ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আলোচনাসভায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী

নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাবে সরকার

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ১৮ অক্টোবর ২০১৯

নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাবে সরকার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করেই নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে চায় সরকার। তাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা গেলে ভবিষ্যতে তারা নির্যাতিত হয়ে এদেশে আসবে না। অতীতে একাধিকবার এদেশে আশ্রয় নিয়েছে তারা। নাগরিক অধিকার না থাকায় তাদের ফেরত পাঠানো হলেও নির্যাতন বন্ধ হয়নি। আর যাতে নির্যাতনের শিকার না হয় সেজন্য নাগরিক অধিকার ভোটাধিকার এবং সেদেশে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করছে সরকার। বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক আলোচনাসভায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি এসব কথা বলেন। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ‘রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : সরকার, নাগারিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ অধিবেশনের গুরুত্বের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু তুলে ধরেছেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশের একার নয়। এই অঞ্চলে নিরাপত্তার জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা একটি হুমকি। দীর্ঘ সময় ধরে তারা এদেশে অবস্থান করলে এদেশে সামাজিক অর্থনৈতিক সমস্যার জটিল হয়ে উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। মন্ত্রী বলেন, ’৭১ সালে যুদ্ধের সময় এদেশে অনেক শরণার্থী প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পরপরই সব শরণার্থী দেশে ফেরত এসেছে। তারা সেখানে কখনই থাকতে চায়নি। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মানসিকতা ফেরত না যাওয়ার। মিয়ানমারকে রাজি করানো হলো। ফেরত পাঠানোর দিনক্ষণ ঠিক হলো। কিন্তু নাগারিক অধিকারের দাবিতে তারা ফেরত যাওয়ার বিষয়ে বেকে বসল। তাদের নাগরিক অধিকারের বিষয়টি সরকার চায়। সরকারের একটাই কথা নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে হলেও রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে হবে। পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চত করে ফেরত পাঠাতে চায় সরকার। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারি না। চাই না যে সেখানে গিয়ে আবার নির্যাতনের শিকার হোক। মিয়ানমারের নাগরিকদের যে অধিকার লাভ করে থাকে, সেটা ফেরত যাওয়ার পরে রোহিঙ্গারাও যেন পায়। এই অধিকার নিশ্চিত হবে কিনা ফেরত যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক টিম তা মনিটর করবে। এখন যদি তারা অনিশ্চয়তার মুখে ফেরত যায় তাহলে তারা কোথায় থাকবে, কি করবে, কি খাবে। সেখানে তো তাদের বাড়িঘর নেই। ফেরত যাওয়ার আগে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, একটা চক্র ষড়যন্ত্র করছে, আরাকান বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করতে। সরকার সেই ষড়যন্ত্রকারী সম্পর্কে সচেতন রয়েছে। কারণ মিয়ানমারে কোন অংশ বাংলাদেশের হোক সরকার চায় না। রোহিঙ্গাদের নিয়ে মৌলবাদী চক্রও ষড়যন্ত্র করছে। তাদের জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করছে। সরকার এ বিষয়ে সচেতন রয়েছে। এর সঙ্গে যারা জড়িত রয়েছে সরকার তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মানবতার দোহাই দিয়ে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই মানবতার সুযোগ যেন কেউ অন্য কাজে লাগাতে না পারে। তিনি বলেন, অনেক এনজিও সেখানে কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের নামে কোটি কোটি টাকা আসছে বিদেশ থেকে। কিন্তু এই টাকা রোহিঙ্গাদের জন্য কতটুকু ব্যয় করছে, অন্য খাতে কি পরিমাণ ব্যয় করছে তারও খোঁজ-খবর সরকার নিচ্ছে। মৌলবাদী এই অপতৎপরতা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। মৌলবাদী অপতৎপরতা রুখে দেয়ার জন্য বিভিন্ন নাগরিক সমাজকে এর বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে হবে। অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্যে লেখক ও সাংবাদিক শাহারিয়ার কবির বলেন, সরকার মানবতার কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও এখন তারা টাকা পয়সা খরচ করে দেশে নাগরিকত্ব নেয়ার চেষ্টা করছে। