ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকল্পভুক্ত হচ্ছে সিলেট বিভাগের ৪ জেলা

জলবায়ুর বিরূপতা মোকাবেলায় ৩৭০০ হেক্টরে বনায়ন

প্রকাশিত: ১১:০৯, ১৫ অক্টোবর ২০১৯

জলবায়ুর বিরূপতা মোকাবেলায় ৩৭০০ হেক্টরে বনায়ন

ওয়াজেদ হীরা ॥ সারা বিশে^ই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে দেশেও। সরকার ইতোমধ্যে এই প্রভাব মোকাবেলায় নানা ধরনের উদ্যোগও নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় এবার সিলেট বিভাগে বনায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সিলেটের চার জেলায় এই বনায়নের প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে সরকার। বনভূমির পরিমাণ বাড়িয়ে কার্বন ধারণক্ষমতা বাড়ানো যাবে। পাশাপাশি মিশ্র প্রজাতির বাগান তৈরির মাধ্যমে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশে^র যেসব দেশ ঝুঁকিপূর্ণ তার মধ্যে বাংলাদেশ ৬ষ্ঠ অবস্থানে। ভৌগোলিক অবস্থান ও ব-দ্বীপ প্রধান দেশ হওয়ার কারণে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় অন্যতম বাংলাদেশ। তবে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন ও এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘ ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এই ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস সম্প্রচার, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন, উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারী মানুষকে যথাসময়ে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর, দ্রুত ত্রাণ সামগ্রী সরবরাহ, উপকূলীয় বাঁধ তৈরি, লবণাক্ত ও খরা সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন, বাঁধ ও বাঁধ সংলগ্ন চর এলাকায় বনায়নের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী সৃষ্টি, জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন ইত্যাদি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নতুন করে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিরসনে সিলেট বন বিভাগে পুনর্বনায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অধীন বন অধিদফতর এটি বাস্তবায়ন করবে। মন্ত্রণালয় মনে করছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বনভূমির পরিমাণ বাড়িয়ে কার্বন ধারণক্ষমতা বাড়ানো যাবে। পাশাপাশি মিশ্র প্রজাতির বাগান তৈরির মাধ্যমে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা সম্ভব হবে। ১৩ অক্টোবর আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস-২০১৯ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নিজস্ব অর্থায়নে তহবিল গঠন করা এবং বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশ নামের ব-দ্বীপকে টিকিয়ে রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যাতে এটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ প্রণয়নের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সুদূরপ্রসারি, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়েছি। আগামী প্রজন্মের জীবন যেন সুন্দর হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের এ পরিকল্পনা। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ এই চার জেলায় বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটির খরচ ধরা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্প প্রস্তাব পাওয়ার পর চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দেয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠন করা হয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি উপস্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে। অনুমোদন পেলে চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সিলেট বিভাগে মোট ভূমির ৭০ হাজার ৩২১ দশমিক ৬২ হেক্টর বনভূমি সিলেট বন বিভাগ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ অঞ্চলে বন বিভাগের প্রধান চ্যালেঞ্জ ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যতের জন্য কাঠ, জ্বালানি ও ঘাসজাতীয় বনজদ্রব্যের জোগান নিশ্চিত করা। পাশাপাশি ক্ষয়িষ্ণু বন সংরক্ষণও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এদিকে, এই এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বিরান পাহাড়ী বনভূমি রয়েছে, যেখানে নতুন বাগান তৈরির সুযোগ রয়েছে। এসব জায়গায় প্রাকৃতিক বনাঞ্চল সমৃদ্ধ করা, প্রাকৃতিকভাবে গজানো চারা সংরক্ষণ, উডলট বাগান, সড়ক বনায়ন, রিডল্যান্ড বনায়ন, আগর বাগান তৈরি, বাঁশ, বেত ও মূর্তা বাগান পদ্ধতিতে নতুন বাগান তৈরি সম্ভব। সেক্ষেত্রে সিলেট অঞ্চলে বনভূমির জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ করা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ নিশ্চিত করা, স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বনায়নে সম্পৃক্ত করে তাদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের মতো উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতেই প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। এর যে ক্ষতি বা নেতিবাচক দিক আছে সেটি ভেবেই আগাম প্রস্তুতি নিতে হয়। জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলায় নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হচ্ছে বলা যায়। আর এই প্রকল্পও সেই ধরনের একটি প্রস্তুতি। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ৩ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে বনায়ন; বিভাগীয় বন কর্মকর্তার জন্য একটি কার্যালয়, একটি এসিএফ অফিস, চারটি রেঞ্জ অফিস ও আটটি বিট অফিস নির্মাণ; ১৯টি জলাভূমি উন্নয়ন; এক হাজার মিটার আরসিসি রোড, পাঁচটি কালভার্ট ও ৩০০ মিটার সাইড ড্রেন নির্মাণ এবং ১৬টি এয়ারকুলার, ১২টি পানির পাম্প, তিনটি ফটোকপিয়ার মেশিন, পাঁচটি জেনারেটর, পাঁচটি কম্পিউটার, একটি জিপ, একটি পিকআপ, ১০টি মোটরসাইকেল ও পাঁচটি ইঞ্জিনযুক্ত নৌকা কেনা। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য মোঃ জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন ধরনের বনায়ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হবে। ফলে সিলেট অঞ্চলে বনজ সম্পদ বাড়বে, একইসঙ্গে বন্যপ্রাণীর সংখ্যাও বাড়বে। নতুন বন তৈরি হলে একটি জলবায়ু সহিষ্ণু স্থিতিস্থাপক বনে পরিণত হবে, মোট বনের পরিমাণ বাড়বে এবং বনজ সম্পদ আহরণের পরিমাণ বাড়বে। এছাড়া বনজ সম্পদের স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করাও সম্ভব হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য বনাঞ্চল বাড়ানোর কথা বলা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার মতো সরকারের এই ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচীগুলোতে সরকার অধিক গুরুত্ব দেয়। তবে যারা বাস্তবায়ন করে তারাও যেন সরকারের গুরুত্ব উপলব্দি করে বাস্তবায়ন করে। অন্যথায় প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে।
×