ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শেভরন, সিমেন্স ও কোকাকোলা রয়ে গেছে শেয়ারবাজারের বাইরে

ব্যবসা বাংলাদেশে-মুনাফা যাচ্ছে বিদেশে

প্রকাশিত: ১১:০৮, ২২ অক্টোবর ২০১৯

ব্যবসা বাংলাদেশে-মুনাফা যাচ্ছে বিদেশে

অপূর্ব কুমার ॥ ব্যবসা করছে বাংলাদেশে কিন্তু মুনাফার টাকা যাচ্ছে দেশের বাইরে। দেশের জনগণ ব্যবসার মুনাফার অংশ পাচ্ছে না। কর বাবদ সরকারের পাওনা টাকা ছাড়া রাষ্ট্রের জনগণের বহুজাতিক কোম্পানিতে কোন অংশীদারিত্ব নেই। বারবার তাগাদা দিয়েও বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বাইরে থেকে ব্যবসা করছে শেভরন, সিমেন্স ও কোকাকোলার মতো জনপ্রিয় কোম্পানি। তাই জনগণ চায় বাংলাদেশে ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানিগুলো লাভের টাকারও ভাগ বিতরণ করুক। সরকারও এই লক্ষ্যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কোকাকালোকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তিতে অনুরোধ জানিয়েছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ আজিজুল আলম বলেন, বহুজাতিক ও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। এই কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করলে গভীরতা বাড়বে এবং একইসঙ্গে শেয়ারবাজারও আকর্ষণীয় হবে। এছাড়া শেয়ারবাজারের উন্নয়নে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) মাধ্যমে সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। একইসঙ্গে দেশে ব্যবসারত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকেও শেয়ারবাজারে আসার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে দ্রুত সময়েই তারা শেয়ারবাজারে আসবে। জানা গেছে, বাংলাদেশেন মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহসহ সব খাতেই জোগান দিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি। ইউনিলিভার বাংলাদেশ, কোকোকোলার মতো আকর্ষণীয় কোম্পানিগুলো একচেটিয়া ব্যবসা করছে। এসব কোম্পানির বেশিরভাগ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়। যদিও দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে মাত্র ১১টি কোম্পানি। সর্বশেষ ২০০৯ সালের নবেম্বরে গ্রামীণফোনের তালিকাভুক্তির পর দশ বছরেও নতুন করে আর কোন বহুজাতিক কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসেনি। ফলে বাংলাদেশ থেকে এসব কোম্পানি বড় অঙ্কের মুনাফা করলেও তার অংশীদারিত্ব পাচ্ছে না দেশের মানুষ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্য রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ এ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি) নিবন্ধিত বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে ৩৫৫টি। বহুজাতিক এসব কোম্পানির মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত রয়েছে- ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, গ্রামীণফোন, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ, গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশ, ম্যারিকো বাংলাদেশ, লিন্ডে বাংলাদেশ, রেকিট বেনকিজার বাংলাদেশ, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট লিমিটেড, সিঙ্গার বাংলাদেশ ও বাটা সু। ১১ কোম্পানির সমন্বিত বাজার মূলধনের পরিমাণ ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের ২৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। যদিও সব খাত মিলে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৫৫৮। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্তির শর্ত না থাকা, শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ও স্বচ্ছতার অভাবে এসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। এর বিপরীতে তালিকাভুক্ত হচ্ছে দুর্বল মৌলভিত্তির দেশীয় কোম্পানি। এসব কারণেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না নতুন বিনিয়োগকারীরা। তথ্য মতে, দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে মুনাফার দিক দিয়ে সবার ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শেভরন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে কোম্পানিটি। ১৮৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানি বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক গ্যাসের পাশাপাশি তেল ও উৎপাদনমুখী শিল্পে প্রভাব বিস্তারকারী একটি প্রতিষ্ঠান। ব্যবসার দিক দিয়ে দ্বিতীয় নম্বরে থাকা গ্রামীণফোন লিমিটেড দেশের টেলিকম খাতের সবচেয়ে বড় কোম্পানি। তাদের গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৭০ হাজার। ৩ নম্বরে থাকা ইউনিলিভার লিমিটেড ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামে কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে স্থায়ী ব্যবসা শুরু করে। দেশের প্রসাধন সামগ্রীর বাজারে শীর্ষে রয়েছে তারা। তবে বাংলাদেশে গ্ল্যাক্সোমিথক্লাইনের শেয়ার কেনার মাধ্যমে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ। ব্যাংকিং খাতে বহুজাতিক কোম্পানির নেতৃত্ব দিচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, হংকং এ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন (এইচএসবিসি) লিমিটেড ও সিটি ব্যাংক এনএ। