ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মেননের বক্তব্য নিয়ে সরগরম রাজনৈতিক অঙ্গন

প্রকাশিত: ১০:৪১, ২১ অক্টোবর ২০১৯

 মেননের বক্তব্য নিয়ে সরগরম  রাজনৈতিক অঙ্গন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ১০ মাসের মাথায় এসে হঠাৎ করে সেই নির্বাচন নিয়ে সংসদ সদস্য ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের এক বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম হয়ে উঠেছে। ‘নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি’ বলে মেননের দেয়া বক্তব্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে রাজনৈতিক মাঠ সর্বত্রই ‘মুখরোচক’ আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে মেননের বক্তব্য। প্রভাবশালী মন্ত্রীরা যেমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তেমনি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার বাড়তি এ সুযোগও হাতছাড়া করছেন না সরকারবিরোধীরা। তবে সমালোচনার মুখে মেননের দাবি, ‘আমার বক্তব্য সম্পূর্ণ উপস্থাপন না করে অংশ বিশেষ উত্থাপন করায় এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে’। ঢাকা-৮ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে গত দুই সংসদ নির্বাচনেই বিজয়ী হয়েছেন মেনন। গত সরকারে দুই দফায় দুই মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী হিসেবে পালন করেছেন দায়িত্ব। প্রথমে ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী আর পরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী। গত বছর ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হয়নি মেননসহ আওয়ামী লীগের কোন শরিক দলের নেতারই। রাজনৈতিকভাবে নির্বাচনে ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই বিএনপি ও তাদের মিত্ররা মাসের পর মাস ধরে বলে চলেছেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি, কেউ ভোট দিতে পারেনি’। একই কথা বলে বলে তারা নালিশ করে চলেছেন বিদেশীদের কাছে। তবে কোন নালিশেই আজ পর্যন্ত কাজ হয়নি। তবে এবার সেই নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের এক বক্তব্য রীতিমতো রসদ জোগালো সরকারবিরোধীদের। গত শনিবার বরিশালে এক অনুষ্ঠানে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সেই নির্বাচনেই বিজয়ী মেনন। অশ্বিনী কুমার টাউন হলে ওয়ার্কার্স পার্টির সম্মেলনে তিনি বলেন, আমিও নির্বাচিত হয়েছি। তারপরও আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, ওই নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এমনকি পরবর্তীতে উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ভোট দিতে পারেনি দেশের মানুষ। সরকারের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশে লুণ্ঠন ও দুর্নীতি ‘মহামারী আকার ধারণ করেছে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। শনিবার মেননেন দেয়া এ বক্তব্য গণমাধ্যমে আসার পর তা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। রবিবার তার বক্তব্য ছিল রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ১৪ দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের এ বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, মন্ত্রী হলে মেনন এ কথা বলতে পারতেন কিনা? মেননের এই বক্তব্যের বিষয়ে ১৪ দলের সমন্বয়কের কাছে জানতে চাওয়া হবে বলেও জানান ওবায়দুল কাদের। সচিবালয়ে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, তিনি যদি বলেই থাকেন, আমার প্রশ্ন হচ্ছে এতদিন পরে কেন? এই সময়ে কেন? নির্বাচনটা তো অনেক আগে হয়ে গেছে। আরেক প্রশ্ন সবিনয়ে- মন্ত্রী হলে কি তিনি এ কথা বলতেন? আর কোন কিছু বলতে চাই না। মেনন কেন এ বক্তব্য দিয়েছেন, তা আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাছে জানতে চাওয়া হবে কিনা-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের ১৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম সাহেব, সেটা আমরা তার কাছে জানতে চাইব। ক্যাসিনোকান্ডের পর একটি ক্লাবের সঙ্গে মেননের সম্পৃক্ততার কথা ওঠার ক্ষোভে তিনি এসব কথা বলছেন কিনা জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কাদের বলেন, এটি তাকে জিজ্ঞাসা করলে ভাল হয়, তিনি কেন ক্যাসিনোকান্ডের পর এ কথা বললেন, ইলেকশনের পর কেন বললেন না মেনন শপথ ভঙ্গ করেছেন কিনা জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ওই