ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘চাঁদের অমাবস্যা’ এবং পরাজিত যুবক শিক্ষক

প্রকাশিত: ১২:৫৪, ১১ অক্টোবর ২০১৯

‘চাঁদের অমাবস্যা’ এবং পরাজিত যুবক শিক্ষক

কথানির্মাতা, নাট্যকার ও চিত্রশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (জন্ম: ১৫ আগস্ট ১৯২২, মৃত্যু : ১০ অক্টোবর ১৯৭১) বাংলাসাহিত্যে নিজের জন্য একটি বিশেষ মনোযোগের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন তাঁর প্রজ্ঞা আর সমাজনিবিড় জীবন-অভিজ্ঞানের প্রতিফলনের ভেতর দিয়ে। দেশ, আমাদের চারপাশের পরিচিত বলয়, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ও ঐতিহ্যিক অনুষঙ্গ তাঁর সৃজনভুবনকে শক্ত এক ভিতে দাঁড়াবার উপাদান যুগিয়েছে। মানুষের সামাজিক খ্যাতি, আর্থিক নির্ভরতা ও লোভ, নগরের বিকাশ এবং ফলত গ্রামীণ জীবনধারার ক্রম-বিলোপ, রাষ্ট্রীয় অভ্যন্তরীণ ও বহির্নীতি, ভিন্ন সংস্কৃতির আলোয় ব্যক্তির চিন্তা প্রকাশের কৌশল ও বাস্তবতা প্রভৃতিকে তিনি সাহিত্যকর্মের ফ্রেমে আঁটতে চেষ্টা করেছেন শিল্পচর্চার পুরোটা কাল। লেখার পাশাপাশি তিনি চিত্রকর্মের যে চর্চা করতেন, সেখানেও ছিল ওই একই দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর তিনটি বহুল আলোচিত উপন্যাস (‘লালসালু’, ১৯৪৮; ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ১৯৬৪; ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, ১৯৬৮), চারটি প্রশংসিত নাটক আর বাইশটি গল্পের বাইরে, তাঁর মৃত্যুর পর, আরো দুটি উপন্যাস আমাদের হাতে আসেÑ এ গ্রন্থগুলো ইংরেজিতে লেখা, নাম যথাক্রমে ‘দ্য আগলি এশিয়ান’ ও ‘হাউ ডাজ ওয়ান কুক বীনস্’; খুব সম্প্রতিকালে বাংলা অনুবাদ ‘কদর্য এশীয়’ (প্রথম প্রকাশ: ২০০৬) ও ‘শিম কীভাবে রান্না করতে হয়’ (প্রথম প্রকাশ: ২০০৪ ঈদ সংখ্যা, দৈনিক ‘প্রথম আলো’) শিরোনামে ছাপা হয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়েছে। গ্রন্থ দুটি ভাষান্তর করেছেন শিবব্রত বর্মন। প্রথমটির বিষয় রাজনীতিÑ বাংলাদেশের ভিন্নরাষ্ট্রনির্ভরতা ও অসহায় বাধ্যবৃত্তি আর স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রনীতি এর প্রতিপাদ্য; দ্বিতীয়টিতে স্থান পেয়েছে সংস্কৃতির সমন্বয় কিংবা ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক মেজাজ আত্মস্থ করবার প্রবণতা ও কৌশল। ওয়ালীউল্লাহ্র প্রকাশের ভার নিয়ে বিচিত্রমুখী পর্যবেক্ষণ হয়েছে, হচ্ছে; তবে আমাদের আজকের প্রসঙ্গ ‘চাঁদের অমাবস্যা’র ‘চুম্বক-চরিত্র’ যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর আত্ম-প্রবঞ্চনা এবং অস্তিত্ব-অন্বেষার বিষয়াদি। আর খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই আলোচনায় প্রবেশ করবে আখ্যানটির প্রতিবেশ এবং ধর্ম কিংবা বিচার-বিবেচনা বিষয়ে লেখকের নানানকৌণিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায়Ñ কথাটি মিথ্যা নয় কিছুতেই। তারপরও বাঁচবার আকুলতা বুকে নিয়ে আর অমরতা লাভের অষুধের দোকান খুঁজতে খুঁজতে সাড়ে তিন হাত নিরাপদ ও আপন প্লটের দিকে আমাদের নিবিড়-নিশ্চিত অভিযাত্রা। মানুষের বাঁচবার এই অশেষ আকুলতার কারণেই গোরস্তানের সামনের ফ্ল্যাটের চেয়ে লেকের পাশের বাড়ির দাম দাঁড়ায় অনেকটা বেশি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র উপন্যাস-গল্প ও নাটকে ‘ভয়’, ‘চাঁদের আলো’, ‘অন্ধকার’ প্রভৃতি অনুষঙ্গ পরিবেশিত হয়েছে বারবার। কেউ কেউ হয়ত ভাববেন লেখকের অবচেতনে এমনটি হয়েছে; আবার কারো মত হলোÑ না, তিনি সতর্কভাবেই প্রয়োগ করেছেন এইসব প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ। আর বিশেষ অভিনিবেশের জায়গাটি দখল করে নিয়েছে তাঁর পাঁচটি উপন্যাসের ভিন্ন ভিন্ন ক্যানভাস ও পরিবেশনশৈলী। বর্তমান কাহিনিতে চাঁদের প্রসঙ্গ, অমাবস্যার প্রতীক, মানুষের চিন্তাতীত ভাবনারাজ্য ও অর্জিত অভিজ্ঞান লেখক সাজিয়েছেন টেবিলে পাতা প্লেটের সারিতেÑ আপন কল্পনা ও জীবন-জিজ্ঞাসার অনুভবজ্ঞানকে অবলম্বন করে। এই কথাটি নিতান্তই স্বাভাবিক হলেও সরল নয়Ñ অন্তত কথাকারের দেখবার ও দেখাবার ভঙ্গিটি চিনে নিতে আমাদেরকে খানিকটা চোট খেতে হয় বৈকি! সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ প্রখর পর্যবেক্ষণসম্পন্ন ও সাহসী কথানির্মাতা। সময়ের সমূহ চালচিত্র এবং মানুষের সমকালীন প্রবণতা ঠিক ঠিক পাটাতনে রেখে পরিবেশন করার কৌশলটি তিনি আয়ত্ব করেছিলেন। তাঁর সাহিত্যভাবনায় আন্তর্জাতিক মেজাজ ছিল। আর বর্ণনা ও উপনস্থাপনভঙ্গিতে নতুনত্ব সৈয়দের