ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্প-জনসনের হঠকারিতা এবং বিশ্বধনতন্ত্রের ভবিষ্যত

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ২৩ অক্টোবর ২০১৯

ট্রাম্প-জনসনের হঠকারিতা এবং বিশ্বধনতন্ত্রের ভবিষ্যত

ব্রেক্সিট নিয়ে বিব্রত ব্রিটেন। ট্রাম্পকে নিয়ে আমেরিকা বিব্রত। বার্সিলোনায় গণবিক্ষোভের আগুন জ্বলছে। ভারতে হিন্দুত্ববাদ গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাশ্মীর নিয়ে মোদি আগুনে হাত দিয়েছেন। ক্যাপিটালিজমে নবদীক্ষিত নয়াচীনও শান্তিতে নেই। হংকংয়ে ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে ভোলার বোরহানউদ্দিনে সহিংস মৌলবাদ আবার মাথা চাড়া দিতে চেয়েছে। বুয়েটের ছাত্র হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াত আবার দেশের রাজনীতিতে ঘোট পাকানোর চেষ্টা করছে। এক কথায় সারাবিশ্বে আজ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কথাতো আগেই লিখেছি। আজ সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতাও কম নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের সঙ্গে যে ট্রেড ওয়ার শুরু করেছেন তার প্রতিক্রিয়া সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তেলের দাম বাড়ছে। একই সঙ্গে সামজিক অস্থিরতা বেড়েছে। ব্রিটেনে টিনএজারদের মধ্যে নাইফ ক্রাইম মহামারীর মতো দেখা দিয়েছে। রোজই লন্ডন শহরে ছুরিকাঘাতে রাস্তাঘাটে, বাসে, টিউবে মানুষ মরছে। পুলিশ তা দমন করতে পারছে না। একটি ফরাসী দৈনিক লিখেছেÑ বিশ্বব্যাপী এই অস্থিরতা মোকাবেলা করার মতো বড় মাপের নেতা আজ দুনিয়ার কোথাও নেই। না ধনতান্ত্রিক দুনিয়া, না সমাজতান্ত্রিক দুনিয়াÑএই বড় মাপের নেতা জন্ম দিতে পারছে। উনিশ ও বিশ শতকে ধনতান্ত্রিক বিশ্ব লয়েড জর্জ, চার্চিল, রুজভেল্ট, গান্ধী, নেহেরু, চিয়াং কাইশেকের মতো বিশ্ব নেতাদের জন্ম দিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বও জন্ম দিয়েছে লেনিন, স্ট্যালিন, মাও জেতুং, টিটোর মতো নেতাদের। আজ ওই মাপের নেতা কোথায়? পত্রিকাটির মন্তব্য শুনে মনে হয় এটা বোধ হয় বিশ্ববিধাতার অভিশাপ যে, আজ ধনতন্ত্র যখন তার সাফল্যের চূড়ায় এবং আগের সমাজতান্ত্রিক সুপার পাওয়ার আর নেই, তখন আমেরিকার মতো একক সুপার পাওয়ারের নেতৃত্বে বসেছেন এক অর্ধ উন্মাদরূপে আখ্যাত ডোনাল্ড ট্রাম্প। অভিশংসনের তলোয়ার মাথার ওপর ঝুলন্ত রেখে তিনি ডনকুইকজোটের মতো ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। ব্রিটেনে এই প্রথম বরিস জনসনের মতো এক অস্থিরমতির লোক অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বে আঘাত করার চেষ্টা করেছেন। চেহারা ও চরিত্রেও তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো। তার মাথাতেও অভিশংসনের তলোয়ার ঝুলছে। ব্রিটিশ রাজনৈতিক মহলের অনেকের ধারণা, জনসনকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে ট্রাম্প তার প্রভাব প্রয়োগ করেছেন। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, তিনি বরিস জনসনকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে চান। কোন কোন ইতিহাসবিদ বলেন, ভাগ্যের পরিহাস হচ্ছে, দুই শ’ বছর আগে আমেরিকা ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। দুই শ’ বছর পর ব্রিটেন এখন আমেরিকার অঙ্গরাজ্যে পরিণত হতে চলেছে। ট্রাম্প লন্ডনের মেয়র সাদিককে অশোভন ভাষায় সমালোচনা করেছেন। লন্ডনে এসে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে’র সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করেননি। রানীর প্রতিও যথাযথ সম্মান দেখাননি। লন্ডন সফরে তার ভাবখানা ছিল তিনি উপনিবেশ সফরে এসেছেন। বরিস জনসন অনেকটা ট্রাম্পের চরিত্রের লোক। ট্রাম্পকে অনুকরণ করে দেশ চালাতে চান। পার্লামেন্টকে তিনি সম্মান দেখাতে চান না। ট্রাম্পের মতোই অতি জাতীয়তাবাদী স্লোগান তুলে কট্টর রক্ষণশীলদের সমর্থনে তিনি ক্ষমতায় থাকতে চান। জনসনের নীতি অনুযায়ী ব্রিটেন চালিত হলে, ইউরোপের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য হ্রাস পেলে, ব্রিটেনকে আমেরিকার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হতে হবে। ট্রাম্পও তাই চান। বলছিলাম, বিশ্বের অস্থির পরিস্থিতি এবং তা সামাল দেয়ার জন্য যোগ্য নেতৃত্বের অভাবের কথা। একটি ব্রিটিশ পত্রিকা মন্তব্য করেছে, ‘গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটেন এখন একজন অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত খামখেয়ালির দ্বারা শাসিত হচ্ছে’। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ব্যক্তি, যাকে লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান’ বলে ‘অসত্য কথনে পটিয়সী, চরিত্রহীন ব্যক্তি’, আজ সুপার পাওয়ারের নেতা। আফগানিস্তানে একবার দস্যু বাচ্চাই-ই-সাঙ্কো সিংহাসন দখল করার পর দেশটির যে অবস্থা হয়েছিল, ট্রাম্প আমেরিকায় হোয়াইট হাউসে বসার পর সারাবিশ্বে আজ সেই অবস্থা দেখা দিতে যাচ্ছে। ধনতান্ত্রিক বিশ্বে যে নেতৃত্বের অভাব, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বেও তাই। ধনতান্ত্রিক বিশ্বে চার্চিল, রুজভেল্টের সমপর্যায়ে স্ট্যালিন, মাও জেতুং, মার্শাল টিটোর মতো নেতারা ছিলেন। আজ সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব শক্তি বিপর্যস্ত, নেতৃত্ব তেমন শক্তিশালী নয়। রাশিয়ার পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট মাথা তুলছেন। বিশ্বে নেতৃত্ব দানের পর্যায়ে তারা এখনও উঠে আসেননি। অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেন, বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক শক্তি শিবিরের পতনের কারণ স্ট্যালিন, মাও জেতুং, মার্শাল টিটোর মতো প্রভাবশালী নেতৃত্বের অভাব। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভ শক্তিশালী বিশ্ব নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আমেরিকা যাকে ভয় করেত, লাল ফৌজের মার্শাল জুকভপন্থী সামরিক অফিসারদের চক্রান্তে তার আকস্মিক পতনের পর ক্ষমতার হাত বদলের দফাওয়ারি পন্থায় পশ্চিমা শক্তি গরবাচভের দুর্বলতা ও সুবিধাবাদিতার সুযোগ নিয়ে তাদের বশংবদ, মদ্যপ ইয়েলত্সীনকে ক্রেমলিনে ক্ষমতায় বসায়। ইয়েলত্সীনের আমলেই পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক শক্তি রাশিয়ায় জাঁকিয়ে বসে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্যদের