ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দিন বদলেছে, কৃষি এখন অভিজাতদের পেশা ॥ কৃষিমন্ত্রী

প্রকাশিত: ১০:২৪, ১৪ অক্টোবর ২০১৯

 দিন বদলেছে, কৃষি এখন অভিজাতদের পেশা ॥ কৃষিমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে। তাই সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে বলে জানিয়েছেন কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, বিএডিসিকেও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুন নতুন প্রযুক্তি ও জাত উদ্ভাবন করে মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং টেকসই কৃষির লক্ষ্য পূরণে মেধাবী ও তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। অন্য যেকোন ক্ষেত্র থেকে দেশে কৃষির সম্ভাবনা অনেক বেশি বলেও জানান কৃষিমন্ত্রী। রবিবার রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) ৫৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। দিনের শুরুতে বেলুন উড়িয়ে দিবসের শুভ সূচনা করেন এবং দিবস উপলক্ষে আয়োজিত মেলার স্টল পরিদর্শন করেন। পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মূর‌্যাল উন্মোচন এবং ইলেকট্রনিক গেট ও ভবনের দশম তলায় বঙ্গবন্ধু কর্ণার উদ্বোধন করেন। পরে আলোচনা অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কৃষি কোন দিনই সম্মানজনক পেশা ছিল না। অভিজাতরা কৃষককে চাষা বলে গালি দিত। দিন বদলেছে, কৃষি এখন অভিজাতদের পেশায় পরিণত হয়েছে। অনেক মেধাবী ও তরুণ পশ্চিমা দেশের উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে কৃষি কাজ করছেন। এখন অভিজাত শ্রেণীর শিক্ষিত লোকেরা গর্ব করে কৃষিকাজে নিজের সম্পৃক্ততার কথা বলেন। কিন্তু বর্তমানে কৃষি শ্রমিকরা যে পারিশ্রমিক পান তা দিয়ে তাদের জীবন চলা দায়। কৃষির আধুনিকায়ন ও বাণিজ্যিকীকরণই কৃষকদের আশার আলো দেখাবে। সেই সঙ্গে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করতে হবে। কৃষিমন্ত্রী বলেন, আমরা দানাদার ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। অনেক ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত থাকে। দেশে এখন কেউ না খেয়ে থাকে না। এখন দেশের কোথাও ছনের ঘর নেই। সব টিনের ও পাকা ঘর হয়ে গেছে। আমরা এখন দেশকে পুষ্টিসম্মত নিরাপদ খাদ্য দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। এজন্য দরকার কৃষির বহুমুখীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ, যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিকায়ন। এতে লাভজনক হবে কৃষি। মানুষের কর্মসংস্থান হবে, আয় বাড়বে। সে আয় দিয়ে মানুষ পুষ্টিমানের খাবার কিনে খেতে পারবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং টেকসই কৃষির লক্ষ্য পূরণে মেধাবী ও তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। অন্য যেকোনে ক্ষেত্র থেকে দেশে কৃষির সম্ভাবনা অনেক বেশি। বিএডিসির উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম ধারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। এটা এখন আমরা আমাদের ঘর থেকে শুরু করেছি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিএডিসিসহ কোন দফতরের কেউ জবাবদিহিতার উর্ধে নয়। সকলকে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিএডিসিকে সম্মানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সকলকে এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান মন্ত্রী। মন্ত্রী বলেন, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন স্বৈরাচারী সরকারগুলো মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চেতনায় কৃষিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। বিএডিসিকে ভেঙ্গে বেসরকারীকরণের চেষ্টা চালায়। একসময় সারের দাবিতে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ১৮ জন কৃষক। অথচ এখন সার কৃষকের হাতের নাগালে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসলে এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী না হলে হয়তো বিএডিসি ভবনও থাকত না। এ ছাড়াও কৃষি যন্ত্রপাতি, বীজসহ বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা প্রদানের ফলে দেশের কৃষির সাফল্য বিশ্ব স্বীকৃত। সরকারের লক্ষ্য ছিল খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সেই অর্জন হয়েছে। এমডিজি’র গোল অর্জিত হয়েছে, এখন