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে মুনাফায় শীর্ষ তালিকায় থাকলেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়। একইভাবে তালিকাভুক্তির বাইরে রয়েছে- সিমেন্স, মবিল, নেসলে, এভেরি ডেনিসন, ইয়ংওয়ান, নোভারটিস বাংলাদেশ, কোস্ট বাংলাদেশ লিমিটেড, জিআইজেড, গ্রে এ্যাডভার্টাইজিং লিমিটেড, এশিয়ান পেইন্টস, এসিএস টেক্সটাইল, এমসিসি ট্রান্সপোর্ট, হোটেল আমরাই, নিউ ভিশন সলিউশন, ডেনিম এক্সপোর্ট, আরএকে পেইন্টস, ভিনারো ইন্টারন্যাশনাল ও সিপি বাংলাদেশ। বহুজাতিক এসব কোম্পানি কেন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে না জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এক কমিশনার বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে নিয়ে আসার জন্য বিএসইসি অনেক চেষ্টা করেছে। ইউনিলিভার ও নেসলেসহ বড় বড় কোম্পানিকে তালিকাভুক্তির জন্য সরকারের উর্ধতন পর্যায় থেকেও যোগাযোগ করা হয়েছে। ৪০ কোটি টাকার বেশি মূলধনী কোম্পানিকে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা দিয়ে আইন করা হয়েছিল। কিন্তু অল্প কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া অধিকাংশই আসেনি। বিএসইসির আইনানুযায়ী, দেশীয় কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন ৪০ কোটি টাকা অতিক্রম করলেই এক বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক। ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির ক্ষেত্রে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশের তিন বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে আসতে হয়। কোন কোম্পানি ওই সময় তালিকাভুক্ত না হলে যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে ছয় মাস সময় বাড়াতে পারে। তালিকাভুক্ত না হওয়া পর্যন্ত বীমা কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রতিদিন ১ হাজার টাকা হারে জরিমানা দেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু বিদেশী কোম্পানির ক্ষেত্রে এ ধরনের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। অবশ্য সেলফোন অপারেটরদের লাভজনক হওয়ার পর পুঁজিবাজারে আসার শর্ত রয়েছে। এর বিনিময়ে তালিকাভুক্ত অপারেটর ১০ শতাংশ আয়কর রেয়াত পাবে। সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯-এর ইস্যু অব ক্যাপিটালের ২(এ) ধারা অনুযায়ী, দেশী-বিদেশী যে কোন কোম্পানির মূলধনের ওপর বিএসইসির কর্তৃত্ব রয়েছে। কোম্পানির ওপর শর্ত, চুক্তি, মেমোরেন্ডাম দেয়ার ক্ষমতা এসইসিকে দেয়া হয়েছে। তবে চলতি বছরের ১১ জুন বিদেশী কোম্পানি ৪০ কোটি টাকা বা তদুর্ধ মূলধনী হলে তাদের তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা বাতিল করে নির্দেশনা দেয় বিএসইসি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসইসির এক কমিশনার বলেন, আইন করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির প্রচেষ্টা ছিল। তবে দেশে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের জন্য জাপান চেম্বারের অনুরোধে এ শর্ত তুলে দেয়া হয়েছে। যদিও শর্তারোপ করেও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে আনা যায়নি। তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজার আনার উদ্যোগ নেয়া দরকার বলে মনে করেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাজারের বড় অংশ বহুজাতিক কোম্পানির দখলে। অতীতে যখনই এ ধরনের কোম্পানি শেয়ারবাজারে এসেছে, তখনই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আলাদা উদ্যম ও আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে বহুজাতিক কোম্পানির ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির নির্দেশনা রয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহী করতে শর্তারোপ না হলেও আলোচনার মাধ্যমে তাদের শেয়ারবাজারে আনা উচিত। শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ বলেন, দেশীয় কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে তালিকাভুক্তির জন্য নানা শর্ত থাকলেও বিদেশী কোম্পানির ক্ষেত্রে নেই। অথচ বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রসাধন সামগ্রী, গ্যাস, ইন্স্যুরেন্স, ব্যাংকসহ অনেক বহুজাতিক কোম্পানিই অন্যান্য দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। সরকারের যথাযথ উদ্যোগ ও আইনী দুর্বলতার কারণেই বহুজাতিক কোম্পানি বাজারে আসছে না।
×