ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নদীপথে মাসের পর মাস, হেঁটে পাহাড় পাড়ি

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ২১ অক্টোবর ২০১৯

নদীপথে মাসের পর মাস, হেঁটে  পাহাড় পাড়ি

মোরসালিন মিজান ॥ আজকের বাংলাদেশের কথা আগে একটু বলে নেয়া যাক। পর্যটন বলতে কিছু এখানে নেই। নেই যে, তা নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যথাও নেই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়টিকে অনেকে বলেন, অনাথ আশ্রম। বড় বড় স্যারের সুসজ্জিত শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অফিস কক্ষ, গদিওয়ালা চেয়ার, পেট মোটা গাড়ি- সবই আছে। শুধু পর্যটন নেই। বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করার উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। যারা স্বেচ্ছায় আসেন তাদের পড়তে হয় বহুবিধ বিড়ম্বনায়। এভাবেই চলছে। এবার পেছনে ফেরা যাক। দুই দশ বছর পেছনে নয়। শত শত বছর। আর তখন দেখা যাচ্ছে, বহু দূরের দেশ থেকে পর্যটকরা এ অঞ্চলে আসছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ ধর্ম প্রচারসহ নানা উদ্দেশ্যে এই আসা যাওয়া। পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরে বেড়ানো বিখ্যাত পর্যটক-শিল্পী-লেখকরাও বাদ যাচ্ছেন না। চলে আসছেন তারাও। বাংলার নদী গাছ ফসলের মাঠ দেখে যেমন মুগ্ধ হচ্ছেন, তেমনি জানার চেষ্টা করছেন মানুষের জীবন-সংস্কৃতি। পরবর্তীতে প্রকাশিত ভ্রমণ কাহিনী, হাতে আঁকা ছবি ইত্যাদি থেকে বাংলার ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে সে সময়ের বাংলাকে। বর্তমানে দাঁড়িয়ে পর্যটনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, সুপ্রাচীনকাল থেকেই এখানে ভিনদেশীদের আসা যাওয়া ছিল। মধ্যযুগে ইউরোপ আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা এসেছেন। সে সময় বেশি ব্যবহৃত হয়েছে নদীপথ। লম্বা সময় জলে ভাসার পর পর্যটকদের তরী তীরে ভিড়েছে। স্থলপথে কখনও ঘোড়ায় চড়ে, কখনও বা হেঁটে এগিয়ে গেছেন শুধু। চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়ালেও, বিদেশীদের আগ্রহের মূল কেন্দ্র ছিল ঢাকা। বিশেষ করে মোগল শাসনামলে শহরের গুরুত্ব কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এ সময় সুবে বাংলার রাজধানী করা হয় ঢাকাকে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে শহরের নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর। যতদূর তথ্য, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে বাংলায় এসেছিলেন রোমান পর্যটক গ্রিনি। দ্বিতীয় শতকে আসেন আলেকজান্ড্রিয়ার টলেমি। পঞ্চম শতকে ভ্রমণ করেন চৈনিক পরিভ্রাজক ফা- হিয়েন। হেঁটে বাংলা ভ্রমণে আসেন তিনি। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তিব্বতের পামীর মালভূমির দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে সঙ্গীসাথীসহ এ অঞ্চলে আসেন। তার লেখা ভ্রমণকাহিনী থেকেও অনেক অজানা তথ্য জানা সম্ভব হয়। সপ্তম শতকে এসে খুঁজে পাওয়া যায় বিখ্যাত হিউয়েন সাঙের নাম। ৬২৯ খ্রীস্টাব্দে চীন থেকে যাত্রা শুরু করেন তিনি। উত্তরের বাণিজ্য পথ ধরে মধ্য-এশিয়ার কুচ হয়ে উত্তর ভারতে পৌঁছান। এরপর তিনি প্রবেশ করেন বাংলায়। বাংলার পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশ ঘুরে বেড়ান তিনি। তার ভ্রমণ কাহিনী পরবর্তীতে বাংলাকে চিনতে ভীষণ সহায়তা করে। আরেক আলোচিত নাম মরোক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা। ১৩৪৬ সালে বাংলা ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৬ খ্রীস্টাব্দের ৯ জুলাই তিনি পৌঁছেন সাদকাঁও, মানে চাটগাঁও বা চট্টগ্রাম। সেখান থেকে একমাস পথ চলার পর কামারু বা কামরূপে পৌঁছান। পরে নদীপথে ১৫ দিন নৌকায় ভ্রমণের পর পৌঁছান সোনারগাঁও শহরে। জানা যায়, বাংলায় ইবনে বতুতা ভ্রমণ করেন প্রায় দুই মাস। ১৩৫৫ খ্রীস্টাব্দে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হয় তার ভ্রমণ কাহিনী। সেখানে বাংলার নানা বর্ণনা দেন তিনি। তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে চারটি স্থান ও তিনটি নদীর রেখাচিত্র পাওয়া যায়। ১৪০৬ খ্রীষ্টাব্দে বাংলায় আসা চৈনিক পর্যটক মা হুয়ানও চট্টগ্রাম দিয়ে প্রবেশ করে সোনারগাঁওয়ে আসেন। ইউরোপীয়দের মধ্যে ঢাকায় প্রথম আসে পর্তুগীজরা। সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহর আমল (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রীস্টাব্দ) থেকে পর্তুগীজদের আসা শুরু হয়। ১৬৪০ খ্রীস্টাব্দে ঢাকায় আসেন বণিক-পর্যটক সেবাস্তিন মানরিক। তার মতে, ঢাকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই বিদেশী বণিকদের আকৃষ্ট করেছিল। বাংলা থেকে বিদেশে রফতানি হওয়া পণ্যের একটি তালিকাও দিতে সক্ষম হন তিনি, যেখানে রয়েছে ধান, চিনি ও তেলসহ কিছু পণ্য। ঢাকা ও শহরতলীর জনসংখ্যা তখন দুই লাখ ছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ইংরেজ বণিকদের মধ্যে প্রথম এসেছিলেন জেমস হার্ট। দ্বিতীয়জন টমাস প্রাট। বাংলায় ফরাসীদের আগমন ঘটে সপ্তদশ শতাব্দীর ৮ এর দশকে। ফরাসী চিকিৎসক পর্যটক ফ্যাসোয়াঁ বার্নিয়ে ও বণিক পর্যটক তাভারনিয়ে একইসঙ্গে ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দে বাংলায় প্রবেশ করেন। বাংলার রূপে মুগ্ধ হয়েছিলে বার্নিয়ে। তার বর্ণনা অনেকটা এরকম- দেশটিজুড়ে অসংখ্য নদীনালা। তার চতুর্দিকে শস্য ও ফলে পরিপূর্ণ সবুজ প্রান্তর। ১৬৬১-৭০ খ্রীস্টাব্দে ঢাকায় আগমণ করেন ইতালিয়ান পর্যটক ইতিহাসবিদ নিকোলো মানুচি, ফরাসী পর্যটক ফ্রাসোয়াঁ বার্ণিয়ে এবং জাঁ ব্যাপটিস্টতাভারনিয়ে। মুনচি থেকে জানা যায়, ঢাকায় সে সময় দুটি বিদেশী কুঠি ছিল। একটি ইংরেজদের। অন্যটি ওলন্দাজদের। এভাবে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা আসেন বাংলায়। তাদের ভ্রমণ কাহিনী পরবর্তীতে ইতিহাস লেখার কাজকে সহজ করেছে।
×