ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোহামেডানের খোঁড়া দল আর ওয়ান্ডারার্সের কেবল সাইনবোর্ড

প্রকাশিত: ১২:২৩, ১৬ অক্টোবর ২০১৯

মোহামেডানের খোঁড়া দল আর ওয়ান্ডারার্সের কেবল সাইনবোর্ড

একটা সময় ঢাকার ফুটবলে রাজত্ব ছিল ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের। ১৯৫৬ সালে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের একজন প্রতিনিধি ও কিছু তারকা খেলোয়াড় ঢাকা মোহামেডানে যোগ দেন। নতুন দলের নৈপুণ্যে পরবর্তী বছরেই ১৯৫৭ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব জিতে নেয় প্রথম ঢাকা লীগ। সেইসঙ্গে জানান দেয় ঢাকার ফুটবলে রাজত্ব কায়েমের। দুই বছর ব্যবধান রেখে ১৯৫৯, ১৯৬১, ১৯৬৩ ও ১৯৬৫ সালে ঢাকা লীগের শিরোপা ঘরে তোলে সাদা-কালোরা। ষাটের দশক থেকে শুরু করে সত্তর ও আশির দশকে দেশের ফুটবলে চলতে থাকে মোহামেডানের রাজত্ব। ১১টি লীগ শিরোপা অন্তত সেটিরই সাক্ষ্য দেয়। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের জয়জয়কার শুধু দেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৯৫৯ সালে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা আগা খান গোল্ডকাপ জিতে নেয় মোহামেডান। ১৯৬৪ ও ১৯৬৮ সালে আরও দুইবার জয়লাভ করে এই টুর্নামেন্ট। মোহামেডানের দাপটে ওয়ান্ডারার্স শেষ পর্যন্ত হারিয়েই গেছে। দাপুটে সেই মোহামেডানেরও এখন একই হাল! সময়টা ১৯২৭ সাল। উপমহাদেশে তখন চলছিল ব্রিটিশদের শাসনামল। সে বছরের কোন একদিনে ঢাকার হাজারীবাগে এক নবাব পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাব। ১৯৩৬ সালে ক্লাবটি নাম পরিবর্তন করে হয়ে ওঠে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ১৯৪৭ সালে বাংলা বিভক্তির পরে তৎকালীন ঢাকায় খেলাধুলার ক্ষেত্রে শূন্যস্থান তৈরি হয়। সে সময় কলকাতা মোহামেডানের বিখ্যাত খেলোয়াড় মোহাম্মদ শাহজাহান ঢাকায় এসে ঢাকা মোহামেডানের হাল ধরেন। ভাঙ্গাচোড়া একটি দলকে ধীরে ধীরে গুছিয়ে তোলার প্রক্রিয়ায় লেগে থাকেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত বড় কোন সফলতার মুখ দেখেনি মোহামেডান। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশের ফুটবলে ঢাকা আবাহনীর উত্থান এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। শুরু হয় দেশের সেরা ফুটবল রাইভালরি। মোহামেডান বনাম আবাহনী কিংবা ঢাকা ডার্বি। নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে ১৯৭৪ ও ১৯৭৭ সালে লীগ হারানোর পরেও ১৯৭৫, ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮০ সালে লীগ জিতে নিজেদের দাপট বজায় রাখে। নব্বইয়ের দশকে ঢাকা ডার্বি পায় আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। সে দশকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের ৫টি লীগ শিরোপার বিপরীতে মোহামেডান জিতে নেয় ৪টি লীগ শিরোপা। পরবর্তী দশকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সমান ৩টি করে শিরোপা জিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। সর্বশেষ ২০০২ সালে লীগ শিরোপা জিতে রেকর্ড ১৯ বারের লীগ বিজয়ী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। দেশের ঘরোয়া কাপ বাংলাদেশ ফেডারেশন কাপেও মোহামেডান ১০ বারের বিজয়ী। যার ৬টি শিরোপাই এসেছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীকে হারিয়ে। এছাড়া ফেডারেশন কাপের প্রথম শিরোপা যৌথভাবে জিতে নেয় মোহামেডান। ২০০৯ সালে সর্বশেষ ফেডারেশন কাপ জিতে মোহামেডান। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশীয় ক্লাবগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ক্লাব ছিল মোহামেডান। যার প্রমাণ মিলে ১৯৮৮ সালে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লীগে দেশের প্রথম ক্লাব হিসেবে স্থান করে নেয়া। মোহামেডানের ইতিহাসটা কিন্তু সত্যিকার অর্থেই গৌরবময়। ইতিহাসটা শুরু হয় ১৯২৭ সালে, ব্রিটিশ শাসনামলে। ঢাকার হাজারীবাগে এক নবাব পরিবার ছিল ফুটবল অনুরাগী। তাদের হাত ধরেই প্রথম গড়ে ওঠে মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাব। ১৯৩৬ সালে ক্লাবটির নাম পরিবর্তন করে মুসলিমদের ধর্মপ্রবর্তক হযরত মুহম্মদ (সা)-এর নামানুসারে ক্লাবের নাম রাখা হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যেতে থাকে ক্লাব। তখন পূর্ব বাংলায় ফুটবল ততটা ছড়িয়ে পড়েনি, অবকাঠামো বেশ দুর্বল। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়। ঢাকার ফুটবলটা আরও বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এরপর কলকাতা মোহামেডান থেকে বিখ্যাত খেলোয়াড় শাহজাহান ঢাকায় এসে মোহামেডানের হাল ধরেন। তারপরও ক্লাবে তেমন কোন সফলতা আসেনি। তখন পূর্ব বাংলার ফুটবলে একক অধিপত্য বিস্তার করেছিলো ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। ১৯৫৬ সালে এ ক্লাব থেকেই কিছু খেলোয়াড় ও প্রতিনিধি এসে যোগ দেয় মোহামেডানে। এবার ফলটা একদম হাতে নাতে। সকলের প্রচেষ্টায় পরের বছরই প্রথমবারের মতো ঢাকা লীগ জিতে নেয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। শুরু হয় ঢাকার ফুটবলে মোহামেডানের রাজত্ব। এরপর পরপর ১৯৫৯, ১৯৬১, ১৯৬৩, ১৯৬৫ সালে ঢাকা লীগের শিরোপা ঘরে তোলে সাদা-কালোরা। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে তারা পাঁচবার জিতে নেয় স্বাধীনতা কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও রাজত্ব শুরু হয় মোহামেডানের। ১৯৫৯ সালে তারা জয় করে আগা খান গোল্ডকাপ। এটিই ছিল তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জয়। এরপর ১৯৬৪ ও ১৯৬৮, আরও দুইবার এ শিরোপা ঘরে তোলে মোহামেডান। ১৯৬৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৬ সালে হয় রানার্সআপ। ১৯৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠিত আশিস জব্বার শিল্ড টুর্নামেন্ট এ হয় চ্যাম্পিয়ন। ষাট, সত্তর, আশি- টানা তিন দশক ধরে চলতে থাকে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অধিপত্য। এ সময় তারা জিতে নেয় ১১টি লীগ শিরোপা। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামালের হাত ধরে উত্থান ঘটে ঢাকা আবাহনীর। আর প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে আকর্ষণীয় রাইভালরি মোহামেডান বনাম আবাহনী। যার অন্যনাম ঢাকা ডার্বি। নতুন এ প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে ১৯৭৪ ও ১৯৭৭ সালে লীগ শিরোপা হারায় মোহামেডান। কিন্তু ১৯৭৫, ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮০ সালে লীগ জিতে নিজেদের অধিপত্য বজায় রাখে সাদা-কালো শিবির। ঢাকা ডার্বি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায় নব্বইয়ের দশকে। সে সময় আবাহনীর পাঁচটি লীগ শিরোপার বিপরীতে মোহামেডান জিতে চারটি। পরের দশকে দুই দলই সমান তিনটি করে শিরোপা ঘরে তোলে। সর্বশেষ ২০০২ সালে রেকর্ড ১৯ বারের মতো লীগ জিতে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। এছাড়া ঘরোয়া ফেডারেশন কাপও মোহামেডান ১০ বার হাতে তুলেছে। তার মধ্যে ছয়বারই আবাহনীকে হারিয়ে। তাছাড়া প্রথম ফেডারেশন কাপও যৌথভাবে জিতে মোহামেডান। সর্বশেষ এ শিরোপা ঘরে এসেছে ২০০৯ সালে। তাছাড়াও পতনের দ্বারপ্রান্তে থেকেও ২০০৯ ও ২০১৩ সালে তারা জিতে নেয় সুপার কাপ। ১৯৭২, ১৯৯১ ও ২০১৪ - তিনবার তারা হাতে তুলেছে ইনডিপেনডেন্স কাপ। ২০১৪ সালের ইনডিপেনডেন্স কাপটি ছিল মোহামেডানের জেতা সর্বশেষ শিরোপা। এদেশীয় ক্লাবগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্লাব ছিল মোহামেডান। দেশের প্রথম ক্লাব হিসেবে ১৯৮৮ সালে এএফসি চ্যাম্পিয়নস লীগে দেশের প্রথম ক্লাব হিসেবে জায়গা করে নেয় তারা। বাংলাদেশের ক্লাবগুলোর মধ্যে এএফসি