ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যশোরে পলি হাউজে ফুল সবজি চাষ

অসময়ের ফুল সবজি পাওয়া যাবে সারা বছর

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১৪ অক্টোবর ২০১৯

অসময়ের ফুল সবজি পাওয়া যাবে সারা বছর

সাজেদ রহমান, যশোর অফিস ॥ শীতের ফুল এবং সবজি মিলছে গরমেও। আবার গরমের সবজি ও ফুল মিলছে শীতেও। এর ফলে অসময়ে চাষিরা যেমন দু’পয়সা লাভের মুখ দেখছেন, তেমনই ক্রেতারাও সারা বছরই টাটকা সবজি ও ফুল পাচ্ছেন। ইউরোপে ব্যবহৃত পদ্ধতি অনুযায়ী লোহার পাইপের খুঁটির উপরে ও চারদিকে ২০০ মাইক্রনের পলিথিন দিয়ে ‘পলি-হাউস’ গড়ে চাষ, এই প্রল্পের অন্যতম বিশেষত্ব। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার কয়েকটি গ্রামে ৭ জন কৃষক ‘পলি হাউজে’ সবজি এবং ফুল চাষ করছে। এতে অন্যান্য গ্রামের কৃষকরাও আগ্রহ প্রকাশ করছেন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) সেচ বিভাগের বাস্তবায়নে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলায় ফুল ও সবজি উৎপাদন সম্প্রসারণে ড্রিপ ইরিগেশন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে সাত কোটি ছয় লাখ টাকা। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সৌরচালিত ডাগ ওয়েল, ড্রিপ ইরিগেশন ও ফ্লাওয়ার শেড নির্মাণ। ফলে কর্মসূচি অঞ্চলে কৃষিতে খরচ ও ঝুঁকি কমায় লাভবান হচ্ছে কৃষক। ২০১৭ সালের জুন মাসে শুরু হওয়া এই কর্মসূচির আওতায় ফুলের রাজধানীখ্যাত উপজেলার গদখালী, পানিসারা, নাভারণ, শিমুলিয়া ও নির্বাসখোলা ইউনিয়নে ১৫টি সৌরচালিত ডাগ ওয়েল ও ড্রিপ ইরিগেশন এবং সাতটি পলি শেড নির্মাণ করা হয়। এই কর্মসূচির এক্সক্লুসিভ ইঞ্জিনিয়ার মো. মাহাবুব আলম। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। ২০২২ সালের জুন মাসে কর্মসূচির মেয়াদ শেষের আগেই সব কাজ সম্পন্ন হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা। সরেজমিনে কথা হয় পানিসারা গ্রামের ফুল চাষি ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, এই কর্মসূচির আওতায় তাঁকে ১০০৮ বর্গফুটের একটি পলি শেড, সৌরচালিত ডাগ ওয়েল ও ড্রিপ ইরিগেশনের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। পলি শেডে জারবেরা ও গোলাপ ফুল, তরমুজ এবং এসকস চাষ করেছেন। শেডে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ থাকায় ঝুঁকি কম। কীটনাশকের খরচ ৭০ শতাংশ কম বলে দাবি করেন কৃষক ইসমাইল। বিএডিসি’র উদ্যোগে উন্নত কৃষি-কৌশল সম্পর্কে অবহিত করতে এখানকার চাষিদের ইতোমধ্যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সেখানে চাষিরা পলি-হাউসের মাধ্যমে চাষাবাদের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছেন। পলি-হাউস বানানো খরচসাপেক্ষ বলে সরকার এই প্রকল্পে ভর্তুকি দিচ্ছে। যশোরে প্রথম এই প্রকল্পে ৭জন কৃষককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেখানে প্রায় ৭ বিঘা জমিতে তারা সবজিও ফুল উৎপাদন করছে। কৃষিবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, পলি-হাউস পদ্ধতিতে চারদিকে প্লাস্টিকের ছাউনি থাকায় সূর্যের তাপ সরাসরি খেতে ঢুকতে পারে না। ফলে, শীতের সব্জি গরমেও চাষ করতে অসুবিধা হয় না। এই পদ্ধতিতে