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। ১২৫ এনজিওর বিরুদ্ধে মৌলবাদী তৎপরতা উস্কে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব এনজিওরা সবাই জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন কৌশলে জিহাদী তৎপরতারা উদ্বুদ্ধ করছে। রোহিঙ্গাদের একটা অংশ ১৯৭৮ সাল থেকে আরাকান এবং বাংলাদেশে পাবর্ত্য অঞ্চলসহ কিছু অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন মুসলিম ভূখ- গঠনের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। একাজেও উস্কে দিচ্ছে মৌলবাদী এনজিওরা। তারা জিহাদী তৎপরতায় উদ্বুদ্ধ করে বিভিন্ন দেশে জঙ্গী প্রশিক্ষণে পাঠাচ্ছে। এদেশে আশ্রয় নেয়ার পর অনেক রোহিঙ্গা এখন অস্ত্র পাচার ও নারী পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা দেশে থাকলে দেশে জনরিাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। দেশের যে উন্নয়ন অর্জন তাও ব্যাহত হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের স্থানীয় মানুষের শ্রম বাজার তারা নষ্ট করে দিয়েছে। পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য এবং জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে উঠছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেছেন কিন্তু চীন এসব প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে। চীনের আশায় বসে থাকলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে না। আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও রয়েছে তারা চায় এই সমস্যার সমাধান। কিন্তু বাংলাদেশের সেখানকার দূতাবাস তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে না। আবার বাংলাদেশে বৌদ্ধ প-িতদের সেদেশে কদর রয়েছে। সরকার চাইলে এদেশের বৌদ্ধদের কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু তা করছে না। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে যত পথ রয়েছে সব বিকল্প ব্যবহার করতে হবে। যদি তাও সম্ভব না হয় তাহলে তৃতীয় বিকল্প হিসেবে জাতিসংঘের মাধ্যমে অন্য কোন দেশে তাদের স্থানান্তরিত করতে হবে। বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের কার্যকরি সভাপতি ও মানবাধিকার নেতা অশোক বড়ুয়া বলেন, একজন বৌদ্ধ হিসেবে মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন মেনে নিতে পারিনি। তাদের ওপর যা হয়েছে সে দেশের তথাকথিত বৌদ্ধদের দ্বারা, তা গৌতম বুদ্ধের শান্তির বাণী ‘সকল প্রাণী সুখি হোক’ এর বিপরীত। বৌদ্ধ ধর্মে কখনও এই ধরনের নির্যাতন অনুমোদন করে না। রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠাতে বৌদ্ধ ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে মিয়ানমারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে। কারণ এই সমস্যায় এদেশে বসবাসরত বৌদ্ধরাও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। ২০১২ সালে রামুতে বৌদ্ধদের ওপর যে হামলা হয়েছে সেখানে অনেক রোহিঙ্গা জড়িত ছিল। তারপরও মিয়ানমারে অত্যাচারিত হওয়া এসব রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বৌদ্ধরা। অর্থ সংগ্রহ করে তাদের নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করা হয়েছে। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা জটিল করা হয়েছে। সেই ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে তাদের এখানে আনা হয়েছে, সেই একই ষড়যন্ত্র তাদের ফেরত পাঠাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ধর্মীয় অপশক্তি এদের পেছনে কাজ করছে। যারা ’৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। এই ষড়যন্ত্রকারীদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে উল্লেখ করেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মে. জে অব. মোহাম্মাদ আব্দুর রশিদ বলেন, মানবতার কারণে রোহিঙ্গাদের এদেশে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গারা এখন আর সেই জায়গায় নেই। এখন তাদের কর্মকা- বাংলাদেশ এবং এই অঞ্চলের নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিচারপতি শামসুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, বার্মার গণহত্যা ও সন্ত্রাস তদন্তে নাগরিক কমিশনের সদস্য জুলিয়ান ফ্রান্সিস।
×