চ্যাম্পিয়নস লীগে রেকর্ড ছয়বার অংশগ্রহণ করেছে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলের অধিপতি মোহামেডানের একসময় শুরু হয় পতন। ২০০২ সালে সর্বশেষ লীগ শিরোপা জয়ের পরেই এই পতনের সূচনা। ২০০৩ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত শিরোপাশূন্য মৌসুম কাটায় তারা। এরপর ২০০৮ ও ২০০৯ সালে পরপর দুটি ফেডারেশন কাপ জিতে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেয় মোহামেডান। কিন্তু সেটা ইঙ্গিতই থেকে যায়। লীগের নাম পালটে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ হওয়ার পর এখন পর্যন্ত শিরোপার মুখ দেখেনি তারা। যেখানে নতুন নাম হওয়ার পর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর নামের পাশে যুক্ত হয়েছে ছয়টি লীগ শিরোপা, সেখানে মোহামেডানের নামের পাশে শুধুই শূন্যতা। এখন বাংলাদেশের লীগে যুক্ত হয়েছে আরও নতুন নতুন পাকাপোক্ত ক্লাব। আবাহনী ছাড়াও এখন আরও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইফ স্পোর্টিং, বসুন্ধরা কিংস, শেখ জামাল, শেখ রাসেল প্রভৃতি ক্লাব। এতসব ক্লাবের ভিড়ে মোহামেডান অনেকটা চোখের আড়ালেই চলে গেছে এবং যাচ্ছে। সবচেয়ে কষ্ট হয় তখন, যখন দেখি মোহামেডান কে অবনমন এড়াতে লড়তে হয়। মোহামেডানের মতো ক্লাবের জন্য এর চেয়ে যন্ত্রণার আর কি হতে পারে! বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এখন অবধি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মোহামেডানের মতো হয়ে উঠতে পারেনি আর কোন ক্লাব। বাংলাদেশের ফুটবলের প্রতিনিধি যেন হয়ে উঠেছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। মোহামেডানের সেই কীর্তি শুধু শিরোপাতেই সীমাবদ্ধ নয়। বাঙালী ফুটবল আবেগের সঙ্গে মিশে আছে মোহামেডান। প্রার্থনা করি খুব দ্রুতই মোহামেডান তার আগের রূপ ফিরে পাবে, ফিরে পাবে তার সেই পুরোনো জৌলুস। তবে বর্তমানে যে অবস্থা তাতে বাংলাদেশে ফুটবল জাগরণে দুই ঐতিহ্যবাহী দল মোহামেডান-আবাহনীর বিকল্প নেই। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে এই ধ্রুব সত্য কথাটা একটু বেমানানই লাগতে পারে। কিন্তু অনেকের কাছেই এটা নির্জলা সত্য। এজন্য অবশ্য এই প্রজন্মকে দোষারোপ করা যাবে না। কারণ বর্তমানে মোহামেডান-আবাহনী খেলার ধারা প্রমাণ করছে তারা যেন কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে। এ কারণে ফুটবল কর্মকর্তাদের উচিত, এই দুই জনপ্রিয় দল সম্পর্কে এবং এই দু’দলের খেলা, জনপ্রিয়তা ও ইতিহাস সঠিকভাবে বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা। বাংলাদেশ ফুটবলের ইতিহাস দুটি ভাগে বিভক্ত। স্বাধীনতা পূর্ব এবং স্বাধীনতা উত্তর। ঢাকা মোহামেডানের জন্ম সেই ১৯৩৬ সালে। যার সমর্থন শুধু মাত্র ঢাকাব্যাপী নয়, তৎকালীন সারা পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে। স্বাধীনতা পূর্ব সময় পর্যন্ত সাদা-কালোদের মূল প্রতিপক্ষ ছিল ওয়ান্ডারার্স, পাঁচবারের লীগ চ্যাম্পিয়ন তৎকালীন ইপিআইডিসি, পরবর্তীতে বিজেএমসি ও ভিক্টোরিয়া। তবে নিজস্ব সমর্থক সৃষ্টি করতে পেরেছিল কেবল ঢাকা মোহামেডান। তবে একেবারে পিছিয়ে ছিল না ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবও। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে উত্থান ঘটে ঢাকা আবাহনীর। বলা চলে আধুনিক ফুটবলের জনক আকাশী-হলুদ জার্সিধারীরা। দলটি শুরুতেই পেয়ে যায় বিদেশী জার্মানি বেকল হপ্টের মতো সুদক্ষ প্রশিক্ষককে। তার নিপুণ প্রশিক্ষণে আবাহনী হয়ে উঠে দুর্র্ধর্ষ। ছোট ছোট পাশে খেলার তালিম দেন তিনি, আবাহনী দলের সবাই তাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। দৃষ্টিনন্দন ফুটবলশৈলীর কারণে হু হু করে বেড়ে যায় দলটির দর্শকসংখ্যা। এত দ্রুত দর্শক জনপ্রিয়তা আর অন্য কোন ক্লাবের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।
×