ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গুলিতে নিহত ৪ ॥ শেবাচিমে ভর্তি গুলিবিদ্ধ ২৮, বিক্ষোভ

ফের ফেসবুক গুজব ॥ ভোলা রণক্ষেত্র

প্রকাশিত: ১০:৩৭, ২১ অক্টোবর ২০১৯

 ফের ফেসবুক গুজব ॥ ভোলা রণক্ষেত্র

হাসিব রহমান, বোরহানউদ্দিন থেকে ॥ ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় মুসল্লিদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৪ মুসল্লি নিহত হয়। নিহতরা হচ্ছে মাহফুজ পাটওয়ারী, মিজান, শাহিন, মাহবুব। এদের মধ্যে মিজানের বাড়ি মনপুরা উপজেলায় এবং অন্য ৩ জনের বাড়ি বোরহানউদ্দিন উপজেলায়। এদিকে ২ সাংবাদিক, ২০ পুলিশসহ ২ শতাধিক লোক আহত হয়েছে। বরিবার সকাল সাড়ে ১০টায় বোরহানউদ্দিন পৌর এলাকার ঈদগাহ মাঠে মুসল্লিদের বিক্ষোভ সমাবেশে এ ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবি র‌্যাব, কোস্টগার্ড ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩ সদস্যের কমিটি ঘটনা করা হয়েছে। এদিকে খবর পেয়ে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল ঘটনাস্থলে চলে আসেন। তিনি ঘটনা স্থল পরিদর্শন করেন এবং নিহত পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহায়তা করা হবে বলে জানান। এদিকে বর্তমানে বোরহানউদ্দিনে পরিস্থিতি থমথমে অবস্থায় রয়েছে। এলাকায় মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৩ প্লাটন বিজিবি বোরহানউদ্দিন শহরে মোতায়েন করা হয়েছে। এদিকে বোরহানউদ্দিনে একটি মন্দির ভাংচুর করার ঘটনায় সংখ্যালঘুদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, শুক্রবার বিকেলে বিপ্লব চন্দ্র শুভ’র নিজের নাম ও ছবি সম্বলিত ফেসবুক আইডি Biplob Chandra Shvuo থেকে আল্লাহ তায়ালা ও নাবী করিম (স) কে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ গালাগাল করে তার কয়েকজন ফেসবুক বন্ধুর কাছে মেসেজ করে। এক পর্যায় কয়েটি আইডি থেকে মেসেজগুলোর স্ক্রিন শর্ট নিয়ে ফেসবুকে কয়েকজন প্রতিবাদ জানালে বিষয়টি সকলের নজরে আসে। এমনকি বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এ অবস্থায় সন্ধ্যার পর বিপ্লব চন্দ্র বোরহানউদ্দিন থানায় আইডি হ্যাক হয়েছে মর্মে জিডি করতে আসলে থানা পুলিশ বিষয়টি তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিপ্লব চন্দ্রকে তাদের হেফাজতে রাখেন। বিপ্লব চন্দ্র শুভ বোরহানউদ্দিন উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের চন্দ্র মোহন বৈদ্দের ছেলে। সে ডিগ্রী পাস করেছে। এ ঘটনার প্রতিবোদে বোরহানউদ্দিনের কুঞ্জেরহাট বাজারে সর্বস্তরের মুসলিম তাওহিদী জনতার ব্যানারে মানববন্ধন করা হয়েছে এবং থানার সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেছে তাওহিদী জনতা। এ সময় তারা ঘটনার সত্যতা যাচাই করে বিপ্লব চন্দ্রের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন। রাতে পুলিশের সঙ্গে সমঝোতা মুসল্লিদের বৈঠক হয় এবং সোমবার সকালে সমাবেশ না করার জন্য অনুরোধ করা হয়। বোরহানউদ্দিন থানার ওসি মোঃ এনামুল হক বলেন, শুক্রবার রাতে বিপ্লব চন্দ্র শুভ নিজের ইচ্ছায় ওই যুবক আমাদের কাছে আসছে তার ফেসবুক হ্যাক হয়েছে বলে জিডি করতে। সে জানায় তার কাছ থেকে একটি মোবাইল থেকেও চাঁদা চাইছে। এদিকে শনিবার ট্রাকিং করে হাসনাইন শরিফকে কলাপাড়া থেকে আটক করে বোরহানউদ্দিন এনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় । তার কথা মতো হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িত শাকিল নামে আরও ১ যুবককে আটক করা হয়। কিন্তু বোরহানউদ্দিন উপজেলার তাওহিদী জনতার ব্যানারে মুসল্লিরা রবিবার সকাল ১১টায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে। সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে তাওহিদী জনতার ব্যানারে মুসল্লিরা নবী ও আল্লাহকে কটূক্তিকারী বিপ্লবের ফাঁসির দাবিতে ঈদগাহ মাদ্রাসার মাঠে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। সমাবেশে ভোলা পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কয়সার উপস্থিত ছিলেন। বেলা পৌনে ১১টার দিকে হঠাৎ করে সমাবেশ স্থল থেকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে পুলিশকে ধাওয়া করলে এসপিসহ পুলিশ সদস্যরা মসজিদের দোতালায় একটি কক্ষে আশ্রয় নেয়। তার ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করা হয়। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ করলে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে পুলিশের এসপি যে রুমে আশ্রয় নেয় সেই রুমেও হামলা চালায়। এসময় বিক্ষিপ্ত ভাবে সংঘর্ষ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ চলে। এ সময় পুলিশ চার দিকে ব্যাপক গুলি ছুড়ে বলে অভিযোগ করে স্থানীয়রা। বৃষ্টির মতো গুলি ও ইটপাটকেল পড়তে থাকে। পুলিশের গুলিতে মাহফুজ পাটওয়ারী, মিজান, শাহিন, মাহবুব নামে ৪ জন মুসল্লি নিহত হয়। ২০ পুলিশসহ ২ শতাধিক লোক আহত হয়। ভোলা পুলিশ লাইনের কনস্টেবল আরিফের বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়। তাকে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। এ দিকে পুলিশ হামলা ও গুলির সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ভোলা চরফ্যাশন সড়ক অবরোধ করা হয়। এতে করে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ভোলা সদরেও বিকেলে প্রেসক্লাবের সামনের সড়কে বিক্ষোভ করা হয়। সেখানে ৬ দফা দাবি জানানো হয়। এদিকে খবর সংগ্রহ করতে গেলে বোরহানউদ্দিন হাসপাতালের সামনে বাংলা টিভির সাংবাদিক জুয়েল সাহা ও জিটিভির ক্যামেরাপার্সন জয় দের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ব্যাপক মারধর করা হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, বোরহানউদ্দিনের ঈদগাহ মাঠের সামনে রাস্তায় সোপ সোপ রক্তের দাগ। রাস্তা ও মাঠে ইটপাটকেল পড়ে আছে। সমাবেশ স্থলের মঞ্চ ভাংচুর অবস্থায় পড়ে আছে। বোরহানউদ্দিন হাসপাতালে চলছে স্বজনদের আহাজারি। হাসপতালের কক্ষে পড়ে রয়েছে ২টি লাশ। অসংখ্য রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ভোলা সদর হাসপাতাল ও বরিশালে বহু আহত রোগী গুরুতর অবস্থায় পাঠানো হয়েছে। এদিকে ভোলা সদর হাসপাতালে নেয়ার পর আহত ২ জনকে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করা হয়। বোরহানউদ্দিন হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক আবুল কালাম আযাদ জানান, প্রায় ২ শত রোগীকে তারা চিকিৎসা দিয়েছে। নিহত হয়েছে ৪ জন। এদিকে ভাওয়াল বাড়ি রাধা গৌর নিতাই মন্দিরে উত্তেজিত জনতা ভাংচুর করেছে। এ সময় কয়েকটি বাড়িতে হামলা করা হয় বলে ও অভিযোগ রয়েছে। এদিকে বরিশাল ডিআইজি শফিকুর ইসলাম রবিবার সন্ধ্যায় বোরহানউদ্দিন থানায় এক প্রেস ব্রিফিং এ বলেন, মুসল্লিরা জড়িত নয়। বহিরাগতরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ঘটনা ঘটিয়েছে। তদন্ত করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট যাকে পায়া যাবে প্রয়োজনীয় সর্বউচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সমাবেশ শেষ পর্যায়ে হঠাৎ হামলা করা হয়। মসজিদে অবমাননা করা হয়। পুলিশের এক সদস্যকে গুলি করা হয়। তাকে সিএমএইচ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। তবে কার গুলিতে আহত করা হয়েছে তা নিশ্চিত বলতে পারেননি। তদন্ত করে বলা যাবে। বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার ইয়ামিন চৌধুরী বলেন, এ ঘটনায় স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মাহামুদুর রহমানকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি আগামী ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিবে। ভোলা পুলিশ সুপার বলেন, সমাবেশের শুতে পরিস্থিতি শান্ত ছিল। আমরা স্ট্রেজ থেকে নেমে আসছিলাম। শেষ দিকে দিকে একটি পক্ষ পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে হামলা চালায়। ৪০ মিনিট একটি রুমে অবরুদ্ধ ছিলাম। ওই রুমের জ্বানালা ভেঙ্গে ফেলে। তখন সঙ্গে একজন ম্যাজিস্ট্রেট ছিল। এ সময় পুলিশ নিরাপত্তার স্বার্থে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে। তাকে একটি রুমে অবরুদ্ধ করে। তখন তিনি আর বাঁচবেন কি না তা নিয়ে চরম আতঙ্কের মধ্যে পড়েন বলেও জানান। মৃত্যুও মুখে ছিলাম। এলাকার এমপিকে ফোনে বলেছিলাম এটাই হয়তো আপনার সঙ্গে শেষ কথা। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে পুলিশ আটক করেননি। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। এদিকে ইসলামী আন্দোলনের ভোলা জেলা সেক্রেটারি মাওলানা আতাউর রহমান জানান, সর্ব দলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদের ব্যানারে সোমবার সকাল ১১টার দিকে ভোলা সরকারী স্কুল মাঠে প্রতিবাদ সভা ডাক দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাতে বোরহানউদ্দিন থানায় তাদের সঙ্গে প্রশাসনের একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে তারা বেশ কয়েক দফা দাবি করেন। এ সময় তারা এ ঘটনার মূল নায়ক তার বিচারের দাবি, নিহতদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণ, যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। এসব দাবি প্রশাসন মেনে নিয়েছে বলেও আতাউর রহমান জানান। বৈঠকে উপস্থিত ভোলা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল জানান, যারা নিহত হয়েছে তাদের ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফনের যে দাবি করা হয়েছে তাও মেনে নেয়া হয়েছে। এছাড়াও আহতদের সরকারীভাবে চিকিৎসা দেয়া হবে। প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
×