ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কারাবন্দী জিকে শামীমের প্রতিষ্ঠানের হাতছাড়া হচ্ছে অনেক প্রকল্পের কাজ

থামবে না উন্নয়ন ॥ প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশ

প্রকাশিত: ১১:০৪, ২৩ অক্টোবর ২০১৯

থামবে না উন্নয়ন ॥ প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশ

ওয়াজেদ হীরা ॥ অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে সরকার প্রধান। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে অংশীদার হিসেবে অন্যায়কারী কেউ থাকলেও ছাড় নেই। তারই অংশ হিসেবে মাদক ও অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা ঠিকাদার জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা সরকারের একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তবে প্রকল্পের কাজ যাতে থেমে না থাকে সেজন্য এর বিকল্প হিসেবে আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দ্রুত এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সংশ্লিষ্টরাও মনে করছেন প্রকল্প এগিয়ে নিতে এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নতুনভাবে দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। গণপূর্ত অধিদফতরের ৫৩ প্রকল্পের নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছে জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিকেবি এ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। এসব প্রকল্পের চুক্তিমূল্য সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার উপরে। জি কে শামীম গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে এসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। আর আলোচনায় আসে কি হবে প্রকল্পের ভবিষ্যত। এরই প্রেক্ষিতে আইন অনুসরণ করে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প সংশোধন নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশ দেন বলে জানা গেছে। একনেক সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, প্রকল্পের কাজ যেন থেমে না থাকে প্রধানমন্ত্রী সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। অন্যায়কারী হলে কারোরই ছাড় নেই। এ রকম বেশি প্রকল্প যাদের কাছে আছে বা করতে পারছে না সে বিষয়েই মূলত নির্দেশনা। বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন ‘আমি চেয়ারে থাকলে কাউকে চিনি না।’ বিশিষ্টজনরা মনে করছেন দুর্নীতিগ্রস্ত ও অন্যায়কারীদের জন্য সরকারের এটি কড়া বার্তা। ফলে অন্যান্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজে দুর্নীতি করবে না। আবার কেউ দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেলে কাজও থেমে থাকবে না। এ বিষয়ে গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ হলো আমাদের প্রকল্পের কাজ যেন থেমে না থাকে। তারা (শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান) যদি কাজ না করে আমরা তো আর তাদের জন্য বসে অপেক্ষা করব না। নিয়ম মেনে তাদের নোটিস দেব, চুক্তি বাতিল করব। তখন বিধি মোতাবেক হিসাব করে দেখব এখন পর্যন্ত তারা কতটুকু কাজ করেছে। যেটুকু করেছে তারপ্রাপ্য তারা পাবে, বাকিটুকুর জন্য যা করণীয় টেন্ডার বা আনুষঙ্গিক কাজ তা করা হবে। এদিকে পরিকল্পনা সচিব নুরুল আমিন জনকণ্ঠকে বলেন, আইনী প্রক্রিয়ায় যেভাবে প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায় প্রধানমন্ত্রী সেটি বলেছেন। প্রকল্প এখন যারা বাস্তবায়ন করছে তারা যদি না করে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেয় সেক্ষেত্রে কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে আর কতটুকু হবে এসবই নির্ধারণ করবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য শামীমা নার্গীস জনকণ্ঠকে বলেন, আসলে এই আলোচনাটা আসে একটি প্রকল্পের একাধিকবার সংশোধনীর ক্ষেত্রে। এখানে কারও নাম উল্লেখ করে কথা হয়নি। তবে প্রকল্প এগিয়ে নিতে চাইলে কাউকে তো কাজ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীও চান প্রকল্প এগিয়ে যাক। কাজ যেন থেমে না থাকে। এক্ষেত্রে যা করণীয় সে ব্যবস্থা নেবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এছাড়াও এ বিষয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব প্রকল্প এগিয়ে নিতে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের পক্ষে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান এর আগে জানিয়েছেন, নতুনভাবে এ কাজের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেখানে যারা কাজ পাবেন তারা যেন সততার সঙ্গে কাজ পান সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। তারা সঠিকভাবে কাজ করতে পারেন সে দক্ষতাও নিরূপণ করতে হবে। গণপূর্ত অধিদফতরের যে ৫৩টি প্রকল্পের নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছে এর মধ্যে শামীমের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এককভাবে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ করছে। বাকি ৪০টি প্রকল্পের কাজ যৌথভাবে চলছে বলে জানিয়েছে গণপূর্ত অধিদফতর। এসব প্রকল্পের ২৪টির অনুমোদন দিয়েছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। আটটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন গণপূর্ত অধিদফতর প্রধান প্রকৌশলী। এছাড়া অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তিনটি, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন। বাকি ১৭টি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। সব মিলিয়ে জিকেবির এককভাবে করা প্রকল্পগুলোর গড় ভৌত অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ। বিপরীতে যৌথভাবে করা প্রকল্পগুলোর ভৌত অগ্রগতি ৪২ শতাংশ। এককভাবে জিকেবির হাতে থাকা ১৩টি প্রকল্পের কোনটিই পুরোপুরি শেষ হয়নি। কোন প্রকল্পের কাজ হয়েছে ৯৯ শতাংশ। আবার কোন প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি শূন্য শতাংশ। ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা নির্মাণকাজের ভৌত অগ্রগতি ৯০ শতাংশ, আর্থিক অগ্রগতি ৮৮ শতাংশ। রাজধানীর বেইলি রোডে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পের চারটি অংশের গড় ভৌত অগ্রগতি ৭১ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৫১ দশমিক ১৭ শতাংশ। ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় নির্মাণকাজের ভৌত ৯৫ শতাংশ, আর্থিক ৯২ শতাংশ। গাজীপুরে পাঁচটি র‌্যাব কমপ্লেক্স এবং একটি র‌্যাব ট্রেনিং স্কুল নির্মাণ প্রকল্পের ভৌত ৯৯ শতাংশ, আর্থিক ৯৪ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। সচিবালয়ের নির্মাণাধীন নতুন ২০ তলা ভবনের ষষ্ঠ তলা থেকে ২০তলা পর্যন্ত পূর্ত এবং অভ্যন্তরীণ স্যানিটারি ও বৈদ্যুতিক কাজের ভৌত ৮০ শতাংশ এবং ৫২ শতাংশ আর্থিক আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে। আগারগাঁওয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, নিটোরের এলইডি বাতি স্থাপন ও বৈদ্যুতিক কাজের ১০০ শতাংশ ভৌত এবং ৯৯ শতাংশ আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সম্প্রসারণ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৩২ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৩১ শতাংশ। আজিমপুরে সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্য শতাংশ। সচিবালয়ে নতুন ২০তলা ভবনের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৩ শতাংশ, আর্থিক অগ্রগতি শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ। মহাখালীতে জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আধুনিকায়ন প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৯৮ শতাংশ, আর্থিক ৬৭ শতাংশ। এছাড়া যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে এমন প্রকল্পগুলোর মধ্যে শুধু উত্তরা নি¤œ ও নি¤œবিত্ত মানুষের জন্য এ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ১০০ শতাংশ ভৌত অগ্রগতি হয়েছে। একটি প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্য শতাংশ। ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম নিজের পরিচয় দিতেন ‘নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও গের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক’ হিসেবে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যেই গত ২০ সেপ্টেম্বর শামীমের কার্যালয়ে অভিযান চালায় র‌্যাব। নিকেতনের ৫ নম্বর সড়কের ১৪৪ নম্বর হোল্ডিংয়ে পাঁচ তলা ওই ভবনে অভিযান শেষে নগদ প্রায় দুই কোটি টাকা, পৌনে দুই শ’ কোটি টাকার এফডিআর, আগ্নেয়াস্ত্র ও মদ পাওয়ার কথা জানানো হয়। শামীম ও তার সাত দেহরক্ষীর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় তিনটি মামলা। পরে জি কে শামীম ও তার পরিবারের লোকজনের সবারই ব্যাংক লেনদেন স্থগিত করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
×