বিপর্যয় ঘটে। ইয়েলত্্সীনের পর পুতিনের আবির্ভাব রাশিয়াকে আবার শক্তিশালী নেতৃত্ব দিয়েছে। পুতিন এখনও বিশ্ব নেতৃত্বের পর্যায়ে উঠতে পারেননি। পারেননি চীনের বর্তমান নেতাও। কিন্তু শক্তিশালী চীন ও রাশিয়া মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। শক্তিশালী নেতৃত্বের অভাব এবং আফগান যুদ্ধের বিপর্যয়ে যেমন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন ঘটেছে। তেমনিই বর্তমানে ধনতান্ত্রিক বিশ্বে নেতৃত্বের অভাব এবং একইভাবে আফগান ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে মার্কিন সমরশক্তি ক্ষুণœ হওয়া এবং ডলার-জগতের অর্থনীতিতে বিপর্যয় দেখা দেয়ার দরুন ধনতান্ত্রিক বিশ্বে এক ধরনের বড় ধাক্কা আসন্ন বলে অনেক অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন। ত্রিশের মহামন্দার পর বিশ্ব নব্বইয়ের দশকে আরও বড় মহামন্দার (মৎবধঃ পৎরংরং) সম্মুখীন হয়েছিল। তখন ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন সোস্যালিস্ট গর্ডন ব্রাউন। অনেকে বলেন, গর্ডনের সোস্যালিস্ট প্রেসক্রিপশন দ্বারা সেবার ধনতন্ত্র রক্ষা পায়। উদার ও বাজার অর্থনীতির পথ সাময়িকভাবে ত্যাগ করে আমেরিকাও অর্থনীতিতে সরকারী হস্তক্ষেপ ঘটিয়েছিল। ব্রিটেনে ও আমেরিকায় সরকার বড় ব্যাংকগুলোকে বিরাটভাবে অর্থ সাহায্য করে দেউলিয়াত্ব থেকে বাঁচায়। এজন্যেই বলা হয় ধনতন্ত্রের রাক্ষসের প্রাণ আছে। রূপকথার রাক্ষসের এক ফোঁটা রক্ত থেকে যেমন শত রাক্ষস তৈরি হয়, তেমনি ধনতন্ত্র তার সঙ্কটে শত বাহু বিস্তারে বেঁচে যায়Ñ এমনকি সমাজতন্ত্রী প্রেসক্রিপশন ধার করেও। এবারেও ট্রাম্প-জনসন ধনতন্ত্রের জন্য তাদের যুদ্ধ-বিস্তার ও ট্রেড ওয়ার দ্বারা ধনতন্ত্রের জন্য যে ধ্বংসের পথ তৈরি করতে চলেছেন, তা থেকে তাকে মেরামত করার জন্য হয়তো ইউরোপ-আমেরিকার সমাজতন্ত্রী মিস্ত্রিরাই ছুটে আসবেন। তবে ট্রাম্প ও বরিস জনসনের মতো নেতৃত্ব ধনতান্ত্রিক বিশ্বে যদি না বদলায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ধনতন্ত্রের জন্য এবং সমাজতন্ত্রের জন্যও বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করবে। নীতি ও নেতৃত্বগুণে একটি ছোট দেশও যে ধনতান্ত্রিক বিশ্বের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে পরে, তার একটি বড় প্রমাণ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ। আফগান ও ইরাক যুদ্ধের বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া ও তেল সঙ্কটকালে হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ কিভাবে এ বিপর্যয় এড়িয়ে ছিল ব্রিটেনের অনেক সংবাদপত্র তা উল্লেখ করে শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছে। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির অনুসারী হয়েও সমাজতান্ত্রিক প্রেসক্রিপসন দ্বারা কিভাবে দেশকে রক্ষা করা যায় হাসিনা সরকার এর উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ট্রাম্প ও জনসন ইউরোপ-আমেরিকার এই দুই হঠকারী নেতা যে পথে চলেছেন, তাতে বিশ্ব ধনতন্ত্র শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাবে কি? [লন্ডন, ২২ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ২০১৯]
×