সাহিত্যের বিশেষ মনোযোগ-আকর্ষণী অধ্যায়। ‘চাঁদের অমাবস্যা’য় যুবক শিক্ষকের ভয় ও আত্ম-প্রবঞ্চনার প্রতিফলনের সমাচার আঁকতে গিয়ে তিনি মানবিক অস্তিত্ব-সংকট এবং ব্যক্তির দায় ও ভারবোধের প্রসঙ্গাদি পরিবেশন করেছেনÑ সম্ভবত নিবিড় অভিজ্ঞানকে মান্য জেনে। বর্তমান গ্রন্থে প্রকৃতি, রাত, চাঁদ, অন্ধকার, আলো, কুয়াশা, নদী, বাঁশির শব্দ, বাতাসের আওয়াজ; ব্যক্তির সংশয়, সারল্য, আত্মনিমগ্নতাÑ এইসব বিষয় ও অনুভব সারিবদ্ধভাবে হাজির হয়েছে পাঠকের সামনে। কখনো দ্বিধা, কখানো উৎসাহ, মাঝে মধ্যে বিব্রতবোধ ও মানসিক চঞ্চলতা নিয়ে পাঠে অগ্রসর হতে হতে সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতের নানান বাঁক ও ঢালের ধাক্কায় (ঠেকে শিখে) নিজের জীবনদর্শনকে পাকিয়ে তুলে পাঠক খানিকটা তৃপ্তি আর কিছুটা অস্পষ্টতার জিজ্ঞাসা নিয়ে চোখ নামিয়ে নেন (পাঠ শেষ করা অর্থে)। তবে পাঠে প্রবেশের আগে লেখক সৈয়দ সাহেবের একটা ঘোষণার প্রতি আমাদের দৃষ্টি পড়ে। তিনি জানিয়েছেন: ‘এই উপন্যাসটির বেশির ভাগ ফ্রান্সের আলপ্স্ পর্বত অঞ্চলে পাইন-ফার-এলম গাছ পরিবেষ্টিত ইউরিয়াজ নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রামে লেখা হয়। মঁসিয় পিয়ের তিবো এবং মাদাম ঈভন তিবোকে তাঁদের আতিথ্যের জন্যে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।’ কাহিনীনির্মাতার এই ব্যক্তিগত কৈফিয়তটিতে সামান্য মনোযোগ স্থাপন করতে হয় বটেÑ পর্বত অঞ্চল, গাছ-গাছালির ছায়াঘেরা ছোট্ট একখানি গ্রাম আর সহৃদয় এক দম্পতির উপস্থিতির কারণে। ব্যাপারটিকে কেবল কৃতজ্ঞতা ভাবতে পারলে কোনো ঝামেলা ছিল না; কিন্তু এটি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনের সূত্রাবলি পেরিয়ে গল্পের ক্যানভাসের সীমানা ও ভেতরবাড়ি পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে বলে অনুমান হওয়ায় ওই বিশেষ অভিনিবেশের জায়গাটি তৈরি হয়েছে। মানুষ যে নির্জন দ্বীপে এক একটি বৃক্ষ কিংবা বনাঞ্চলে দাঁড়িয়ে থাকা নীরব ও একাকি গাছ, সে অভিজ্ঞান আমাদেরকে খানিকটা ভাবায় বৈকি! গ্রামটির ‘ক্ষুদ্র’তা মানব-সভ্যতা ও তার কারিগর মানুষের সীমাবদ্ধতার প্রতীক যে নয়, তা-ই বা কী করে বলি? আর যুবক শিক্ষক কোনো এক রাতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে যে যুবতীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছে, এমনও তো হতে পারে এই ঘটনাটি ওই ‘ক্ষুদ্র’ গ্রামটিতে সত্যি সত্যি ঘটেছিল! এবং চাঁদের আলোপড়া পায়ের ওই মৃতদেহটিকে ঘিরে আবর্তিত সমস্ত ঘটনার বিবরণ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর বর্ণিত ‘মঁসিয়’ ও ‘মাদাম’-এর কাছ থেকে জেনেছেন! যাই হোক, এই সামান্য সন্দেহটুকু আপাতত চেপে রেখে, কী ঘটেছিল এবং ঘটনার চারপাশের ব্যাপারাদির রহস্যই বা কীÑ সেসব আমরা পর্যবেক্ষকের কাতারে দাঁড়িয়ে দেখবো গল্পকারিগরের পরিবেশন কায়দা আর প্রাসঙ্গিক মাল-মসলার প্রতি নিবিড় অনুসন্ধানি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে। ‘শীতের উজ্জ্বল জ্যোৎস্নারাত, তখনো কুয়াশা নাবে নাই। বাঁশঝাড়ে তাই অন্ধকারটা তেমন জমজমাট নয়। সেখানে আলো-অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধ-উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়। অবশ্য কথাটা বুঝতে তার একটি দেরি লেগেছে, কারণ তা ঝট্ করে বোঝা সহজ নয়। পায়ের ওপর এক ঝলক চাঁদের আলো। শুয়েও শুয়ে নাই। তারপর কোথায় তীব্রভাবে বাঁশি বাজতে শুরু করে। যুবতী নারীর হাত-পা নড়ে না। চোখটা খোলা মনে হয়, কিন্তু সত্যিই হাত-পা নড়ে না। তারপর বাঁশির আওয়াজ সুতীব্র হয়ে ওঠে। অবশ্য বাঁশির আওয়াজ সে শোনে নাই।’ Ñ এই হলো ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসের প্রথম অনুচ্ছেদ। কুয়াশাহীন শীতরাত্রি, হালকা অন্ধকার, যুবক শিক্ষকের এক যুবতীর ডেডবডি দর্শন, জোছনার প্রসন্নতা, অজানা বাঁশির সুরÑ সবকিছু মিলিয়ে সাদার অন্তরালে কালো, স্পষ্টতার আড়ালে অস্পষ্টতা আর সত্যকে ঢেকে দিয়ে মিথ্যার প্রভাববিস্তারের এক ধরনের ছায়া-সন্দেহ তৈরি হয় গল্পের ক্যানভাসে। তারপর নানান রহস্য আর সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতের প্রতি পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখক অগ্রসরর হতে থাকেন। চাঁদের আলো থাকলে অমাবস্যা কীভাবে আসে!; কিংবা অমাবস্যা রাতে তো জ্যোৎস্না থাকার কথা নয়!