ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শীতলক্ষ্যায় এখনও পালতোলা নৌকা

পারের কড়ি- দশ পয়সা থেকে পাঁচ টাকা, ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন মাঝিরা

প্রকাশিত: ১১:১৬, ১৫ অক্টোবর ২০১৯

পারের কড়ি- দশ পয়সা থেকে পাঁচ টাকা, ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন মাঝিরা

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ পালতোলা নৌকা নিয়ে রয়েছে কত স্মৃতি, কত গান। যেমন ‘নাইয়ারে নায়ের বাদাম (পাল) তুইলা কোন্্ দূরে যাও চইলা/মাঝি নাও ছাইড়া দে, মাঝি পাল উড়াইয়া দে/দে দে পাল তুলে দে, মাঝি হেলা করিস না, ছেড়ে দে নৌকা আমি যাবো মদিনায়/জীবনের নৌকা চলে হেলেদুলে পাল তুলেÑ’ এ ধরনের নানা ধরনের ভাটিয়ালি গানের মাঝেও পালতোলা নৌকার নানান স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। এ ধরনের গান শুনলেই মনকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই পালতোলা নৌকার দিনগুলোর নানান স্মৃতিতে। অথচ সেই পালতোলা নৌকা গ্রামবাংলা থেকে এখন হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময়ে বড় বড় পালতোলা নৌকা দিয়ে নদীপথে মালামাল আনা-নেয়া হতো। সেই পালতোলা নৌকা ছিল গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। সারি সারি পালতোলা নৌকা নদীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত। এখন আর সেই পালতোলা নৌকা আগের মতো দেখা যায় না। কালের বিবর্তনে সেই পালতোলা নৌকা গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে গেছে। অনেকের কাছে সেইসব নৌকা এখন শুধু স্মৃতি। তবে, প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ বাজার ঘাট ও সোনারগাঁয়ের কাঁচপুরের কুতুবপুর ঘাটে এখনও শান্ত শীতলক্ষ্যা নদীতে ছোট ছোট দু’একটা পালতোলা নৌকা (কোসা নৌকা) চলতে দেখা যায়। এসব নৌকা দিয়ে এখন শুধু লোকজন পারাপার হচ্ছে। দুটি ঘাটের মধ্যে পারাপারের নৌকার পাল হালকাচালে বাতাসের সঙ্গে দুলে। আর পালের হাওয়ায় হেলেদুলে মনের আনন্দে পার হচ্ছে শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার লোকজন। এই স্মৃতি এখানকার মাঝিরা আজও ধরে রেখেছেন। মাঝিদের হাতে আজও সেই ঐতিহ্যবাহী বৈঠা। নৌকায় পাল তুলে তারা মনের আনন্দে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার লোকজনকে নদী পার করছেন। সোনারগাঁয়ের কাঁচপুরের কুতুবপুরের বাসিন্দা মোঃ আনোয়ার হোসেন (৩৭) নৌকার মাঝি। তিনি কুতুবপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জ বাজার ঘাটে দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে পাল তোলা নৌকায় লোকজন পারাপার করছেন। শুধু আনোয়ার হোসেনই নন। তার মতো আরও ২৭ জন মাঝি পালতোলা নৌকা দিয়ে নদী পারাপার করেন। এ দু’টি ঘাটে বর্তমানে ২৭ কোসা নৌকা রয়েছে। এ নৌকাগুলো বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল তুলে নদী পারাপারে ব্যস্ত সময় পার করছে। মাঝি আনোয়ার হোসেন তিনি লোহা কাঠ দ্বারা দুই বছর আগে এক লাখ বিশ হাজার টাকা দিয়ে একটি কোসা নৌকা তৈরি করেছেন। এ নৌকাটি দশ বছর চলবে। মাঝে মাঝে নৌকার তলানী পরিবর্তন করতে হয়। আনোয়ার হোসেনের এটি বাপ-দাদার পেশা। তার বাবা মৃত শুক্কুর আলীও এ ঘাটের মাঝি ছিলেন। আনোয়ার হোসেন তেমন লেখাপড়া করতে পারেননি। তাই তিনি এ পেশায় থেকেও তার ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। তিনি জানান, পালতোলা নৌকা এক সময়ের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ছিল। জন্মের পর থেকেই এ শীতলক্ষ্যা নদীতে বড় বড় পালতোলা নৌকা চলতে দেখেছেন। সেই