ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিশের অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ১৬ অক্টোবর ২০১৯

ইলিশের অর্থনীতি

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রুপালি ইলিশের অবদান অনস্বীকার্য এবং দেশে যে পরিমাণ মাছ বছরে উৎপাদিত হয় তার ১১ শতাংশই আসে ইলিশ থেকে। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশ উৎপাদনের অংশ শতকরা ১৫ ভাগ ও সারা বিশ্বের মোট ইলিশ উৎপাদনের ৭৫ শতাংশ আহরিত হয় বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারসহ আরও কয়েকটি দেশে ইলিশের উৎপাদন রয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদ রুপালি ইলিশের আহরণ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও রফতানিসহ এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছে দেশের প্রায় ২০ লাখ থেকে ২৫ লাখ মানুষ। বাঙালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য উপাদান হলো ইলিশ। ত্রিশের দশকের স্বনামখ্যাত সাহিত্যিক, কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসু ইলিশকে অভিহিত করেছেন জলের রুপালি শস্য হিসেবে এবং ইলিশকে নিয়ে এই সাহিত্যিকের অনেক গল্প ও কবিতা রয়েছে। রুপার পাতে মারে ঘা, পানির বুকে ফেলল পা-এ ধাঁধার উত্তর ইলিশ। রসনা বিলাসী বাঙালীর কথা, কাব্য, ইতিহাসে আছে ইলিশের উপস্থিতি। অষ্টাদশ শতকের বিভিন্ন রচনাতেও ইলিশের বিবরণ পাওয়া যায়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মা ইলিশ ডিম দেয়। কবি সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত এই বৃষ্টির নাম দিয়েছেন ইলশেগুড়ি। প্রাণ-প্রকৃতির কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়Ñ বৃষ্টির সঙ্গেও তাই ইলিশের আছে মাখামাখি। অশোকের পঞ্চম স্তম্ভলিপিতে বছরে ৫১-৭২ দিন ডিমওয়ালা মাছ ও ছোট মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, পৌষ মাসের শুক্লা চতুর্দশী, পূর্ণিমা এবং অমাবস্যা ও অষ্টমীর দিনগুলোতে বছরে কমপক্ষে ৫২ থেকে ৭২ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। সরস্বতী ও লক্ষ্মী পূজায় জোড়া ইলিশকে ধরা হয় শুভ লক্ষণ। দশমীতে তাই উৎসব জমে জোড়া ইলিশেই। ইলিশ উৎসর্গ ছাড়া অনেক পূজাই অসম্পূর্ণ থাকে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝি ইলিশ ধরা জেলেদেরই জীবনের গল্প। জীবন ঘনিষ্ঠ লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপন্যাসটি লেখার জন্য দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন পদ্মার বুকে। ইলিশের ব্যতিক্রমী জীবন চক্রের সঙ্গেও তুলনা চলে না অন্য কোন মাছের। এই সমুদ্র শাবক মাছ জালে ধরা পড়ার পর ডাঙ্গায় তুললে আর বাঁচে না। এই জন্য প্রবাদ আছে আড়াই লাফে মরে ইলিশ। ইলিশের মধ্যে হরিণের মাংস আছে- এমন গল্পও মাছের সঙ্গে ভাত মেখে বাঙালী মেয়েরা তাদের সন্তানদের শোনায়। ডাঙ্গার হরিণ আর জলের ইলিশ নিয়ে এমন গল্প অন্য কোন মাছের বেলায় আর ঘটেনি। নন্দিত নরকের আখ্যানকার হুমায়ূন আহমেদও ইলিশ নিয়ে লিখেছেন। কেমন করে যেন বাঙালী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ঢুকে গেছে পান্তা ইলিশের প্রতি ঝোঁক। দেশের বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে ইলিশের জীবন রহস্য উদঘাটন করেছেন। মৎস্য অধিদফতরের তথ্য মতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে ৫ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে যা আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৯-১০ শতাংশ হারে বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। গত নয় বছরের ব্যবধানে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। আগামী মৌসুমে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে ৬ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে যার বাজার মূল্য ১৮ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক ইলিশ এবং ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এই মাছ যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের এক সুদূর প্রসারী সাংস্কৃতিক অর্জন। প্যাটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদফতরের সূত্রের মতে জিওগ্রাফিক্যাল ইনডেক্স বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ইলিশ মাছের নাম নিবন্ধন ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ইলিশ এখন বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। সাম্প্রতিককালে ৬৮৩০৫৬৮ মেট্রিক টন ইলিশ রফতানি করে ৪২৮৭.