাবে পরিচর্যা করেন, তবে সন্তানের বিপথে যাওয়ার আশঙ্কা খুব কমই থাকে। অর্থাৎ সন্তানকে মানুষ হওয়ার সঠিক পথে চলার মূল দায়িত্ব পালন করতে হয় পিতা-মাতাকে। তারপর সমাজের অন্যান্য রীতিনীতি ও মূল্যবোধের বিষয়গুলো এ পথে চলার সহায়ক হিসেবে কাজ করে। সন্তানদের যতœ প্রয়োজন। তাদের আদর করে বন্ধুর মতো কাছে বসে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো তুলে ধরতে হবে। ছেলেমেয়ের আচরণে পজিটিভ বিষয়গুলো ফুটে উঠতে সবার আগে দরকার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভাল সম্পর্ক তৈরি করা। প্রত্যেকেরই অধিকার আছে নিজের মতো করে বাঁচার। তবে সেই তালটা ধরিয়ে দেয়ার গুরুদায়িত্ব অবিশ্যই অভিভাবককেই নিতে হবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে না পারলেই যে জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে না, এমন সহজ সত্যগুলো মেনে নিয়ে, খোলা জীবনে চলার শিক্ষাই সবার দরকার। শত কষ্ট হলেও নম্রতা, আস্থার আশ্রয়টুকুকে রক্ষা করতে হবে। তাহলেই বিপথগামিতার হাত থেকে রক্ষা পাবে সন্তান। তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা থেকে
×