Ñ এইসব জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে পাঠক পারি দিতে থাকে বিশেষ এক অভিজ্ঞানের পথে দোল-খাওয়া অভিযাত্রায়! সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র কাহিনী ও আখ্যানের বিশেষত্ব হলো বিষয় এবং ভাষার জটিলতা। বর্ণনার গভীরে প্রবেশ করার কাজটা যেন অনেক সময় পাঠকের জন্য কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি-ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি বোধ ও প্রসঙ্গকে নির্ভর মেনে তার গল্পের শরীর, শিরা ও উপশিরার গঠনকাজ চলতে থাকে চেতন-অচেতন, থাকা-না-থাকা আর জানা-অজানার যাবতীয় সদর দরোজা ও গলির পথ ধরে। যুবক শিক্ষক যখন বাঁশঝাড়ের মধ্যে মৃতদেহটি দেখতে পায়, তখন কে যেন হঠাৎ তার সামনে দিয়ে দৌড়ে পালায়। সম্ভবত সে হত্যাকারী (ধর্ষণকারীও কি? যুবতীটিকে কি ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়েছে?)। কিন্তু তাকে সে স্পষ্টভাবে দেখতে পায় না। লেখক বলছেন ‘নিরাকার বর্ণহীন মানুষ’। যুবক শিক্ষক চাঁদের আলো পছন্দ করে। যদিও জোছনার সমূহ ইতিবাচকতাকে সে আত্মস্থ করতে পারেনি; ‘যেখানে সে দাঁড়িয়েছিল সেখানে ছায়া, কিন্তু চতুর্দিকে জ্যোৎস্নার অপরূপ লীলাখেলা।’ তবে ‘জ্যোৎস্না-উদ্ভাসিত রাতের প্রতি তার অদমনীয় আকর্ষণ।’ হত্যাকা-টিকে ঘিরে যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর ঘোরলাগা অবিরাম সব মুহূর্তকে ছড়ানো ছিটানোভাবে বিন্যাস করে ঔপন্যাসিক পুরো কাহিনির ঘটনা-পরম্পরা সাজিয়েছেন। তবে কার্যকারণ হিশেবে পাঠককে একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। সেটি এরকম: চন্দ্রালোকের দিকে তাকিয়ে যুবক শিক্ষক হয়তো বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ নির্জন রাতে চলনশীল কিছু দেখতে পেলে প্রথমে সে চমকে ওঠে। তারপর সে তাকে দেখতে পায়। বড়বাড়ির কাদেরকে চিনতে পারলে তার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। চন্দ্রালোক-উদ্ভাসিত এ-মায়াময় রাতে কাদেরের আকস্মিক আবির্ভাব তার কাছে হয়তো অজাগতিক এবং রহস্যময়ও মনে হয়। এত রাতে এমন দ্রুতগতিতে কোথায় যাচ্ছে সে? তখন যুবক শিক্ষকের চোখ জ্যোৎস্নায় ঝলসে গেছে, তাতে ঘুমের নেশা পর্যন্ত নাই। দ্রুতগামী কাদেরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটি ঝোঁক চাপে মাথায়। সে ঠিক করে, তাকে অনুসরণ করবে। Ñএই যে অন্বেষার অভিপ্রায়। এখান থেকেই আরম্ভ হয় যুবক শিক্ষকের অস্থিরতা-ছোটাছুটি। অস্থিরতা ও ভ্রমণ যতোটা না শারীরিক, তার চেয়ে ঢের বেশি মানসিক! বিস্ময় আর বিভ্রান্তির বিরাট পথ পাড়ি দিতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। নিজের সাথে নিজের দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত পরাজিতও হয় এই যুবক। কথানির্মাতা ‘যুবক শিক্ষক’ শব্দযুগলের ভেতর দিয়ে সামর্থ্য-সাহস-স্পৃহা-সম্ভাবনা প্রভৃতি সামাজিক পজিটিভ সমাচার প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বোধকরি। কিন্তু তিনি দেখেছেন আরেফ আলীর বিপন্নতা। সত্য প্রকাশে তার সাহসহীনতা। নিজের আশ্রয় (বসবাস করবার জন্য) এবং চাকরি টিকিয়ে রাখতে সে অপরাধকে গোপনে প্রশ্রয় দিয়ে চলে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহস করে না। প্রিয় পাঠক, সতর্ক দৃষ্টিতে খেয়াল করলেই টের পাবেনÑ আমাদের দেশের শিক্ষকসমাজ এই রকমভাবে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে মানসিক যন্ত্রণা ও ব্যর্থতার তাপে পুড়ছে প্রতিদিন! শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না যেন কিছুতেই! বর্ণিত যুবক শিক্ষক নিজের স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত নৈতিক অবস্থানের কাছে পরাজয় মেনে নেয়; অবশ্য সামাজিক-রাষ্ট্রীয় বাস্তব পরিবেশ-পরিস্থিতি তাকে বাধ্যও করে অনেকটা। ‘জটিল এবং পরিশ্রমসিদ্ধ আত্মপ্রবঞ্চনাটি শুরু হয় তখন, যখন আত্মরক্ষার প্রবল বাসনার জন্য তার বিবেকের নির্দেশ শুনতে যুবক শিক্ষক অক্ষম হয়ে পড়ে। তারপর তার লজ্জাকর ভীতি-দুর্বলতা সে নিজের কাছেই লুকাবার চেষ্টা করে। সমকালীন শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষকদের সামাজিক-পারিবারিক-ব্যক্তিগত অবস্থা ও অবস্থান, চিন্তা ও স্বপ্নের পরিধি, মানসিক বিচরণের সীমানা প্রভৃতি বোঝাতে লেখকের একটি বর্ণনার কিছু পাঠ নেওয়া যায়: ক. চুনবালিতে লেপা বাঁশের দেয়াল, কাঠের ঠাট, ওপরে তরঙ্গায়িত টিনের ছাদ। ছাত্রদের সামনের বার্নিশশূন্য বেঞ্চিতে কালির দাগ, অনেক গ্রীষ্মের ঘামের ছাপ, এখানে-সেখানে ছুরির নির্দয় আঁচড়। অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার টেবিলের পেছনে বসে যুবক শিক্ষক আরেফ আলী। গায়ে নিত্যকার মতো সামান্য ছাতাপড়া, জীর্ণ সবুজ আলোয়ান, পরনে আধা-ময়লা সাদা পায়জামা, পায়ে ধুলায় আবৃত অপেক্ষাকৃত নোতুন পাম্প-সু। অভ্যাসমতো টেবিলের তলে সে অবিরাম ডান পা নাড়ে পা-টি যেন কলযন্ত্রে চালিত হয়। খ. দরিদ্র যুবক শিক্ষক, কোপন নদীর ধারে ক্ষুদ্র [গ্রামগুলোকে ‘ক্ষুদ্র’ বলার পেছনে সৈয়দ সাহেবের বিশেষ কোনো ইঙ্গিত আছে কী? তিনি ফ্রান্সের যে গ্রামে বসে কাহিনিটি কম্পোজ করেছেন, তাকেও ‘ক্ষুদ্র’ বলে অভিহিত করেছেন!] চাঁদপারা গ্রামে তার জন্ম। কষ্টেসৃষ্টে নিকটে জেলা শহরে গিয়ে আই.