ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিলুপ্তির পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সার্কাস

প্রকাশিত: ০৮:৫২, ১২ অক্টোবর ২০১৯

 বিলুপ্তির পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সার্কাস

কুকুর নৃত্য করে, ড্রাম চালায়, ব্যান্ডের তালে তালে হেলে-দুলে চলে। চার ইঞ্চি পাত দিয়ে ছাগল হাঁটে। বেশ কিছু দূর গিয়ে উঁচু স্থানে গোলাকার আকৃতি পাত বসানো রিং-এ এক পা উঁচু করে হাঁটতে থাকে। নাচতে থাকে ভাল্লুক। আর অন্য একজন জ্যান্ত চার-পাঁচটি শিং মাছ খেয়ে ফেলে। পর আবার পেট থেকে সেই জ্যান্ত শিং মাছ বের করে। জ্যান্ত মাছ পানির জগে রেখে দেয়। এমন অদ্ভুত চিত্র শুধু সিনেমার জগতেই থাকতে পারে। কিন্তু না। এ চিত্র বাস্তবেই এক সময় প্রদর্শিত হতো সার্কাসে। তাও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এখন এ সার্কাস বিলুপ্ত প্রায়। ৯০ দশকের শেষ ভাগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের সার্কাস চলত। গ্রাম-বাংলার হাজার হাজার মানুষকে মনোমুগ্ধকর সার্কাস মানুষের বিনোদনের অন্যতম খোরাক ছিল। সেই অবস্থা আর নেই। হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার সার্কাস। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুমোদন নিয়ে জটিলতার কারণেই এখন সার্কাস বিলুপ্তের প্রহর গুনছে। দি নিউ স্টার সার্কাস প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত আব্দুস সামাদের পুত্র এ্যাডভোকেট শাহ পরান জানালেন, সার্কাসের দুর্দিন চলছে। ১৯৬৬ সালের পর ৬৪জন কলাকুশলী নিয়ে দি নিউ স্টার সার্কাস দল যাত্রা শুরু করেছিল। ৮০ দশকের মধ্য ভাগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বোর্ডিং মাঠ, মেলার মাঠ, স্টেডিয়ামে সর্বশেষ সার্কাস হয়। খরমপুর কল্লা শাহ মাজারে ২০০০ সালে শেষ সার্কাসটি দেখা যায়। প্রতি বছর জেলার বাঞ্ছাপুরে রাহাত আলী শাহ মাজারে নিয়মিত সার্কাস হতো। কিন্তু নানা জটিলতায় কয়েক বছর ধরে এসব সার্কাস বন্ধ। এক সময় জীবন্ত জীব-জানোয়ার হাতি, ঘোড়া, বানর, মেছো বাঘ, ভল্লুক, ময়ূর, অজগর, কুকুর, ছাগলসহ নানা প্রজাতির সার্কাসের এই খেলাধুলায় অংশ নিত। সে সঙ্গে নারী-পুরুষ শারীরিক কসরত প্রদর্শন করত। যে সব খেলা হতো রুলিং ট্রপিজ, ফ্লাইং ট্রপিজ, চেয়ার ব্যালেন্স, বোতল ব্যালেন্স, বাঘের রশি ব্যালেন্স, রিং ড্যান্স, মৃত্যু ফাঁদে মোটরসাইকেল চালনা, তারের ওপর ১ চাকা ও দুই চাকা সাইকেল চালনা, স্ট্যান্ড সাইকেল ব্যালেন্স, ফায়ার ডেন্স, লং জাম্প, হাই জাম্প, শূন্যের ওপর খেলা, বর্ষা নিক্ষেপসহ নানা ধরনের খেলায় বাজিমাত হতো সার্কাস অঙ্গন। প্রতিটি দর্শকরা প্রাণ ভরে উপভোগ করত। খেলাগুলো ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বছরের রমজান মাসে ব্যতীত অন্যান্য মাসে সার্কাস দলটি সারাদেশ চষে বেড়াত। চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দান, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, কক্সবাজার, শাহাজীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকনাথ দীঘিরপাড়, নবীনগরের কলেজ মাঠ, কৃষ্ণনগর খেলার মাঠ, কসবার টি, আলী কলেজ মাঠ, নাসিরনগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বছর জুড়েই চলতো সার্কাস। ১৫/২০ দিন একেক জায়গায় চলত সার্কাসের এই ক্যাম্প। একেকটি ক্যাম্প তৈরি হতো ১২০ হাত বাই ১২০ হাত। ভাঙ্গা গড়ার জন্য সময় লাগতো সপ্তাহখানেক। বছর জুড়েই চলতো সার্কাস। কিন্তু সময় মতো অনুমোদন এবং পৃষ্ঠপোষক না থাকায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে সার্কাস চালানো। ২২টি সার্কাস চালু থাকলেও বর্তমানে মাত্র হাতে গোনা ৪টি সার্কাস চালু রয়েছে। বাকিগুলো বন্ধ রয়েছে। প্রতিটি সার্কাসে দুই থেকে আড়াই হাজার লোক সমাগম হতো। গ্যালারি, চেয়ার, চাঁটাই সাজানো থাকত। সব শ্রেণীর মানুষই উপভোগ করত সার্কাস। টিকেটের মূল্য ছিল ১০/২০/৩০ টাকা। বিকেল ৩টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চলত টানা ৩টি শো। শ’খানেক লোক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকত। প্রতি শোতে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা ও সর্বনিম্ন ৩০ হাজার টাকা আয় হতো। ১২/১৪টি ট্রাক সার্কাসের মালামাল আনা-নেয়ার জন্য ব্যবহার হতো। একসময় দর্শকদের বসার জায়গা সঙ্কুলান হতো না। দি নিউ স্টার সার্কাস পরিচালনাকারী মোঃ শাহজাহান সাজু জানান, ১৯৯৬ সাল থেকে আমার বাবার সঙ্গে থেকে তদারকির কাজ শুরু করি। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির কারণে এবং সময়মতো সার্কাস প্রদর্শনের অনুমোদন না হওয়ায় কাজ করতে পারছি না। মানুষের পাশাপাশি জীবজন্তুর ভরণ পোষণের অসুবিধা হচ্ছে। তাই শ্রমিকরা চলে যায়। সর্বশেষ তারপরও গত ঈদ-উল-ফিতরে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদিতে ২০দিন সার্কাস প্রদর্শিত হয়। ২০১৩ সালে ১৭ নবেম্বর ৮৪ বছর বয়সে আব্দুস সামাদ মারা যান। -রিয়াজউদ্দিন জামি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে
×