ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

অনৈতিহাসিক ॥ রাষ্ট্রভাষা থেকে স্বাধীনতা সব লড়াই সংগ্রামে ছাত্র রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৯:১২, ১৩ অক্টোবর ২০১৯

অনৈতিহাসিক ॥ রাষ্ট্রভাষা থেকে স্বাধীনতা সব লড়াই সংগ্রামে ছাত্র রাজনীতি

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) কতিপয় ছাত্রের প্রহারে নিহত ছাত্র আবরারের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একদল ছাত্র-ছাত্রী ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর ব্যানারে এ দাবি তোলেন। দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীগণও এ দাবির পক্ষে মত দেন এবং বুয়েট কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়েছেন। ভাল কথা। সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভে দেখছি দাবির সপক্ষের ছাত্র-ছাত্রীরা বিশেষভাবে উত্তেজিত এবং ক্ষুব্ধ। তাদের দোষ দেয়া যাবে না। সহপাঠী প্রিয় বন্ধুর হত্যাকা-ে এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। তবে ক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীদের ভাবা দরকার এই দাবির আড়ালে আবরার হত্যা মামলা না হারিয়ে যায়? যতদূর জানা যায় হত্যাকারীদের একাংশ বর্তমানে কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থান করছেন এবং অচিরেই এ প্রশ্নে পুলিশের চার্জশিট দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন হত্যাকারী যেই হোক তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবেই। কোন ছাড় দেয়া হবে না। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগদান এবং ভারত সফর শেষে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেবল সরকারপ্রধান হিসেবে নয়, মা হিসেবেও হত্যাকা-ের বিচার করব। এরপর ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি কতখানি যৌক্তিক হবে? পায়ে বিষফোড়া হয়েছে বলে পা কাটা নয়, ফোড়াটা অপারেশন করে উপড়ে ফেলে দিতে হবে। তাহলেই শরীর-মন সুস্থ হয়ে যাবে। এখন দেখা যাক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে কার লাভ, কার ক্ষতি। এর উত্তর খুঁজলে প্রথমেই দেখা যাবে ক্ষতির ভাগটা ছাত্র রাজনীতিরই বেশি হবে- ভবিষ্যত লিডারশিপের ট্রেনিং বন্ধ হবে। লিডারশিপ বলতে কেবল রাজনৈতিক লিডারশিপ নয়, প্রশাসনিক, ব্যবসায়িক লিডারশিপের ট্রেনিংও এই ক্যাম্পাসেই সবচেয়ে ভাল হয়। লাভ হবে কার? এদিকটি বেশি করে ভাবতে হবে। আমি মনে করি লাভ হবে বেশি জঙ্গীগোষ্ঠী এবং হঠকারী বামদের। তারা খালি মাঠে গোল দেয়ার চেষ্টা করবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতি অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিটি লড়াই-সংগ্রামে, মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা গঠিত বিএলএফ বা ইধহমষধফবংয ষরনবৎধঃরড়হ ভড়ৎপব-এর সদস্যরা গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করে। পাশাপাশি করেছে বিএলএ বা ইধহমষধফবংয ষরনবৎধঃরড়হ ধৎসু কিংবা ঋঋ তথা ভৎববফড়স ভরমযঃবৎং বিভিন্ন সংগঠন এক হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করেছে। যুদ্ধের প্রয়োজনে বিভিন্ন এলাকায় ওই তিনটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে শত্রুর ওপর হামলা চালিয়েছে, বিজয়ী হয়েছে। আমি ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছিলাম এবং আমি মনে করি আজ যে জায়গায় (পার্লামেন্টে) এসেছি তার পেছনেও রয়েছে ছাত্র রাজনীতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে নিজ এলাকা ফরিদগঞ্জ উপজেলা এবং চাঁদপুর কলেজ ও জেলা ছাত্রলীগের সদস্য ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর হাজী মুহাম্মদ মহসিন হলের প্রথমে সাহিত্য সম্পাদক এবং পরে সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলাম। আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি তার পুরোটাই ছাত্রলীগের অবদান। বড় পদ পাইনি; কিন্তু বড় ট্রেনিং পেয়েছিলাম বলেই আজকের জায়গায় আসতে সক্ষম হয়েছি। ছাত্র রাজনীতি না করলে হয়ত ছাত্রত্ব সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিও ক্ষ্যামা দিতে হতো। ছাত্রলীগের রাজনীতি আমার চোখ খুলে দিয়েছিল বলেই আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল। আজ যারা ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছেন তাদের অতীতের ছাত্র নেতৃত্বের প্রতি তাকাতে বলব। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ.স.ম আব্দুর রব, খালেদ মোহাম্মদ আলী, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, মালেকা বেগম, মমতাজ বেগম, রাফিয়া আক্তার ডলি, দীপা দত্ত, শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আব্দুল কুদ্দুস মাখন এরা ছাত্র রাজনীতি থেকে বেরিয়ে রাজপথ কাঁপিয়েছেন। আজও কাঁপাচ্ছেন। ছাত্র রাজনীতি থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বদান শিখেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাই ধরা যাক। তিনি আজিমপুর গার্লস হাইস্কুল থেকে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। পরবর্তীতে ইডেন কলেজের ভিপি নির্বাচিত হন এবং ছাত্রীদের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়টা ছিল ছাত্র রাজনীতির অগ্নিঝরা দিন। সেদিন অন্যদের সঙ্গে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে যে ট্রেনিং বা অভিজ্ঞতা লাভ করেন রাষ্ট্রপরিচালনায় তাকে তুলনাহীন ডিভিডেন্ট প্রদান করে। আর সে কারণেই শেখ হাসিনা আজ অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রনেতা এবং ঈযধসঢ়রড়হং ড়ভ ঃযব বধৎঃয. নিকট অতীতের দিকে তাকালে দেখব রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান কর্মীরা ছিলেন ছাত্র। ১৯৬২ সালে ছাত্ররাই হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৬৬ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা আন্দোলন এবং ৬+১১ দফা ভিত্তিক ’৬৯-এর ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বও দিয়েছেন ছাত্ররাই। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছিল মিছিল-মিটিংয়ের কেন্দ্র। এখান থেকেই পরিচালিত হয়েছে আন্দোলন। একদিকে ৬ দফা দাবি অপরদিকে ৬ দফা দেয়ায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দিয়ে হত্যা করার চক্রান্ত করে। তখনকার ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে মূলত ওই আন্দোলন চলতে থাকে এবং তোফায়েল আহমেদ হয়ে ওঠেন গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে তিনি যে নির্দেশনা দিতেন ছাত্র-জনতা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। এই গণঅভ্যুত্থানে মিলিটারি স্বৈরাচার আইয়ুবের পতন ঘটে এবং ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পান ও ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লাখ মানুষের এক উত্তাল সমুদ্রে তোফায়েল আহমেদ জাতির পক্ষে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন রেসকোর্স ছিল খোলা ময়দান। জাতির পিতা এই রেসকোর্সেই তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের দুনিয়া কাঁপানো ভাষণ দেন। যেটি ছিল স্বাধীনতার ডাক ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ একাত্তরের ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রথম এবং প্রস্তুতি ভাষণ। এই ভাষণ বাংলার পথ-প্রান্তর কুঁড়েঘর পর্যন্ত পৌঁছেছিল। ইউনেস্কোর জরিপে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ভাষণ। সর্বোপরি যে কথাটি বলা দরকার বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ গঠন করেন। ছাত্রলীগও সবকিছু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথেই পরিচালনা করত। সেদিন ছাত্রলীগের এত বড় নেতৃত্ব ছিল; কিন্তু কোন সন্ত্রাসী কার্যক্রম ছিল না। সবই ছিল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। ছাত্র আন্দোলনের সেøাগান : ১. রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই- দিতে হবে দিতে হবে ২. তোমার ভাষা আমার ভাষা- বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা ৩. কুখ্যাত হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন- মানি না মানব না ৪. তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা ৫. তুমি কে আমি কে- বাঙালী বাঙালী ৬. পিণ্ডি না ঢাকা-ঢাকা ঢাকা ৭. জেলের তালা ভাঙব- শেখ মুজিবকে আনব ৮.আইয়ুব গেছে জঙ্গলে- পাকিস্তান গেছে গোরস্তানে ৯. জিন্নাহ্ মিয়ার পাকিস্তান- আজিমপুরের গোরস্তান ১০. জয় বাংলা ১১. জয় বঙ্গবন্ধু ১২. এবার শুধু এক দফা- স্বাধীনতা স্বাধীনতা ১৩. বীর বাঙালী অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর এই স্লোগান আমাদের ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধে যায় এবং তখন শুধু ২টি স্লোগান সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’। কাজেই এ বিষয়ে আর বলতে চাই না। মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি সেøাগান ছিল দুনিয়া কাঁপানো। ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করে মিলিটারি জিয়াউর রহমান। সঙ্গে ক্যাসিনো ব্যবসা। এভাবে রাজনীতির সঙ্গে ছাত্র রাজনীতিও কলুষিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মিলিটারি শাসন জারি করে জিয়া স্বাধীনতাবিরোধী তথা রাজাকার-আলবদরদের নিয়ে দল গঠন করে জাতীয় রাজনীতিকে কলুষিত করে যে ক্ষতি করেছেন তার রেশ আজও চলছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে গেছেন জিয়া। যে দেশে একবার মার্শাল ল’ আসে তা থেকে মুক্তি পেতে দশকের পর দশক চলে যায়; কিন্তু এর রেশ কাটে না। তবুও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ অনেকখানি এরই মধ্যে কাটিয়ে উঠেছে। মিলিটারি জিয়াই ছাত্রদের খারাপ পথে পরিচালনা করেন। সম্ভবত ১৯৭৮ কি ’৭৯ সালে মিলিটারি জিয়াউর রহমান প্রায় সাড়ে ৬শ’ ছাত্রকে হিযবুল বাহার নামে জাহাজে করে সিঙ্গাপুর পাঠান। ছাত্ররা সবাই ছিল মেধাবী স্টার পাওয়া। তাদের হাতে মদ ও ডলারের বান্ডিল দেয়া হয়। ডলারগুলো দেয়া হয় প্রধানত জুয়া খেলার জন্য। জাতি তখনই জানতে পারে ক্যাসিনো নামের এই জুয়ার মেশিনের কথা। এই সাড়ে ৬শ’ ছাত্রের মধ্যে অভি, নিরো, ইলিয়াস আলীও ছিল। জিয়া ঘোষণা করলেন সড়হবু রং হড় ঢ়ৎড়নষবস. এই কথা বলে মিলিটারি জিয়া সত্যি সত্যি কেবল ছাত্রসমাজ নয়, হোল ন্যাশনকে প্রবলেমে ঠেলে দিয়েছেন। ছাত্রদের সেই স্খলন আজও চলছে। সেই ধারাবাহিকতায় ক্যাসিনো আসে, রাউফুন বসুনিয়া খুন হয়। এভাবে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতিতে সন্ত্রাসের অনুপ্রবেশ ঘটে। এই অনুপ্রবেশই বন্ধ করতে হবে। হলে, ক্যাম্পাসে অছাত্রদের আনাগোনা একেবারেই এলাউ করা যাবে না। কেউ কেউ মনে করেন ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে নিজস্ব সিকিউরিটি ফোর্স দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তার কি প্রয়োজন আছে? পুলিশের বিভিন্ন ব্রাঞ্চ তাহলে কেন আছে? পুলিশকে কেবল দোষ দেব এটা ঠিক নয়। পুলিশ ভাল কাজও করে। নইলে সমাজ নিয়মের মধ্যে থাকত কী? দরকার শুধু পুলিশের মধ্যকার ঘুষ গ্রহণ প্রবণতা বন্ধ করা। সর্বশেষ বলতে পারি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ নয়, বরং ছাত্র রাজনীতির মধ্যে যে অশুভ শক্তি ঢুকে গেছে তাকে তাড়াতে হবে, প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করতে হবে। ঢাকা ॥ ১১ অক্টোবর, ২০১৯ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও জাতীয় সংসদ সদস্য [email protected]
×