ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অভিনব কায়দায় দুই সহোদরের প্রতারণা

মালয়েশিয়ার জাল ভিসায় লাখ লাখ টাকা আত্মসাত

প্রকাশিত: ১০:২৫, ১৯ অক্টোবর ২০১৯

 মালয়েশিয়ার জাল ভিসায় লাখ লাখ টাকা আত্মসাত

গাফফার খান চৌধুরী ॥ মালয়েশিয়ায় বসে সেদেশের দূতাবাসের ওয়েবসাইটের আদলে হুবহু ওয়েবসাইট তৈরি করে জাল ভিসা দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়া একটি প্রতারক চক্রের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই। চক্রের হোতা দুই সহোদর বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। তারা মালয়েশিয়ান দূতাবাসের ওয়েবসাইটের আদলে হুবহু নকল ওয়েবসাইট বানিয়ে মালয়েশিয়ায় বসে নকল ভিসা দিয়ে অন্তত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিদেশে লোক পাঠানোর কথা বলে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্য একটি বিশাল সিন্ডিকেটও গড়ে তুলেছেন তারা। সিন্ডিকেটটি দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন হোটেলেও তাদের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। শুধু দুই ভাই নয়, তাদের পুরো পরিবারই এমন প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। আদালতের নির্দেশে একটি প্রতারণার মামলা তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার সূত্রপাত ২০১৭ সালের ২৮ জুন। নরসিংদী জেলার মাধবদী থানার বাসিন্দা মোঃ জহিরুল ইসলাম গিয়েছিলেন ভারতে বেড়াতে। ভারতে গিয়ে তিনি একটি হোটেলে উঠেছিলেন। সেই হোটেলেই পরিচয় হয় মাসুদ নামের এক বাংলাদেশীর সঙ্গে। হোটেলে থাকার সুবাদে তাদের মধ্যে সখ্য হয়। মাসুদ জানান, তিনি মালয়েশিয়ায় থাকেন। ভারতে বেড়াতে এসেছেন। তার আরেক ভাই মোবারকও মালয়েশিয়া থাকেন। সম্পর্ক আরও গাঢ় করার জন্য মাসুদ জহিরুলের বাড়িতেও যাতায়াত করেন দীর্ঘসময় যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। কিন্তু কোনদিনই মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর বিষয়ে কোন আলোচনা করেন না। জহিরুলই কয়েক বার মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো যাবে কিনা তা জানতে চান মাসুদের কাছে। মাসুদ বরাবরই তাতে আপত্তি করেন। বলেন, এসব ঝামেলার কাজ। আমরা ঝামেলার কাজ পছন্দ করি না। আর আমরা লোক পাঠাই না। বিদেশ লোক পাঠানো ঝামেলা। আর অনেক সময় দুর্নাম হয়। এতে স্বাভাবিক কারণেই জহিরুলের বিশ্বাস হয়। মূলত এটি ছিল মাসুদের আস্থা অর্জন করার কৌশল। অনেক দিন পর মাসুদ জহিরুলকে বলেন, শুধু তার পরিবারের কেউ থাকলে পাঠাতে পারবেন। অন্য কাউকে পাঠাবেন না। এতে জহিরুলের বিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত জহিরুল তার পাঁচ আত্মীয়কে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য জনপ্রতি চার লাখ টাকা করে ২০ লাখ টাকার চুক্তি করেন। জহিরুল ২০ লাখ টাকাই দিতে চায় মাসুদকে। মাসুদ টাকা নিতে রাজি হননি। তিনি নিজে টাকা নিবেন না বলে জানান। মূলত এসবই ছিল বিশ্বাস অর্জন করার ফন্দি। মাসুদ তার স্ত্রীর নামে টাকাগুলো দিতে বলেন। তাও আবার তাড়া নেই। যখন যেভাবে যত টাকা পারে দেবেন। সর্বশেষ ১৯ লাখ টাকা দেন জহিরুল। এদিকে মাসুদ মালয়েশিয়া চলে যান। সার্বিক বিষয়ে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে যান। গত বছরের ১৯ জুন জহিরুলের কাছে পাঁচটি ভিসা পাঠান। মাসুদ পরবর্তীতে ভিসাগুলো বাংলাদেশ পাসপোর্ট অফিসে নিয়ে গেলে সেগুলো জাল বলে প্রমাণিত হয়। এতে জহিরুল মহাবিপাকে পড়েন। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। পরে জহিরুল নিজের টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় যান। সেখানকার দূতাবাসে গিয়ে ভিসাগুলো জমা দেন। মালয়েশিয়া দূতাবাস থেকে ভিসাগুলো জাল বলে জানানো হয়। এরপর জহিরুল টাকার জন্য মাসুদকে চাপ দিতে থাকেন। মাসুদ সোজা জানান, তিনি কোন টাকা নেননি। এদিকে জহিরুল গ্রামের বাড়ি এসে মাসুদদের পরিবারের যাদের নামে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছেন, তাদের খোঁজখবর নেন। দেখেন বাড়িতে কেউ নেই। সবাই অন্যত্র চলে গেছেন। কোথায় গেছেন আজও তাদের হদিস মেলেনি। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই ঢাকা মেট্রোর উত্তরের বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ বশির আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, পরবর্তীতে ভুক্তভোগী জহিরুল মালয়েশিয়ায় দেশটির দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে। দূতাবাস কর্তৃপক্ষ জানান, মোবারক ও মাসুদ দুই ভাই মালয়েশিয়ান দূতাবাসের মতো ওয়েবসাইট তৈরি করেছে। সেই দূতাবাসের সিল দিয়ে জাল ভিসা পাঠানো হতো। পরে মালয়েশিয়ান দূতাবাসে যোগাযোগ করে প্রকৃত ওয়েবসাইট আইডি যাচাই করে দেখা যায়, দুই ভাই প্রতারণার জন্য দূতাবাসের ওয়েবসাইটের মতো হুবহু নকল ওয়েবসাইট তৈরি করে প্রতারণা করে আসছিল। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা মেট্রোর উত্তরের পরিদর্শক মোঃ কামাল হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, দুই ভাই আরও কোন দেশের দূতাবাসের ওয়েবসাইট নকল বানিয়েছে কিনা তা জানার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশে ও বিদেশে দুই ভাইয়ের থাকা সিন্ডিকেট সদস্যদের বিষয়ে তথ্য জানার চেষ্টা অব্যাহত আছে। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুদার জানান, এ ধরনের লোক বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করছে। বিদেশে দেশের শ্রমবাজার নষ্ট করছে। এজন্য তাদের শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। আদালত যদি তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে, তাহলে অভিযুক্ত দুই ভাইকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেডওয়ারেন্ট জারি করা হবে। ওয়ারেন্ট মোতাবেক তাদের গ্রেফতার করে দেশে এনে আদালতে সোপর্দ করা হবে।
×