পানির অপচয় ঠেকানো হয়। সার দেওয়া হয় নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে। প্লাস্টিকের চাদর থাকায় দুর্যোগের প্রকোপও অনেকটা ঠেকানো সম্ভব হয়। সব মিলিয়ে পলি-হাউস পদ্ধতিতে ফসলের অন্তত ২০ শতাংশ ফলন বেশি হয় বলে দাবি কৃষি বিশেষজ্ঞদের। যেসব চাষি পলি-হাউস পদ্ধতিতে চাষ করছেন, তাদের দেখাদেখি অন্য কৃষকরাও এখন আগ্রহী হয়ে উঠছে। ঝিকরগাছার পাটুয়াপাড়ার চাষি মঞ্জুরুল আলম বলেন, শীতকালে দিন পনেরোর ব্যবধানে সমস্ত সবজি বাজারে চলে আসে। ফলে তখন সবজির দাম কম থাকে। শীতের সময় কিছু-কিছু সবজির দাম প্রায় পাওয়াই যায় না। তিনি আরও জানিয়েছেন, অগ্রহায়নের মাঝামাঝি টমেটো তুলে কেজি প্রতি ২০/২৫ টাকা দর পেতেন। কিন্তু পলি-হাউসে টমেটো করে জৈষ্ঠ্য মাসের প্রথম দিকে বাজারে গড়ে ৪০/৫০ টাকা করে প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি করতে পারবেন। ফুল চাষেও ভাল ফল দিচ্ছে ‘পলি হাউস’ পদ্ধতি। বিয়েবাড়ি বা অনুষ্ঠানের মঞ্চ সাজাতে ব্যবহৃত জারবেরা ফুল যেমন। সাধারণত শীতের মৌসুমে এই ফুল যশোরের গদখালী এলাকায় চাষ করেন অনেকে। সব মিলিয়ে নতুন এ প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমিয়ে দ্বিগুণ লাভ করা সম্ভব বলছেন কৃষকরা। পর্যাপ্ত উৎপাদন হলেও সবজি ও ফুল রফতানিতে বিশ্বের অন্য দেশের চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। এ পরিস্থিতিতে ২০১৫ সালে পলি হাউজ ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন যশোর বিএডিসি'র নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুব আলম। ২০১৮ সালে যশোরের ৭টি পয়েন্টে ৭ কৃষক নিয়ে শুরু হয় পাইলট প্রকল্প। কৃষকরা বলছেন, পলি হাউজ প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষে খরচ কমার পাশাপাশি বেড়েছে উৎপাদন। এতে নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও মুনাফার পাশাপাশি তৈরি হবে রফতানির ক্ষেত্র। এদিকে স্থানীয় কৃষকরা বলেন, এই সবজিগুলো বিষমুক্ত। এর আগে যে পদ্ধতিতে চাষ করতাম তাতে খরচ অনেক বেশি। লেবার কস্ট, সার ও কীটনাশক বেশি দিতে হত। তারপরও মানসম্পন্ন ফুল পেতাম না। উন্নত ফুল করতে না পারায় রেটটাও ভাল পেতাম না। কিন্তু এই পদ্ধতিতে আমার খরচ বেঁচে গেছে। একটা লেবার হলেই আমার সারাদিন চলে যায়। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, নতুন এ প্রযুক্তির বিস্তার হলে কৃষিসহ আর্থ-সামাজিক খাতে বড় পরিবর্তন আসবে। সেইসাথে তৈরি হবে কর্মসংস্থান। যশোর জেলা (সেচ)-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুব আলম আরও বলেন, বর্তমান সরকারের চাহিদা কৃষিকে বাণিজ্যকরণ করতে হবে এবং একে স্মার্টনেস আনতে হবে। আমি মনে করি পলি হাউজ, ট্যাগ অয়েল ও জিপ ইরিগেশন এসব পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষির সম্পূর্ণ চিত্রই পরিবর্তন করা সম্ভব। এখানে উচ্চ শিক্ষিত ছেলেরা আসলে তাদের গায়ে খেটে কোন পরিশ্রম করতে হচ্ছে না। এ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যাপক ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পরিকল্পনা দিয়েছে বিএডিসি। এটি পাস হলে সাধারণ কৃষক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেবে সংস্থাটি।
×