পালা এসডিজি’র গোল অর্জনের, ইতোমধ্যে ক্ষুধামুক্ত হয়েছে দেশ। এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পুষ্টিকর নিরাপদ খাদ্য অর্জন কর। আর এটাও ২০৩০ সালের আগেই অর্জিত হবে। বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দিয়ে বলেছিলেন ‘আমার মান রাখিস’। কৃষিবিদরা তাঁর মান রেখেছে, রাখবে; প্রধানমন্ত্রীরও মান রাখবে। তাহলেই এসডিজি’র লক্ষ্য মাত্রা ২০৩০ সালের আগেই অর্জন করতে পারব। কৃষিমন্ত্রী বলেন, ভিত্তিবীজের সরবরাহ শতকরা ৬ ভাগ থেকে ২০ ভাগে উন্নীত করেছে বিএডিসি। কৃষির উন্নয়নের জন্য বিএডিসিকে আরও নতুন নতুন কর্মসূচী নিতে হবে। ভুট্টার অপার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। ৬০ লাখ মেট্রিক টন নয় আমাদের এক কোটি মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে। ছোটখাটো জায়গায় নয়, পরিকল্পিতভাবে অনেক বড় জায়গা নিয়ে ব্যাপকভাবে ভুট্টা ও গ্রীষ্মকালীন টমেটোসহ অর্থকরী ফসলের চাষ বাড়াতে হবে। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কৃষি সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান বলেন, আমি বিএডিসির চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় একটি ডায়েরি মেইনটেইন করতাম। তার নাম ছিল স্বপ্ন লিপিবদ্ধকরণ ডায়েরি। সেখানে অনেক স্বপ্ন লিপিবদ্ধ করা আছে। যার অনেক স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশে কি পরিমাণ বীজের চাহিদা রয়েছে ও কি পরিমাণ উৎপাদন হচ্ছে, তার একটা গবেষণা দরকার। একটি কর্মসূচীর মাধ্যমে বীজের চাহিদা নিরূপণ করার কাজটি এগিয়ে নিতে পারলে দেশে আর বীজের প্রকৃত চাহিদা নির্ণয় করা যাবে। এর আগে বিএডিসির সার্বিক কার্যক্রম তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মোঃ সায়েদুল ইসলাম। প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পর্কে বলা হয়, বর্তমানে মানসম্মত বীজ কৃষকদের হাতে তুলে দিতে বিএডিসি ৩৪টি খামারের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন করছে। এর মধ্যে দানাজাতীয় বীজ উৎপাদন খামার ২৪টি, পাটবীজ খামার ২টি, ডাল ও তৈলবীজ খামার ৪টি, সবজি বীজ খামার ২টি এবং আলুবীজ খামার ২টি। বর্তমানে এক লাখ ৯ হাজার ৫৩১ একর জমি নিয়ে ৭৫ কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার্স জোনের আওতায় ৩৭ হাজার ৬১১ জন চুক্তিবদ্ধ কৃষক বীজ উৎপাদন কার্যক্রমে যুক্ত আছে। বিএডিসি ১০১৮-১৯ অর্থ বছরে মোট এক লাখ এক হাজার ৬৫৬ মে.টন দানাদার ফসলের বীজ, ২৪৭৮ মে.টন ডাল জাতীয়, ১২৪৭ মে.টন তৈল জাতীয়, ৩১ হাজার ৭৩২ মে.টন আলু বীজ, ২৬১ মে.টন পাট বীজ, ৫৯ মে. টন সবজি বীজ ও ২০৫ মে. টন মসলা বীজ কৃষক পর্যায়ে বিতরণ করেছে। বিএডিসি চেয়ারম্যান বলেন, বিএডিসি সেচ সুবিধা সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। খাদ্য উৎপাদনে দেশে দুই ধরনের সেচ কার্যক্রম যথা বৃহৎ ও ক্ষুদ্র সেচ চালু আছে। রবি মৌসুমে ক্ষুদ্রসেচের মাধ্যমে দেশের সেচকৃত জমির ৯৫ শতাংশ এবং বৃহৎ সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে ৫ শতাংশ জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে সেচযোগ্য জমির প্রায় ৭২ শতাংশ সেচের আওয়ায় আনা সম্ভব হয়েছে। কৃষি বান্ধব সরকার ভূ-উপরিস্থ পানি সেচ কাজে ব্যবহারে অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত নয় বছরে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার ২০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ২৬ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। এ সময় চেয়ারম্যান বিএডিসির অন্যান্য কার্যক্রমও তুলে ধরেন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মোঃ সায়েদুল ইসলামের সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান এমপি, সাবেক কৃষি সচিব ও এপিএ বিশেষজ্ঞ পুলের সদস্য ড. এস এম নাজমুল ইসলাম বক্তব্য রাখেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন নামে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর প্রতিষ্ঠার ৫৮তম বর্ষ পূরণ করবে। বিএডিসি’র সফলতার ধারাবাহিকতায় দেশের কৃষি উন্নয়নে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য এবং বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিএডিসি’র অসামান্য অবদানের প্রতিদানে সংস্থাটি কৃষি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪১৭’ (স্বর্ণপদক) অর্জন করে।
×