প্রশ্নটা তাকে করেন। এদিকে রাজনীতিতে সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকা বিএনপি নেতারাও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন মেননের বক্তব্য নিয়ে। মেনন জাতির সামনে ‘রাজসাক্ষী’ হয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাতের ভোট ডাকাতির স্বীকারোক্তি দেয়ার মাধ্যমে নিজের দায় ও অপরাধ স্বীকার করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ জোটের নেতা মেননের এমন বক্তব্যের পর নৈতিকতা ও বাস্তবতার দিক দিয়ে বর্তমান সরকারের উচিত সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে পদত্যাগ করা। সরকারের যদি লজ্জা থাকে তাহলে তাদের পদত্যাগ করা উচিত। তারা যে অবৈধ সরকার তাদের লোকেরাই তা স্বীকার করেছেন। রবিবার দুপুরে নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশ চলছে সম্পূর্ণ উল্টো পথে। যারা অপরাধী রাজদ- তাদের হাতে। আর নিরপরাধ থাকেন কারাগারে। গণতন্ত্র ও দেশের পক্ষে কথা বলার কারণেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে বন্দী। তিনি বলেন, সত্যের ঢোল বাতাসে বাজে, অপকর্ম করেও কখনো কখনো বিবেকের তাড়নায় সত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয় মানুষ। কারণ, বিবেকবান মানুষের মনে অপরাধবোধ অস্থিরতা সৃষ্টি করে। তবে সরকারের বিশ্বস্ত রাশেদ খান মেননের বক্তব্যের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কি তা আমাদের জানা নেই। এদিকে মেননের বক্তব্যে খুশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা কামাল হোসেনও। মেননের বক্তব্যকে একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অভিযোগের পক্ষে বড় প্রমাণ হিসেবে দেখছেন কামাল হোসেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির এক বৈঠকের পর কামাল বলেন, দেরিতে হলেও উনি (রাশেদ খান মেনন) এটা করেছেন। আমি খুশি। আমি তো এই কথাটি বার বার বলে যাচ্ছি যে, আপনারা কেউ কি ৩০ ডিসেম্বর ভোট দিয়েছিলেন? আমি এই পর্যন্ত একজনের কাছ থেকে পাইনি যে ‘হ্যাঁ’ দিয়েছেন। এখন উনিও (রাশেদ খান মেনন) কনফার্ম করলেন। এজন্য আমি উনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে সমালোচনার মুখে মেনন তার একটি ব্যাখ্যা দিয়ে দাবি করেছেন, ‘আমার একটি বক্তব্য সম্পর্কে জাতীয় রাজনীতি ও ১৪ দলের রাজনীতিতে একটা ভুল বার্তা গেছে। আমার বক্তব্য সম্পূর্ণ উপস্থাপন না করে অংশ বিশেষ উত্থাপন করায় এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এক বিবৃতিতে মেনন বলেন, আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এ যাবতকালের নির্বাচন ১৪ দলের সংগ্রামেরই ফসল এবং সরকারও গঠিত হয়েছে ১৪ দলের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। আজকে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার যে বিপদ বিদ্যমান তাকে মোকাবেলা করতে ১৪ দলের ওই সংগ্রামকেই এগিয়ে নিতে হবে। এর আগে জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর দেয়া বক্তব্যেও একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছিলেন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেন মেনন। ওই বক্তব্য উদ্ধৃত করে বিবৃতিতে মেনন বলেন, একাদশ সংসদের সফল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতাটি সুখকর নয়। বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে আসলেও নির্বাচনকে ভ-ুল করা, নিদেন পক্ষে জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার কৌশল প্রয়োগ করেছে নির্বাচনে। এটা যেমন সত্য তেমনি এ ধরনের পরিস্থিতিতে অতি উৎসাহী প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বাড়াবাড়ি করতে পারে। কিন্তু তাতে এই নির্বাচন অশুদ্ধ বা অবৈধ হয়ে যায় না। মেনন বলেন, বক্তৃতায় আমি বলেছি, স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকে এ যাবত জিয়া-এরশাদ-বিএনপি-জামায়াত আমলের ধারাবাহিক অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ও ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটেছে। বিভিন্ন সময় আমি প্রার্থী হিসেবে এ সকল ঘটনার সাক্ষী। আমি বলেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মিলে ভোটাধিকার ও ভোটের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে আমরা যে লড়াই করেছি তা যেন বৃথা না যায়, সেজন্য নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
×