পালতোলা নৌকা এখনও শুধুই স্মৃতি। কিন্তু কুতুবপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জ বাজার ঘাটে ছোট আকৃতি হলেও পালতোলা নৌকার ঐতিহ্য ধরে রেখেছি আমরা। অন্য ঘাটগুলোতে নৌকায় ইঞ্জিন লাগানো হলেও আমরা এ ঘাটের নৌকায় কেউ এখনও ইঞ্জিন লাগাইনি। তিনি বলেন, নৌকায় ইঞ্জিন লাগানো হলে পালতোলা নৌকার যে ঐতিহ্য আমরা ধরে রেখেছি সেটা আর থাকবে না। আমরা পালতোলা নৌকার স্মৃতি ধরে রাখতে চাই। এ পালতোলা নৌকা চালিয়ে একজন মাঝি প্রতিদিন ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা আয় করেন। এ আয় দিয়েই তাদের সংসার চলে। আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রতিদিন দু’ শিফটে ২৭ কোসা নৌকা চলে। ভোর ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত প্রথম শিফ্্ট ও বেলা ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দ্বিতীয় শিফ্্ট। তিনি বলেন, শীতলক্ষ্যা নদীতে বড় বড় তেলের জাহাজ, বালুবাহী বাল্কহেডসহ নানা ধরনের নৌ-যান চলাচল করে। যেহেতু আমাদের নৌকাটি পাল তুলে ও বৈঠায় চলে তাই এটি ধীরগতিতে চলে। ফলে আমাদের অনেক সতর্ক হয়ে নৌকা চালাতে হয়। একই এলাকার বাসিন্দা জাকির হোসেন (৫০)। তিনি জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই নৌকা চালাচ্ছেন। তিনি দেখেছেন, বহু বছর আগে মাত্র দশ পয়সা দিয়ে মানুষ নৌকা পার হয়েছে। বর্তমানে ৫ টাকা দিয়ে পার হচ্ছেন। তিনি জানান, সাত বছর আগে তিনি নৌকা ছেড়ে ব্যাটারিচালিত অটো কিনে চালিয়েছেন। কিন্তু বিধিবাম তিনি দুই গাড়ির মাঝে চাপা পড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। দীর্ঘ আড়াই মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এতে তার প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তবুও তিনি তার ডান পা রক্ষা করতে পারেননি। একটি পা তাকে কেটে ফেলতে হয়েছে। এখন তিনি পঙ্গত্ব বরণ করেছেন। এরপর আবারো তিনি মাঝির পেশায় ফিরে আসেন। এখন তিনি জীবনের শেষদিনটি পর্যন্ত নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে চান। জাকির হোসেন বলেন, তার বাবা মৃত শামসুদ্দিন ও দাদা মৃত মাসুদ আলীও মাঝি ছিলেন। তিনি বলেন, জন্মের পর থেকে এ ঘাটে পালতোলা নৌকা দিয়ে নদী পার হতে দেখেছি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের মার্কা নৌকা, শেখ হাসিনার মার্কা নৌকা। আমরা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে সেই নৌকাই চালাচ্ছি। এছাড়াও এখন নৌকায় পাল তুলেই নদী পারাপার করছি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমার একটি পা নেই। যদি কোন সহৃদয় ব্যক্তি বা সরকার একটি কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন তবে আমি অনেক কৃতজ্ঞ হতাম। একই এলাকার ঘাটের মাঝি সাহেব আলী (৭১) বলেন, আমি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে নৌকা বেয়ে জীবিকা নির্বাহ করছি। তবে বাতাস থাকলে পাল তুলে নৌকা চালাই। আর যদি বাতাস না থাকে তবে হাতে বৈঠা বেয়ে নৌকা চালাচ্ছি। তিনি বলেন, প্রতিজনের ভাড়া পাঁচ টাকা। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য দুই টাকা নৌকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। একই এলাকার বাসিন্দা মোঃ নিসমান (৫০) পঁয়ত্রিশ বছর ধরে নৌকা চালাচ্ছেন। তার বাপ-দাদার পেশা এটি। তিনি বলেন, এখনও এ ঘাটে পালতোলা নৌকার ঐতিহ্য আমরাই ধরে রেখেছি। জানি না কতদিন এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারব। তবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পালতোলা নৌকার ঐতিহ্য রক্ষার জন্য সংগ্রাম করে যাব।
×