৬৪ কোটি টাকার সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সরকারের মৎস্য অধিদফতর নানামুখী পদক্ষেপের ফলেই ইলিশের এই উল্লেখযোগ্য উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জ রয়েছে যেমন কারেন্ট ও বেহুন্দি জাল দিয়ে মাছ ধরা। যদিও সরকার জাটকার ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা রেখেছে। এ অবস্থায় জাটকা ইলিশ ধরব না, দেশের ক্ষতি করব নাÑ প্রতিপাদ্য নিয়ে প্রতি বছর পালিত হয় ইলিশ রক্ষা সপ্তাহ। এর জন্য মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় ৯০০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে সাড়া দেশে ইলিশ আহরণ স্থানগুলোতে অভিযান চালিয়ে এসব অবৈধ জাল পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং নিষিদ্ধ মৌসুমে জেলেদের দেয়া হয় প্রণোদনা। মৎস্য অধিদফতরের মতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে ইলিশের পাঁচটি অভয়াশ্রম রয়েছে। যেমন চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজেন্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর অববাহিকায় ১০০ কিলোমিটার, ভোলার মদনপুর থেকে চর পিয়াল পর্যন্ত শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার, ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালীর চর রুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার এবং শরীয়তপুরের নড়িয়া ভেদরগঞ্জ উপজেলার অংশ পদ্মার ২০ কিলোমিটার। এর পাশাপাশি চট্টগ্রামের মিরসরাই ও কক্সবাজারের কতুবদিয়া এলাকা ইলিশ প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। বিদ্যমান পাঁচটি ইলিশ অভয়াশ্রয় ব্যবস্থাপনাকে গতিশীল করতে বেশ কিছু কার্যক্রমে পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন জেলেদের মাধ্যমে আদর্শ মৎস্যজীবী গ্রাম পতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে, জাটকা আহরণকারী ৪০ হাজার জেলে পরিবারের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, মৎস্য সংরক্ষণ আইনের আওতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান জোরদার করা হয়েছে ইত্যাদি। এসব কর্মসূচী বাস্তবায়িত হলে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে এবং পাশাপাশি নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে। এখন ইলিশের সামাজিকতা নিয়ে কিছু প্রসঙ্গ টানা যাক। ইলিশ খেতে পছন্দ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ইলিশের স্বাদের জুড়ি নেই। তবে প্রকৃত ইলিশের স্বাদ পেতে হলে ইলিশ দেখে কিনতে হয় এবং সবচেয়ে বিখ্যাত পদ্মার ইলিশ যা খুব সুস্বাদু। কারণ পদ্মা মেঘনা অববাহিকার ভিন্নধর্মী খাবার এবং পানির প্রবাহের ফলে শরীরে উৎপন্ন হওয়া চর্বিই এখানকার ইলিশের স্বাদকে অন্য যে কোন জায়গায় ইলিশের চেয়ে ভিন্ন করেছে। পদ্মার ইলিশ সম্পর্কে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইলিশ বিষয়ক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিসুর রহমান বলেন (১) ইলিশ সারা বছর সাগরে থাকলেও শুধু ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে। নদীর ইলিশ একটু বেটেখাটো এবং সাগরের ইলিশ হবে সরু ও লম্বা; (২) পদ্মা নদীর ইলিশ একটু বেশি উজ্জ্বল নদীর গায়ে রং চকচকে ও বেশি রুপালি হয়। অন্যদিকে সাগরের ইলিশ তুলনামূলক কম উজ্জ্বল; (৩) পদ্মা মেঘনা অববাহিকার ইলিশ মাছের আকার হবে পটোলের মতো অর্থাৎ মাথা আর লেজ সরু আর পেটটা মোটা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে লেজের একটু উপর থেকে মাছটা গোল হতে শুরু করে; (৪) ইলিশের আসল পার্থক্য বোঝা যাবে খাওয়ার সময়। পদ্মার ইলিশের যে স্বাদ আর গন্ধ তার সঙ্গে অন্য কোন নদীর বা সাগরের মাছের তুলনাই চলে না। ইলিশ মাছ অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের আঁধার। ইলিশের রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এ্যাসিড যা মানব দেহের খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে হ্রদরোগের ঝুঁকি কমায়। এ ছাড়াও রয়েছে এ্যমিনো এ্যাসিড, ভিটামিন এ এবং ডি। মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও ঝুঁকিবিহীন পুষ্টির উৎস এই মাছ। তাছাড়া ইলিশের আমিষে ৯ ধরনের এমিনো এ্যাসিড পাওয়া যায় যা মানুষের পাকস্থালীর কোন ক্ষতি করতে পারে না। তাই ইলিশ স্বাস্থ্যবান্ধব হিসেব খুবই পরিচিত। মা ইলিশ নিধন রোধে এবং ইলিশের অবাদ প্রজনন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় ৯ থেকে ৩০ অক্টোবর ২২ দিন ইলিশ প্রজনন এলাকায় সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ রেখেছে। এই সময়ে ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্রের চারটি পয়েন্ট দ্বারা বেষ্টিত ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার দাঁড়া বেষ্টিত সব নদীতে এ নিষেধাজ্ঞা বলবত থাকবে। এ মাছের চাহিদা রয়েছে পৃথিবীর জুড়েই। প্রজনন মৌসুমে মা ও জাটকা ইলিশ বন্ধ থাকলে ২১ থেকে ২৪ পরিপক্ব ইলিশ পাওয়া যাবে যা থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ইলিশের বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার, মৎস্যজীবী ও জনগণের প্রচেষ্টার ফলেই রুপালি ইলিশে ভরপুর হবে বাংলাদেশ। লেখক : ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিটি ইউনিভর্সিটি
×