ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরাঞ্চলজুড়ে লো ভোল্টেজ বিড়ম্বনা

চার বিদ্যুত কেন্দ্রের নামমাত্র উৎপাদনে বিপুল গচ্চা

প্রকাশিত: ১০:৪৬, ১৯ অক্টোবর ২০১৯

  চার বিদ্যুত কেন্দ্রের নামমাত্র উৎপাদনে বিপুল গচ্চা

রশিদ মামুন ॥ উৎপাদনে থাকা চার বিদ্যুত কেন্দ্র প্রতি ইউনিট ৩২ থেকে ৫৭ টাকায় উৎপাদন করছে। কেন্দ্রগুলোর স্থলে ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন হলে বছরে ২৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তরফ থেকে সম্প্রতি এই তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিদিন দেশের অর্ধেক বিদ্যুত কেন্দ্র চালালে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। সেখানে কেন এসব কেন্দ্র চালিয়ে অতিরিক্ত ব্যয় করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোল্টেজ লেভেল ঠিক রাখতে চালানো হচ্ছে। তবে দেশে যে নতুন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো এই পুরান কেন্দ্রের আশপাশে নির্মাণ করা হলে বছরে এই বিপুল পরিমাণ গচ্চা দিতে হতো না। এক্ষেত্রে পরিকল্পনার ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন তারা। বিইআরসির এক সদস্যের তৈরি রিপোর্টে দেখা যায়, এ বছর ভেড়ামারা কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে প্রতি ইউনিট ৪৭ টাকা। গত কয়েক বছরের উৎপাদন ও খরচের হিসাবে পিডিবি বলছে কেন্দ্রটির উৎপাদন খরচ পড়ছে ৩৬ টাকার উপরে। চলতি বছর যা আরও বেড়ে গেছে। কেন্দ্রটি প্রতি ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদনে ৩০ টাকার জ্বালানি খরচ করছে। এতে কেন্দ্রটির প্লান্ট ফ্যাক্টর গড়ে ১০ থেকে ১১ ভাগে নেমে এসেছে। দেশে বিদ্যুত উৎপাদন বাড়ায় খুব সামান্য পরিমাণে কেন্দ্রটি চালানো হচ্ছে। ফলে বছরের বেশিরভাগ সময় অলস কাটাতে হচ্ছে। কেন্দ্রটি অনেক পুরনো, এর ওপর বছরের অধিকাংশ সময় বসে থাকায় ব্যয় বৃদ্ধি ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভেড়ামারায় অন্য বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এর পরও ৬০ মেগাওয়াটের এই কেন্দ্রটি বন্ধ না করায় সামগ্রিক বিদ্যুত উৎপাদনে তা বড় প্রভাব ফেলছে। একই অবস্থায় রয়েছে সৈয়দপুর ২০ মেগাওয়াট, রংপুর-২০ মেগাওয়াট ও বরিশাল ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্রও। এ বছরের উৎপাদন খরচের যে হিসাব দেখানো হয়েছে তাতে সৈয়দপুর বিদ্যুত কেন্দ্রে ইউনিট প্রতি উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে ৩২ টাকা, যা রংপুরে ৩৬ ও বরিশালে সব থেকে বেশি ৫৭ টাকা। পিডিবির তরফ থেকে বলা হচ্ছে, উত্তরাঞ্চলে জ¦ালানি সঙ্কট রয়েছে। একমাত্র বিদ্যুত কেন্দ্র বলা চলে বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র। কেন্দ্রটি আবার পূর্ণ ক্ষমতায় চলতে পারছে না। বড়পুকুরিয়া খনি যে পরিমাণ কয়লা তুলছে তা দিয়ে কেন্দ্রটি অর্ধেক উৎপাদন ক্ষমতায় চলছে। বাকি অর্ধেকটা বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে উত্তরাঞ্চল জুড়ে বিদ্যুতের লো ভোল্টেজ রয়ে গেছে। গোটা এলাকাকে ভুগতে হচ্ছে লো ভোল্টেজ বিড়ম্বনায়। ফলে চাইলেও নতুন কেন্দ্র উৎপাদনে না আসা পর্যন্ত সৈয়দপুর ও রংপুর কেন্দ্র বন্ধ করা যাচ্ছে না। পিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ খুব বেশি দরকার ছিল। সঙ্কট সামাল দিতে বড়পুকুরিয়া কেন্দ্রটির ক্ষমতা বাড়িয়ে নতুন আরও একটি কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু কয়লার জোগান না থাকায় কেন্দ্রটি ঠিকমতো চালানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, কেন্দ্র নির্মাণের আগেই জ্বালানির সংস্থানের বিষয়টি চিন্তা করা জরুরী ছিল। বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষের তরফ থেকেও দুটি কেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ সম্ভব নয় বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু এরপরও কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যুত খাতের পদস্থ ব্যক্তিরা তখন পিডিবিকে চাপ দিয়ে বলেছিল, কেন্দ্র নির্মাণ করলে জ্বালানি সংস্থান করা যাবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তা সম্ভব হচ্ছে না। বড়পুকুরিয়া খনি কেলেঙ্কারি ধরা পড়ার সময় কয়লা আমদানির চেষ্টা চালিয়েও সম্ভব হয়নি। মূলত চট্টগ্রাম, পায়রা বা মংলায় কয়লা এনে ওই কয়লা দিনাজপুর পর্যন্ত সরবরাহের জন্য নেই কোন অবকাঠামো। ফলে কেন্দ্রটিকে সব সময়ই বড়পুকুরিয়া খনির কয়লার ওপর নির্ভর করতে হবে। আর খনি যা উৎপাদন করছে তাতে কেন্দ্রের অর্ধেক জ্বালানি সংস্থান হচ্ছে। পিডিবি সূত্র জানায়, শুধু কয়লা নয় উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি সরবরাহ করা খুব কঠিন। বেসরকারী উদ্যোক্তাদেরও রংপুরে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছে সরকার। কিন্তু কোন উদ্যোক্তা রংপুরে কেন্দ্র নির্মাণে সাড়া দেয়নি। ফলে এসব পুরাতন কেন্দ্রের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রীষ্ম ও সেচ মৌসুমে উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুত সঙ্কট দেখা দেয়। তখন গ্রিড থেকে বিদ্যুত সরবরাহ করা হলেও ভোল্টেজ লেভেল ঠিক রাখতে ওসব কেন্দ্র চালানো হয়। সঙ্কট সমাধানের জন্য ভারত থেকে তেল আমদানির ওপর জোর দিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। ভারতের নোমালিগড় তেল পরিশোধনাগার থেকে তেল আমদানি করে কেন্দ্র নির্মাণ করা হলে উত্তরের বিদ্যুতের সমস্যা সমাধান হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকার বছরে ১০ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ভারতের সঙ্গে চুক্তি করেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন নোমালিগড় থেকে আমদানি করা তেল দিয়ে উত্তরাঞ্চলে একটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। পিডিবি বলছে, কয়েক বছর ধরেই সৈয়দপুর প্রতি ইউনিট বিদ্যুত ১৮ টাকা ও রংপুর ২১ টাকায় উৎপাদন করছে। এ বছর তা অত্যধিক বেড়ে গেছে। অপরদিকে বরিশাল কেন্দ্রটি প্রতি ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদন করছে ৫৭ টাকায়। বরিশালের কেন্দ্রটি গত কয়েক বছর ৩৬ টাকা ইউনিট দরে বিদ্যুত উৎপাদন করছে। তবে এ বছর ব্যয় বেড়েছে অত্যধিক। সরকার বরিশাল অঞ্চল ঘিরে বেশ কয়েকটি বেজ লোড বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে। এসব কেন্দ্র উৎপাদনে আসার পর ওসব কেন্দ্র বন্ধ করা উচিত বলে মনে করে সংশ্লিষ্টরা। তবে কেন্দ্রগুলো সরকারী হওয়ায় সেখানকার ব্যয় সংকোচনের চিন্তা খুব একটা করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
×