এ পাস করেছে, সুপরিচিত নদী-খাল-বিল ডোবা-মাঠ-ঘাট সুদূরপ্রসারী ধান ফসলের ক্ষেতের বাইরে কখনো যায় নাই। সমতল বাংলাদেশের অধিবাসী, পর্বতমালা কখনো দেখে নাই। বই-পুস্তক, সাময়িক পত্রিকা-সংবাদপত্রে কোনো কোনো পর্বতের ছবি দেখেছে, কিন্তু অনেক পর্বতের শুধু নামই শুনেছে। এন্ডিজ, উরাল, ককেসিয়ান, আলতাই পর্বতমালা। কত নাম। সব স্বপ্নের মতো শোনায়।... হিমালয় সে দেখে নাই। বস্তুত সে কিছুই দেখে নাই। দরিদ্র শিক্ষক কিছুই তার দেখার সৌভাগ্য হয় নাই। প্রিয় পাঠক, ভেবে দেখুন, আমাদের দেশে এমন সব যুবক শিক্ষকের ঘাড়ে বর্তেছে জাতির ভবিষ্যৎ-প্রজন্মকে তৈরি করার মাহে (!) দায়িত্ব। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ কেবল ‘যুবক’ শব্দের মধ্যে উদ্যম আর সক্ষমতাকে আটকে রেখে তার জানার সীমাবদ্ধতাকে আমাদের সামনে হাজির করেছেন। লেখক জানেন, ‘তরুণমনের আশা-আকাক্সক্ষা স্বপ্ন আর বিশ্বাস নবজাত বলেই সুন্দর ও পবিত্র।’ এই রকম সীমিত জ্ঞান দিয়ে যে সত্যিসত্যিই সত্যকে অনুধাবন করা যায় না, সে কথাও বোধকরি লেখক আমাদেরকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন। আর তাই হয়তো যুবক শিক্ষক আত্মপ্রত্যয়ী হতে পারেনি; সঞ্চয় করতে পারেনি কাক্সিক্ষত সাহসের সমাচারও। আশ্রয়দাতা (চাকরিদাত্রও বটে) দাদাসাহেবের বাড়ির প্রতিনিধি ‘দরবেশ’ কাদেরের অপকর্মের কথাও সে বলতে পারে না ওই সামান্য জ্ঞানের অসামান্য সীমাবদ্ধতার কারণে! মাদ্রাসা-পড়ুয়া বাইশ-তেইশ বছরের যুবক আরেফ আলী মুখের শীর্ণতা আর চোয়ালের অনুজ্জ্বল আভায় যৌবনের ভার ধরে রাখতে পারেনি; শিক্ষকতা করে বলে এক ধরনের আরোপিত উদ্ধতভাব ও মেকি দম্ভ তার মধ্যে আছে বটে! যুবক শিক্ষক কুয়াশাঘেরা অন্ধকার রাতে প্রায় দৌড়তে থাকা কাদেরের পিছু নিয়েছিল। কিন্তু: একটু পরে চৌমাথার মতো স্থানে এসে সে হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে পড়ে। কোন দিকে যাবে?... ভাবে, লোকটা যে কাদের সে-কথা সঠিকভাবে সে বলতে পারে না, চোখের ভুল হয়ে থাকতে পারে। তাকে মুখামুখি দেখে নাই, কেবল তার পেছনটাই দেখেছে।...কিন্তু যুবক শিক্ষক ফিরে যায় না। কাদেরকে সে সামনাসামনি দেখে নাই বটে কিন্তু তার হাঁটার বিশেষ ভঙ্গি, ঘাড়ের কেমন উঁচু-নিচু ভাব, মাথার গঠন ইত্যাদি দেখেছে। ভুল অবশ্য হতে পারে, কিন্তু আরেকটু দেখে গেলে ক্ষতি কী? মানুষটি অদৃশ্য হয়ে গেলে তার সম্বন্ধে কৌতুহলটা আরো বাড়ে যেন। কিন্তু কোন দিকে যাবে? চারটা পথের কোনটা ধরবে? লোকটিকে চিনতে পারা-না-পারার সংশয় এবং চারটি পথের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়েথাকা কিংকর্তব্যবিমূঢ় যুবক শিক্ষকের মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে গল্পনির্মাতা সম্ভবত আমাদের প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনের জটিলতা ও প্রতিকূলতাকে ইঙ্গিত করেছেন। অবলোকন, নির্ণয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই যে বিভ্রান্তিÑ এর ভেতর দিয়ে আমরা যেন আমাদেরই মানসিক দুর্বলতার পাঠ গ্রহণ করি; আর দেখতে থাকি চারদিকে প্রবহমান সব কুটিলতা আর প্রতিবন্ধকতার ছবি। অনুমান ও সত্য যে এক নয়, কাজে স্থিরচিত্ত থাকা আর পিছিয়ে পড়ার মধ্যে যে নিশ্চিত দূরত্ব রয়েছে, করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারা আর না-পারার মাঝখানে যে নিশ্চিত-সরল প্রভেদ, তা বোঝাবার জন্য লেখক যুবক শিক্ষকের এই মানসিক বিভ্রান্তিকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন বোধকরি। এই চরিত্রটি আমাদের চারপাশে পরিচিত ভুবনে বিরাজমান হাজার-কোটি মানুষের প্রতিনিধি মাত্র। নিজের অবস্থানে থেকে নিজেকে আড়াল করার যে শামুকস্বভাব আমরা লালন করে চলেছি প্রতিদিন-প্রতিরাত, তারই সামান্য ও সফল রূপায়ণ যুবক শিক্ষক আরেফ আলী। অবশ্য আরেফ আলী সে রাতে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে পারতো। কিন্তু বাস্তবে সে পারেনি। ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু এবং চলমান রেখা যেমন তাকে ব্যস্ত করে তুলেছিল, তেমনি খানিক অবসরে, মানসিক ক্লান্তির কালে, সে চাঁদের আলোয় মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল। এই মুগ্ধতা হয়তো তার জন্য নতুন নয়Ñ পুরনো। আর ‘চাঁদের আলো জাদুকরী, মোহিনী।’ কাজেই চাঁদের আলোর কাছে যুবক শিক্ষকের মন বাঁধা। আর ‘কাদের বড়বাড়ির মানুষ। যুবক শিক্ষক সে-বাড়িরই পরাপেক্ষী, তাদেরই আশ্রিত।’ অতএব কাদেরের কাছে, তার পরিবারের কাছে সর্বোাপরি বড়বাড়ির প্রধান মুরব্বি দাদাসাহেবের কাছে যুবক শিক্ষক ‘জালে আটকে-পড়া প্রাণী’ যেন! ‘লালসালু’ পাঠ করে বা ওই গ্রন্থটি বিষয়ে কোনো আলোচনা পড়ে কারো কারো মনে হতে পারে যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ইসলামধর্ম বা মুসলমানদের সমালোচনা করেছেন। আর কেউ কেউ ভেবে থাকেন ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলাই হলো প্রগতিশীলতা; এবং সে অর্থে এই লেখককেও অনেকে প্রগতিশীল আখ্যা দিতে পছন্দ করেন। তবে আমরা দেখেছি, ওয়ালীউল্লাহ্ যে কথা-ভাষা নির্মাণ করেছেন, তাতে ধর্মতত্ত্ব পাওয়া যায় বটেÑ এবং গভীরভাবেই তা রেখাপাত করে আছে, কিন্তু ধর্ম কিংবা ধর্মপালনকারীকে তিনি কটাক্ষ করেননি। আর প্রগতিশীলতা কি ইসলামে অনুপস্থিত? কেবল যারা ধর্মকে ব্যবহার করে, মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে সামাজিক-আর্থিক প্রতিপত্তি অর্জন করেছে বা করতে চেয়েছে, তাদের চিনিয়ে দিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সচেতন মানুষকে সহায়তা করেছেন মাত্র। এশীয়দের (সম্ভবত পৃথিবীর সকল পিছিয়েপড়া অঞ্চলের মানুষেরও) একটা বিশেষ প্রবণতা হলো কোনো কিছু সম্বন্ধে না জেনে কিংবা সামান্য জেনে মতামত প্রকাশ করা। ব্যক্তি হিশেবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাধারণ মানুষদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা; একজন আলোকক মানুষ। ইতিহাস-ঐতিহ্য-ধর্মতত্ত্ব-সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্য-মনস্তত্ব-রাজনীতিবিজ্ঞান এবং প্রকৃতিবিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর প্রচুর পড়াশোনা এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ ছিল। ‘চাঁদের অমাবস্যা’য় আমরা সাধারণ পাঠক হিশেবে লেখকের ইতিহাসবোধ, ঐতিহ্যভাবনা এবং ইসলাম সম্বন্ধে গভীর জীবনদৃষ্টি অনুভব করে সিম্প্লি বিস্মিত না হয়ে পারি না। বর্তমানে সারাপৃথিবীজোড়া ‘’মার্কিনি বা ‘বিলাতি’ প্রভাবকে মনে রেখে তিনি ইসলামের আভিজাত্য ও ঐশ্বর্য; শৌর্য-বীর্য; সৌন্দর্যচিন্তা ও সাফল্য; রাজনীতি ও শাসন; শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্য; খ্যাতি ও প্রসার এবং ধর্মপ্রচারের পজিটিভ প্রবণতা বিষয়ে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। মুসলমানদের সেদিনের সেই শানশওকত আজ আর তেমনটা অবশিষ্ট না থাকলেও, তখনকার ইসলামপন্থীদের ‘নেক-চরিত্র, ধর্মের প্রতি ভক্তিনিষ্ঠা, সাধুতা-দয়াশীলতা, বিনয়-নিরভিমান ব্যবহার’ প্রভৃতির প্রসঙ্গ তুলতে তিনি ভুল করেননি। উপন্যাসে বর্ণিত একটা অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি: কোথায় না খোদাভক্ত খোদাভীত খোদাপ্রেমিক দীনদয়াময় বীর্যবান মুসলমান ধর্মের পতাকা উত্তোলন করে নাই, কোথায় না সভ্যতার উজ্জ্বল মশাল বহন করে নিয়ে যায় নাই? তাদের জয়-বিজয় ও কৃতিত্বের কাহিনী ইতিহাসের অন্ধকার গহ্বরে মণিমুক্তার মতো ঝলমল করে। ইরান-তুরান-খোরাসান, সামারা-সিকিরিয়েহ-বালারাম; দূর দূর দেশে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারিত হয়েছে। তারা বাগদাদ-দামাস্কাস কুর্তুবা-গ্রানাদার মতো মনোরম শহর সৃষ্টি করেছে, নির্মাণ করেছে বৃহৎ-মহৎ সুদৃশ্য প্রাসাদ-দুর্গ-তোরণ-মিনার। কত নাম বলি? খুন্দ প্রাসাদ, বাবউজ্জাহাবের সোনালী তোরণ, বিশাল দুর্গ-প্রাসাদ, মেদিনাত্-উল-হামরা, নাইল নদীতীরে কার্ছ-উল-খাবরি। তারপর শত শত মনোরম উদ্যান, শত শত শিক্ষাকেন্দ্র, বাণিজ্যবন্দর। কাহিনি এবং আখ্যানের মধ্যে আমরা আগে কোনো পার্থক্য খুঁজতাম নাÑ সহজ করে বললে, বুঝতাম না। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের লেখক ও সমালোচক ই এম ফরস্টার (ঊ. গ. ঋড়ৎংঃবৎ, ১৮৭৯-১৯৭০)-এর ‘আসপেক্টস অফ দি নভেল’ (১৯২৭) বইটি আমাদের চিন্তার ভুবনটিকে নাড়া দিয়েছে। সারাদুনিয়ার শিল্প-সাহিত্য বিশ্লেষকদের চিন্তায় যেন ঝড় তোলে বইটির বিষয়বস্তু। তিনি সহজভাবে কাহিনি আর আখ্যান-এর মধ্যকার বিভেদটাকে আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। আমরা এখন বুঝে গেছি কাহিনি মানেই আখ্যান নয়Ñ যদিও দুটোতেই ঘটনার পরম্পরা থাকে কিন্তু কাহিনির কাজ হলো পাঠকের মনে কেবল ঔৎসুক্য জাগিয়ে তোলা, একটি ঘটনা শোনার পর পাঠক জিজ্ঞেস করবেÑ এরপর কী (ঘটনার পরম্পরাÑ কোনটার পরে কোনটা)? আর আখ্যান পাঠকের মনে চিন্তার দরোজায় টোকা মারেÑ বিষয়কে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে উসকে দেয়, পাঠক তখন নিজেকেই প্রশ্ন করতে থাকেÑ কেন, কীভাবে এমনটি হলো? এমনটি না হলে কি তার পরিণতি বা পরিস্থিতি অন্য রকম হতো? ইত্যাকার নানান জিজ্ঞাসা পাঠকের মগজ-ফটকে আঘাত করে। এই যে আখ্যানের বিশেষত্ব, সে বিবেচনায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র সব উপন্যাস তো বটেই, বিশেষভাবে ‘চাঁদের অমাবস্যা’ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ না করে পারে না। আর সে কারণেই তিনি হয়ে ওঠেন আখ্যানের নিবিড়মন শিল্পী। এছাড়া আরেকটি বিষয় এই উপন্যাসে প্রধান হয়ে উঠেছে। তা হলোÑ এখানে সমাজ নয়, ব্যক্তিই অন্বিষ্ট। সমাজ ও ব্যক্তির প্রাসঙ্গিক পারিপার্শ্ব পরিবেশিত হয়েছে ব্যক্তির অŸস্থা ও অবস্থানকে নির্দেশ করবার প্রয়োজনে। যুবক শিক্ষক আরেফ আলীকে কেন্দ্র করে যে আখ্যান সাজিয়েছেন লেখক, তার ভার হয়তো সমাজকেই শেষপর্যন্ত বহন করতে হয়, কিন্তু তিনি সমাজকে আশ্রয় করেননি। তবে সমাজ তাঁর আখ্যানে কোনোভাবেই উপেক্ষিত থাকেনি। যখন সমাজের যে পাতা তিনি প্রকাশ করেছেন, তখন তাকে উল্টে-পাল্টে পাঠককে দেখিয়েছেন দক্ষ যাদুকর বা পথের পাশে দাঁড়িয়ে হেঁকে-ডেকে পণ্য বিক্রেতার মতো। সাহিত্যের কিংবা শিল্পের পরিবেশনে এবং বিপণন-কৌশল সৃষ্টিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র আগ্রহ বা প্রচেষ্টার কোনো ঘাটতি অন্তত চোখে পড়ে না। ‘পানিশমেন্ট অব ন্যাচার’ বলে একটা কথা আছে। তার ওপরে শেষপর্যন্ত ভরসা করে মাদ্রাসা-পড়–য়া যুবক শিক্ষক আরেফ আলী। যে খুনের ঘটনাটি ঘটেছে, তার প্রকৃত বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে কি-না, অপরাধী ধরা পড়বে, না-কি নিরপরাধ কাউকে শাস্তি দেওয়া হবেÑ এই নিয়ে তার মনে সংশয় দেখা দেয়। তবে প্রকৃতি ও সমাজকে অবলোকন করে, সময়ের পরিক্রমায় সে উপলব্ধি করেছে, প্রকৃতঅর্থে মানুষ মানুষকে সাহায্য করতে পারে না। তার জন্য দরকার পড়ে সৃষ্টিকর্তার সহযোগিতা ও আশ্রয়। মানুষের অজ্ঞতা, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা এবং ধর্মের ওপর নির্ভরতা প্রভৃতি বিষয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য। তিনি কোনো রাখঢাক না রেখে ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান, ধর্মবিশ্বাস এবং অপরগতা-অসহায়তা বিষয়ে নিবিড় বিবৃতি তৈরি করেছেন। তাঁর পাঠকদের জন্য এটি বিশেষ পাওয়া যে লেখকের অভিজ্ঞান, তাঁর সৃজনভাবনা ও প্রকাশের ভার এবং সংস্কৃতির আলোয় ব্যক্তির বেঁচে থাকার সদর দরোজার সন্ধান অন্তত তিনি আখ্যান-পরিসরে সুবিন্যস্তভাবে পরিবেশন করেছেন। যুবক শিক্ষকের মানসিক বিভ্রমের কালে তার স্বস্তি ও মুক্তিকে টার্গেট করে লেখক পবিত্র কোরআনের আশ্রয় নিয়েছেন। প্রসঙ্গত যুবক শিক্ষকের দুর্বল-ধর্মচেতনা সম্বন্ধে মত প্রকাশ করতেও দ্বিধা করেননি তিনি। নিজের মানসিক যন্ত্রণার অবসান এবং চোখে-দেখা অপরাধীর বিচার প্রার্থনায় কাতর আরেফ আলী কীভাবে সুরা আল্-খালাক ও সুরা লাহাবের প্রায়োগিকতার ওপর ভরসা করেছেন তাঁর বিবরণ-ভাষ্য নির্মাণ করেছেন ঔপন্যাসিক। তিনি লিখছেন: বড়বাড়িতে আসার পূর্বে নিয়মিতভাবে নামাজ পড়ার অভ্যাস যুবক শিক্ষকের ছিল না। আজকাল অন্ততপক্ষে সকাল-সন্ধ্যায় নামাজটা পড়ে। তবু ঠিক মনঃপ্রাণ দিয়ে যে তা নয়। তার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার না করলেও তা সে সম্পূর্ণভাবে বোঝে না। কিন্তু আজ সে হঠাৎ অত্যন্ত নিঃসঙ্গ এবং অসহায় বোধ করে বলে নামাজ পড়তে দাঁড়ালেই তার মন একটি তীব্র ভাবোচ্ছ্বাসে ভরে ওঠে। সে যেন আর তোতার মতো মুখস্থ-করা বুলি আবৃত্তি করে সারশূন্য কর্তব্যপালন করছে না: যাঁর সামনে সে দাঁড়িয়েছে তাঁর উপস্থিতি সে অন্তর দিয়ে অনুভব করছে, তার বক্তব্য তাঁর কর্ণগোচর হচ্ছে তাতেও তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না। নামাজ প্রভৃতি ধর্মাচার বিষয়ে লেখকের সতর্ক পর্যবেক্ষণ ও মতামত পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র পাঠ এবং সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতে তার প্রয়োগ-পর্যালোচনা বাংলাসাহিত্যে একটি নবতর ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে বটে। বিচিত্র কৌণিক ব্যাখ্যায় ধর্ম, ধার্মিক ও অধার্মিকের আচার-আচরণের দিকে তিনি আগ্রহী পাঠকের চোখ ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর সাধারণ অভিনিবেশের জায়গাটি হলো ইসলাম ধর্ম ও ভারতবর্ষে ধর্মপালন-কালচার এবং মুসলমানদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অর্জন। তবে প্রসঙ্গত, ভারতের রাজনীতি-সমাজনীতি ও ধর্মনীতিতে আমেরিকা প্রভৃত ভিন্নরাষ্ট্রের প্রভাব এবং খ্রিস্ট্রানধর্ম প্রচারের ব্যাপারাদিও তিনি তুলে ধরেছেন প্রাতিস্বিক বলয়কে বিবেচনায় রেখে। আইন আদালত ও বিচার বিভাগের অসাড়তা, প্রচলিত তদন্ত-পদ্ধতির দুর্বলতা, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনির সদস্য কর্তৃক টর্চার এবং মিথ্যা জবানবন্দি প্রদানে বাধ্য করার প্রবণতাÑ এইসব সমাচার উত্থাপন করে সমাজশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ দেখিয়েছেন কীভাবে একজন নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পায়। অপরাধীচক্রের দৌরাত্ম্য আর বিচার-প্রথার অনাধুনিকতা ও অগ্রহণযোগ্যতার এই যে নিবিড় পর্যবেক্ষণ, এমনটা বাংলাসাহিত্যে বিরল। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছেন এদেশে অপরাধীরা ক্ষমতা কিংবা টাকার জোরে পার পেয়ে যায়; আর মার খায় নিরীহ সাধারণ মানুষÑ যাদের মামা-কাকার কিংবা টাকাকড়ির বাহাদুরি নেই। পাশাপাশি পুলিশ এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলাবাহিনির সদস্যরা যে নিজেদের রাষ্ট্রীয় ও মহান দায়িত্ব ভুলে গিয়ে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে অপরাধীর কাছ থেকে সুবিধা নেয়, তার চিত্র পরিবেশন করতেও লেখক পিছপা হননি। অবশ্য আইনের লোকেরা যে অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তিকে শায়েস্তা ও শাস্তি প্রদানে বাধ্য হয় (ওপরের নির্দেশে!Ñ সৃষ্টিকর্তার নয়, রাষ্ট্রীয় উচ্চপদমর্যাদায় আসীন ব্যক্তির)Ñ এমন ইঙ্গিতও গল্পটিতে পাওয়া যায়। ‘কর্তায় ইচ্ছায় কর্ম’ বলে যে কথাটির প্রচলন রয়েছে, তার পেছনে আছে প্রশাসকের, ক্ষমতাধরদের অবিচার-অন্যায়ের গোপনকাহিনি। ওয়ালীউল্লাহ্ এই বিষয়ে অত্যন্ত প্রখরদৃষ্টি মানুষ। প্রকৃতঅর্থে তিনি এই আখ্যানের ভেতরে প্রবেশ করা একটি বিচারিক ঘটনা উপস্থাপনের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক দুর্বলতাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সত্যিকথা বলতে কি, আমরা বর্তমান বাংলাদেশে আইন ও বিচার বিভাগের যেসব বিতর্কিত কর্মকা- দেখতে পাচ্ছি, তা কোনো নতুন ঘটনা নয়Ñ দীর্ঘদিনের পথচলায় তা আজ পাহাড়সম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্য-অনুসন্ধানি সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ আজ থেকে অর্ধশতাব্দীকাল আগে এই বিষয়ে তাঁর পাঠককে এবং পরোক্ষভাবে গোটা সমাজকে সতর্ক করে গেছেন। লেখকের প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞান বুঝবার প্রয়োজনে ‘চাঁদের অমাবস্যা’ থেকে খানিকটা পাঠ নেওয়া যেতে পারেÑ যুবক শিক্ষক আরেফ আলীকে জেরা করার ঘটনাবলীর অংশবিশেষ: পুলিশ-কর্মচারী তাকে ভুল বোঝে। তার চোখে প্রথমে সন্দেহ, শেষে কেমন যেন অহেতুক প্রতিহিংসার ভাব দেখা দেয়। বিকৃতকণ্ঠে সে বলে, “হবে তদারক হবে। আপনার ভালো হতে পারে, মন্দও হতে পারে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন। যার ক্ষতি করতে চান, তার ক্ষতি করা সহজ হবে না।”... “বুঝতে পারছেন? হোক আপনার কথা সত্য, কিন্তু সাক্ষী কই? আপনি নিজের চোখে কিছু দেখেন নাই, কিন্তু অপর পক্ষ দেখেছে।” সে যেন একটু দ্বিধা করে তারপর বলে, আপনাকে স্বচক্ষে দেখেছে।” হয়তো কথাটি পুলিশ-কর্মচারীর নিজেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কিন্তু সে কী করতে পারে? ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মূল্য কী? ... “আপনার আর কিছু বলবার নাই?” যুবক শিক্ষক উত্তর দেয় না। “শুনছেন?” সাব-ইন্সপেক্টর বলে। কনস্টেবলের বুটের আওয়াজ হয়। সচকিতভাবে সজ্ঞান হয়ে যুবক শিক্ষক আবার তার বক্তব্যটি বলে। শুনে পুলিশ-কর্মচারীর মুখে তীব্র বিরক্তির ভাব জাগে। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের জন্যে কেবল। তারপর সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওঠে। বাজে কথার সময় শেষ হয়েছে। লেখক অবশ্য এই আখ্যানে যুবক শিক্ষকের অনুমাননির্ভরতার ওপর পাঠকের চিন্তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আমজনতার ধারণা এবং রাষ্ট্রকাঠোমোর (বিশেষত আমাদের মতো অনগ্রসর রাষ্ট্র আর কি!) প্রতি নাগরিকের অনাস্থার ব্যাপারটিকে সামনে আনতে চেষ্টা করেছেন। ‘বাজে কথার সময় শেষ হয়েছে’ কথাটির মধ্য দিয়ে যে ইঙ্গিত প্রদান করেছেন আখ্যাননির্মাতা, তাতে আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, যুবতী হত্যার দায়ে যুবক শিক্ষককে শাস্তি পেতে হয়েছে। সে ন্যায়বিচার পায়নি। আসলে এমনটিই সাধারণভাবে ঘটে আসছে এই পৃথিবীর পরিচিত জীবনধারায়। পাঠক, আরেকটি কথা। যুবক শিক্ষককে আমরা কেবল দেখেছি অস্তিত্ব-সংকটে ভুগতেথাকা এক অনিকেত মানুষ হিশেবে। কিন্তু শিকড়বিহীন এই যুবকের মনের ভেতরে লুকিয়েথাকা স্বপ্নময়তার খুব একটা স্পর্শ আমাদের চেতনায় দোলা দেয় না। হয়তো তার যুবকত্ব কিংবা যুবকসুলভ বাসনা-কামনা, ক্ষোভ-হতাশা প্রভৃতির বিবেচনায় তাকে আমরা মানবিক কাঠগড়ায় দাঁড় করাইনি! কিন্তু দেখুন, লেখক বারবার আমাদের মনের চোখটিকে সজাগ করে তুলতে চেয়েছেন। যুবক শিক্ষকের চোখ ও মনের ঝলসেওঠা আগুন ও উত্তেজনার কিছুটা রেশ অন্তত পাঠকের সামনে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। ‘আলো-অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধ-উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়।... পায়ের ওপর এক ঝলক চাঁদের আলো।’, ‘শাড়িটা অসংলগ্ন, পায়ের কাছে এক ঝলক চাঁদের আলো।’Ñ এইসব বাক্যে প্রযুক্ত অনুভব দ্বারা লেখক কী বোঝাতে চাইছেন? যুবকের মনের ভেতরে, শরীরের গোপনস্তরে লুকিয়েথাকা জৈবিক কামনার কথা? যুবক শিক্ষক অবিবাহিত। সম্ভবত জীবনে কোনো নারীর (জৈবিক তাড়নায় প্রার্থিত) সাথে মানসিক কিংবা শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করাটা হয়ে ওঠেনি! কিংবা কে জানে, কী রহস্য গোপন আছে যুবকের মনে? কে-ই বা এই যুবতী? যুবতীর সাথে তার পূর্ব-পরিচয় ছিল কি-না? তা থেকে থাকলে তার প্রতি কোনো আকর্ষণী দৃষ্টি কখনো প্রসারিত হয়েছিল কি-না? ‘যুবতী নারী’কে ঘিরে কি যুবক শিক্ষক ও কাদেরের মধ্যে কোনোরকম প্রতিযোগিতা ছিল (কে পাবে, কে পাবে নাÑ ধরনের!)? ‘যুবতী নারী’ কি মৃত্যুর আগপর্যন্ত এসবের সবকিছু জানতো? এইসব ভাবনায় আমাদের ঘোরলাগাচোখে যেন খানিকটা তন্দ্রার জন্ম নেয়Ñ লেখকের একটা বর্ণনা পাঠ করে। তিনি (আখ্যানের প্রায় শেষভাগে, বিচারের প্রায় দ্বারপ্রান্তে, যুবকের শাস্তি যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন) জানাচ্ছেন: কিন্তু কে শাস্তি পাবে? পুলিশ-কর্মচারীর সামনে বসে যুবক শিক্ষকের হয়তো এই ধারণা হয় যে, কে শাস্তি পাবে সেটি আর প্রধান কথা নয়। শাস্তিটার অর্থ যখন মৃত যুবতী নারীর কাছে আর পৌঁছবে না, তখন কে শাস্তি পাবে তাতে তার আর কী এসে যাবে? শাস্তিটা তার জন্যে নয়। যুবক শিক্ষক যদি ভুল করে শাস্তিটা নিজের ওপরই টেনে আনে, যুবতী নারীর মৃত্যুর জন্যে সে-ই যদি অবশেষে শাস্তি পায়, তবে শাস্তিটা আসলে যার উদ্দেশ্যে সেখানে তা পৌঁছুবে না। সে-কথায় সে কি একবার সান্ত¡না পেতে পারে না? ‘চাঁদের অমাবস্যা’ নামক আখ্যানটিতে মানুষ, তার চারপাশের সমাজ, চলমান স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক জীবনধারা, ব্যক্তির ব্যক্তিতা প্রভৃতির ধারণার প্রয়োগ আছে। আছে সত্য-অন্বেষার প্রচেষ্টা এবং মিথ্যার প্রতিষ্ঠা (বিচারের নামে প্রহসনের মধ্য দিয়ে)। ‘ব্যক্তিত্ব’ এবং ‘অস্তিত্ব’Ñ এই ধারণাগুলো যুবক শিক্ষকের অনুভবের ভেতর দিয়ে পাঠককে জানান দিতে চেষ্টা করেছেন লেখক। ‘কাদেরের পায়ের তলে সে যেন ঘৃণ্য বস্তু, শিরদাঁড়াহীন নপুংশক কীটপতঙ্গ কিছু।’- অর্থাৎ ব্যক্তিত্বহীন, মেরুদ-হীন এক প্রাণী যুবক শিক্ষক আরেফ আলী! মনে রাখতে হবে, মেরুদণ্ড (সমাজ-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের বারান্দায়) বলতে দেহের পশ্চাৎভাগে কতগুলো হাড়ের সমষ্টিকে বোঝায় না- এটি একটি কনসেপ্ট বা ধারণাজ্ঞাপক শব্দ। মেরুদ-হীন প্রাণী (রক্ত-মাংসের মানুষ বলে কথা!) যুবক শিক্ষক আরেফ আলী কি মানসিক বিভ্রমে ভোগেনি? শেষত তার সকল সম্ভাবনা, প্রতিবাদের কণ্ঠ, স্বপ্ন প্রভৃতি পরাজিত হয় সামাজিক বিপন্নতা, আর্থিক নির্ভরতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার অনৈতিকতার দাপটের কাছে। অন্ধকারের কাছে হেরে যায় সমূহ আলো। চাঁদ যেন ঢেকে যায় অমাবস্যার আড়ালে। টিকে থাকার লড়াইয়ে পেছনে পড়ে যায় সত্যনিষ্ঠ জনতা। অসহায় মানুষ ডুবতে থাকে অপমান আর যন্ত্রণার অতলে!
×