হাসিব রহমান, বোরহানউদ্দিন থেকে ॥ লক্ষ্মীরানী দে। পঞ্চান্ন উর্ধ এক নারী। আগুনে পোড়া বিধ্বস্ত ঘরের দুয়ারে চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে বসে রয়েছেন। অপরিচিত মানুষ দেখামাত্রই তার আতঙ্ক যেন আরও বেড়ে গেল। বুধবার দুপুরে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার রবীন্দ্র পল্লীর ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল বাড়িতে গিয়ে এই দৃশ্য চোখে পড়ে। গত রবিবার বেলা ১১টার দিকে বাড়িঘরে নারী-পুরুষরা কোন কিছু বোঝার আগেই শুরু হয় তা-ব। লক্ষ্মীরানী জানান, তার এক ছেলে এক মেয়ে ও স্বামী ঘটনার সময় বাড়িতে ছিল না। হঠাৎ একদল যুবক লাঠিসোটা নিয়ে চড়াও হয়। ভয়ে ওই নারী ঘরে তালা মেরে পাশের পাকা বিল্ডিংয়ের গিয়ে আশ্রয় নেন। জানালা দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। তার চোখের সামনেই সাজানো সংসার কিভাবে তছনছ করা হয়। আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। ঘরে মালামাল ভাংচুরসহ লুটপাট করা হয়। কিন্তু তার চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটলেও তার কিছুই করার ছিল না। এভাবেই বর্ণনা দিতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন ওই নারী। তিনি আরও বলেন, প্রথমে রবীন্দ্র পল্লী ভাওয়াল বাড়ি মন্দির ভাংচুর করা হয়। এর পর ওই ভাওয়াল বাড়ির নয়টি বাড়ি ঘরে চলে ভাংচুর লুটপাট।
শুক্রবার বিকেলে বিপ্লব চন্দ্র শুভর নিজের নাম ও ছবি সংবলিত ফেসবুক আইডি ইরঢ়ষড়ন ঈযধহফৎধ ঝযাঁড় থেকে আল্লাহ তায়ালা ও নবী করিম (সঃ) কে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মেসেজ তার কয়েকজন বন্ধুর কাছে যায়। এ ঘটনায় ওই যুবক বোরহানউদ্দিন থানায় একটি জিডি করে। একই সঙ্গে ওই মেসেজ ফেসবুকে ভাইরাল হলে বোরহানউদিনে শুরু হয় বিক্ষোভ। এর পর গত রবিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তৌহিদী জনতার ব্যানারে বোরহানউদ্দিনের ঈদগাহ মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশের শেষ পর্যায়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে শুরু হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ ও মুসল্লিদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং পুলিশের ওপর হামলা হয়। এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ৪ জন প্রাণ হারায়। কিন্তু এ সংঘর্ষের সময় একটি গ্রুপ বোরহানউদ্দিনের ভাওয়াল বাড়িতে হামলা চালায়।
সরজমিনে ভাওয়াল বাড়িতে গেলেও প্রথমে ঢুকতেই চোখে পড়ে মন্দিরের ভেতরে ভাংচুর করা মালামাল আর প্রতিমা। ওই মন্দিরের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক সত্য প্রসাদ দাসের ঘরে যেতেই দেখা যায়, ভাংচুর করা আসবাবপত্রগুলো এখনও পড়ে রয়েছে। শিক্ষকের স্ত্রী অঞ্জু রানী দাস জানান, তিনি তার নাতিদের খাওয়াচ্ছিলেন। বাইরে আওয়াজ হলেও দরজা ছিল বন্ধ। হঠাৎ করে ৪ যুবক দুটি জানালা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে আসবাবপত্র ভাংচুর করে সব তছনছ করতে থাকে। বাধা দিতেই তাদের হাতে থাকা একটি চ্যালা কাঠ দিয়ে তাকে মারতে থাকে। এ সময় তার স্বামী আসলে তাকেও মারধর করা হয়। ঘরের টাকা পয়সা স্বর্ণ অলঙ্কার লুট করে নেয়। কিন্তু তাদের চিনতে পারেনি। তাদের পরনে ছিল জিন্সপ্যান্ট ও পাঞ্জাবি। সুবল দাসের পাশের ঘরে তার কন্যা মঞ্জরী দাস জানান, তারা গেটে তালা লাগিয়ে ভেতরে অবস্থান করছিল তারপরও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ঘরের জানালা ভাংচুর করা হয়। তিনি জানান, ’৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ তারা দেখেনি। কিন্তু তাদের মায়ের কাছে শুনে ছিলেন যুদ্ধকালীন সেই ভীতিকর সেই সময়ের কথা। এ ঘটনার সময় আমাদের মনে হয়ে ছিল ঠিক ’৭১ সালের মতোই আমাদের পরিস্থিতি হয়েছিল। কলেজ ছাত্রী প্রমীদাস জানান, আমাদের তো কোন দোষ ছিল না। তারপরও অকথ্য ভাষায় আমাদের গালিগালাজ করেছে। যার জন্য রাতে আমারা ঘুমাতে পারি না। সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার কাজল চন্দ্র দে ঘরের সামনে গেলে দেখা যায়, পাশের ঘরের রাজিব রতনের মোটরসাইকেল পোড়া অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তারা ঘরেরও একই অবস্থা। মিনাক্ষী রানী জানান, তিনি বিআরডিপিতে চাকরি করেন। তিনি অফিসে যাওয়ার জন্য বাড়ির দরজার মন্দিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন রাস্তা দিয়ে মিছিল যাচ্ছিল। মাইকে বলা হচ্ছে, যেখান থেকে আসছেন চলে যান। এ সময় হঠাৎ করে একদল লোক মন্দিরে প্রবেশ করে। তিনি ভয়ে ঘরে চলে এসে দরজা আটকে দেন। কিন্তু তাদের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে ঘরের মালামাল ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, স্বাধীনতার সময় দেশে হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে যুদ্ধ করেছিলাম। এখন তারা বলে এটা আমাদের দেশ না। কিন্তু কেন আমরা তো আমাদের বাপের সম্পত্তিতে থাকি। কিছু হলেই আমাদের ওপর হামলা চালায়। কিন্তু কি অপরাধ ছিল আমাদের। ধ্বংসযজ্ঞ ওই ভাওয়াল বাড়ি পরিদর্শন করে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্যপরিষদের ভোলা জেলা আহ্বায়ক অবিনাশ নন্দি বলেন, অভিযুক্ত বিপ্লব যদি দোষী হয় তার বিচার আমরাও চাই। কিন্তু প্রমাণের আগে কেন এই বর্বর হামলা চালানো হলো। যে কুচক্রী মহল ভোলার এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্ট করার পেছনে জড়িত তাদের অতি দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবি জানান তিনি।
এদিকে সংখ্যালঘু পরিবারে ও মন্দিরে হামলার ঘটনা পরও শুধু ওই ভাওয়াল বাড়িই নয় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে বোরহানউদ্দিন উপজেলা সংখ্যালঘু পরিবারগুলো। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত হামলাকারীদের এখনও আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি। ঘটনার ২ দিন পর মঙ্গলবার রাতে বোরহানউদ্দিন থানায় ৪/৫ শত অজ্ঞাত লোককে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয় বলে জানান, বোরহানউদ্দিন থানার ওসি এনামুল হক। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করতে পারেনি। এছাড়া বোরহানউদ্দিনের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের ৩ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তাদের বুধবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা দিতে না পেরে আরও ২ দিন সময় বৃদ্ধির জন্য আবেদন করেছেন বলে জানান তদন্ত কমিটির প্রধান ভোলা জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মাহামুদুর রহমান। অন্যদিকে ভোলা ও বোরহানউদ্দিনে বুধবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য জোটের সাংবাদিক সম্মেলন করে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা থাকলেও তা হয়নি। তবে তাদের বৃহস্পতিবারের মানববন্ধন কর্মসূচী স্থগিত করা হয়েছে বলে ঐক্যপরিষদের যুগ্ম-সচিব মাওলানা মিজানুর রহমান। তবে ৬ দফা দাবিতে ৭২ ঘণ্টার আলিটমেটাম এখনও রয়েছে। এছাড়া বিএনপির প্রতিবাদ কর্মসূচী থাকলেও তা হয়নি। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত র্যাব বিজিবি পুলিশ সতর্ক অবস্থায় ছিল।
বিপ্লবের ভগ্নিপতিসহ দুজনের খোঁজ মিলেছে ॥ ফেসবুকে বিতর্কিত মেসেজ দেয়া আলোচিত যুবক বিপ্লব চন্দ্র শুভর ভগ্নিপতি বিধান মজুমদার (৩১) ও তার চাচাত ভাই সাগরকে (১৯) অবশেষে পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার রাত একটার দিকে ভোলার র্যাব ক্যাম্প থেকে পরিবারের লোকজন তাদের ফেরত নিয়ে যান। বিধান মজুমদারের পিতা বিনয় ভূষণ এবং ভোলা র্যাব ক্যাম্পের কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সোমবার সন্ধ্যায় চরফ্যাশনের রোদ্রেরহাট বাজার থেকে ডিবি ও র্যাব পরিচয়ে ওই দুজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
বিধানের বাবা বিনয় ভূষণ মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে মোবাইল ফোনে বিধান জানান, তাকে র্যাব অফিস থেকে যেন নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তিনি রাত একটার দিকে ইউপি সদস্য আশরাফুল টুলু ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে ভোলা মোল্লাপট্টি এলাকার র্যাব ক্যাম্পে যান। তারপর কাগজে অভিভাবকদের স্বাক্ষর রেখে বিধান মজুমদার (৩১) ও তার চাচাত ভাই সাগরকে ছেড়ে দেন। এ বিষয়ে ভোলা র্যাব ক্যাম্পে যোগাযোগ করা হলে এক কর্মকর্তা জানান, তারা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের এনেছিলেন। তারপর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
এদিকে নিখোঁজ হওয়ার একদিন পর উদ্ধার বিধান মজুমদার জানান, তাকে চোখ বেঁধে র্যাব অফিসে নেয়া হয়। তাকে তার শ্যালক বিপ্লব চন্দ্র শুভর ফেসবুক মেসেঞ্জার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আইডি সংক্রান্ত বিষয়ে নানা প্রশ্ন করেন।
উল্লেখ্য, সোমবার সন্ধ্যার পর বিধানের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মা জুয়েলার্স থেকে তাকে এবং তার চাচাত ভাই সাগরকে (১৯) সাদা পোশাকের ৭/৮ জন লোক ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে কালো একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে আর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে চরফ্যাশনের দুলারহাট থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়।