ওয়াজেদ হীরা ॥ ইলিশ রক্ষায় নিষেধাজ্ঞা চলছে। তবে থেমে নেই ইলিশ ধরা। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিভিন্নস্থানে ইলিশ ধরার চেষ্টা করছেন জেলেরা। আড়ালে/আবডালে বিক্রিও হচ্ছে। কড়া সতর্কতায়ও কেউ কেউ ধরা পড়ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। অধিক ইলিশ উৎপাদনে মা ইলিশ রক্ষায় নদী ও জেলেপল্লীতে কড়া নজরদারি রাখছে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী। নিষেধাজ্ঞাকালীন ইলিশ রক্ষায় জেলেপাড়াগুলোয় আরও বেশি প্রচার ও অধিক নজরদারির ওপর গুরুত্বারোপ করছেন সংশ্লিষ্টরা। সাধ্যের মধ্যে বড় ইলিশ পেতে নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার পরামর্শ তাদের। কয়েক বছর ধরেই একটু সাশ্রয়ী মূল্যে বড় সাইজের ইলিশ পাওয়া গেছে বাজারে। সব শ্রেণীর মানুষ ইলিশ কিনে খেতে পেরেছেন। এ বছর ইলিশের আকার ছিল আরও বড়। এবার এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ প্রচুর ধরা পড়ছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ছিল দামেও সস্তা। মৎস্য, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বছরের কিছু নির্দিষ্ট সময়ে নিয়ম করে জেলেদের ইলিশ নিধন থেকে ফেরানো, ইতিবাচক প্রচার, জাটকা বড় হওয়ার সুযোগ দেয়াসহ নানা কারণে একদিকে যেমন প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে তেমনি ইলিশের আকারও বড়। বাজারে ইলিশের সরবরাহ যখন বেশি থাকে তখন দামও কম থাকে। ফলে সবাই কিনে খেতে পারে।
তবে ইলিশের উৎপাদন মৌসুমেও কিছু অসাধু জেলে নিজেদের বিরত রাখতে পারে না। নদীতে চুরি করে জাল ফেলে। কখনও এসব ইলিশ প্রকাশ্যে বিক্রি করতে পারে না, থলেয় ভরে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেন। যদিও নদীতে কড়া পাহাড়ায় অনেক সময় জেলেরা আটকও হচ্ছেন। কোথাও কোথাও সরকারের বরাদ্দ চাল না পাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে জেলেরা চাল পেয়েছেন কিনা তার সুষ্ঠু তদারকির কথাও বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত কয়েকদিন বাজারে প্রকাশ্যে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে গোপনে বিক্রির তথ্য পাওয়া গেছে। অনেক সময় জেলেরা বাড়িতেও পৌঁছে দিচ্ছে। যদিও এর পরিমাণ খুব কম। একাধিক জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিনিয়ত কিস্তি আর অভাব/ অনটনের কারণে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে নদীতে জাল ফেলছে। গোপনে মাছ বিক্রির চেষ্টা হয়। গত শুক্রবার হাইমচরের মেঘনায় মাছ নিধনকালে কোস্টগার্ডের অভিযানে ১ লাখ ৫০ হাজার মিটার জালসহ ৮ জেলে আটক হয়। পৃথক আরেকটি অভিযানে চাঁদপুর সদর মডেল থানার পুলিশ শহরের বড় স্টেশন টিলাবাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩ লাখ মিটার কারেন্ট জালসহ একজনকে আটক করে। আটক জেলেদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রত্যেককে এক বছর করে কারাদ- দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফেরদৌসী বেগম।
একই দিনে চাঁদপুর শহরের টিলাবাড়ি এলাকা ও ব্রিজ সংলগ্ন যমুনা রোড এলাকায় পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়। চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) জাহেদ পারভেজ চৌধুরীর জানান, আমরা তো নদীতে নামতে পারব না, সেখানে নৌ পুলিশ রয়েছে। তবে জেলেপল্লীতে যারা মা ইলিশ ধরছে, এ কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। বাংলাদেশে ইলিশ প্রধান জেলা ১৭। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় বছরের নির্দিষ্ট সময়ে : যেমন সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ও মার্চ-এপ্রিলে ডিম ছাড়ার মৌসুমে মা ইলিশ আর অপ্রাপ্তবয়স্ক জাটকা ইলিশ ধরা নিষেধ। এছাড়া ইলিশ কেনার অপরাধেও কারাদন্ড দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি লৌহজং উপজেলায় জেলেদের ইলিশ ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন এক এএসআই। সবকিছুতেই বার্তা একটাই, নীরবে-নিভৃতে ইলিশ নিধন হচ্ছে। তবে টহল থেমে নেই।
নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ ধরে বিক্রি করতেও কষ্ট হয় জেলেদের। সচেতনতায় কেউ সহজে কিনতে চায় না। মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিনেরবেলায় কম থাকলেও রাতে কিছু জেলে চেষ্টা করে। মাদারীপুরের শিবচর, শরীয়তপুরের জাজিরা, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং, ঢাকার দোহার, ফরিদপুরের কিছু অংশে জেলেদের লুকিয়ে মাছ ধরার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে রাতে অভিযান বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে, গত ৯ থেকে আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ ধরা, বেচাকেনা ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রথম দফায় প্রতিবছর অক্টোবরের ২২ দিন দেশের সব নদ-নদীতে ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইংরেজীর হিসেবে এটি অক্টোবর হলেও বাংলা মূলত আশ্বিন। আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমায় ইলিশ ডিম ছাড়ে। এ সময় পরিপক্ব ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য সাগর থেকে মিঠাপানির নদীতে চলে আসে। মূলত এজন্য স্বাচ্ছন্দ্যে ও বাধাহীন ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুমকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার এ সময়ে নদীতে সব ধরনের মাছ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
মা ইলিশ সংরক্ষণের প্রভাব ॥ গত বছর ২২ দিন এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ থাকায় প্রায় ৪৮শতাংশ মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পেয়েছে বলে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)-এর গবেষণা তথ্যে জানা গেছে। ইলিশের প্রজনন সাফল্যে ২২দিন নিষিদ্ধকরণে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ৪৭.৭৪ শতাংশ পরিপক্ব ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পেয়েছে। আংশিক ডিম ছাড়া ইলিশের হার ছিল ২২ শতাংশ। প্রজননরত ইলিশের হার ৩ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধের কারণে ৭ লাখ ৬ হাজার কেজি ডিম উৎপাদন হয়েছে।
ইলিশের জন্য ছয়টি অভয়াশ্রম ॥ ইলিশের জন্য মোট ছয়টি অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে সরকার। এগুলো হচ্ছে- চাঁদপুর জেলার ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনার ১০০ কিলোমিটার, ভোলার চর ইলিশার মদনপুর থেকে চরপিয়াল পর্যন্ত মেঘনা নদীর ৯০ কিলোমিটার, ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালীর চররুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার, শরীয়তপুরের নড়িয়া থেকে ভেদরগঞ্জ পর্যন্ত পদ্মার ২০ কিলোমিটার, বরিশাল জেলার হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জহ ও বরিশালের কালাবদর গজারিয়া ও মেঘনা নদীর ৮২ কিলোমিটার। এই ছয় অভয়াশ্রমের বাইরে দেশের উল্লেখযোগ্য নদীতে এ সময় কেবল ইলিশের ডিম ছাড়ার জন্য মাছ ধরা বন্ধ থাকবে।
সরকারের সহায়তা ॥ জাটকা সংরক্ষণের মতো মা ইলিশ সংরক্ষণের সময়ও জেলেদের ভিজিএফ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৪ জেলার ৭৬ উপজেলায় এই সহায়তা দেয়া হলেও এ বছর সেটি বেড়ে হয়েছে ১২৭ উপজেলা। বিগত তিন বছরে তিন লাখ ৯৫ হাজার ৭০৯ জেলে পরিবারকে ২০ কেজি হারে সরকার ২২৭৩৭.৮৮ মেট্রিক টন চাল দেয়া হয়। এছাড়া বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া হচ্ছে।