বাংলাদেশের চিত্রকলার অঙ্গনে ত্রিরতœ বললে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া কামরুল হাসানের পাশাপাশি অপর যে গুণী শিল্পীর নাম স্বভাবতই চলে আসে তিনি হলেন- পটুয়া-বাউল শিল্পী শেখ মুহাম্মদ সুলতান বা এসএম সুলতান। প্রকৃত শিল্পী হিসেবে তিনি বাংলাদেশী নাগরিক শিল্পরসিকদের নজরে আসেন ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত তার একক প্রদর্শনীর মাধ্যমে। এ প্রদর্শনীতে ৭৫-টিরও বেশি শিল্পকর্ম শিল্পবোদ্ধা ও সমালোচকদের রীতিমতো চমকে দেয়। তার চিত্রকর্মের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল পল্লী বাংলার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ ও তাদের পরিশ্রমী জীবন, যেটি তদানীন্তন প্রেক্ষাপটে রীতিগত দিক থেকে ছিল সম্পূর্ণ নতুন আর ভাবগত জায়গায় ছিল নিঃসন্দেহে শিহরণসঞ্চারি। মানুষ বলতে সুলতান পেশিবহুল শ্রমজীবীদের বার বার তাঁর চিত্রকর্মে উপস্থাপন করেছেন যা মানবীয় ও দর্শনগত জায়গায় ছিল বিস্তৃত। সুলতানের জীবনবোধ একজন শিল্পী হিসেবে ছিল প্রকট আর তার উপস্থাপনের বাচনভঙ্গি, রচনারীতি ছিল অত্যন্ত যতœশীল। তাই তো তার এই যতœশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও সৃজনশীলতাকে কাব্যিক রূপ প্রদান করতে প্রখ্যাত অধ্যাপক ও শিল্পবোদ্ধা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তাকে ‘দেশজ আধুনিকতার রূপকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
এস এম সুলতানের জন্ম ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট নড়াইল জেলার মাছিমদিয়া গ্রামে। আর বেড়ে ওঠা চিত্রা নদীর পাড়ে। পেশার দিক থেকে তার বাবা ছিলেন একজন গাঁথনি শিল্পী (ইমারত তৈরির কারিগর) আর সে কাজে সুলতানের সম্পৃক্ততা আশৈশব। শিল্পের ছোঁয়া তখন থেকেই তাকে নাড়া দিয়ে যেত। অন্যদিকে, কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে শিল্পী সুলতান নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন শ্রমজীবী মানুষ, উর্বর মাটি, সোনাফলা ফসল আর নয়ন জুড়ানো গ্রাম। সেজন্যই বোধ করি তার শিল্পের বিষয়বস্তু ইউরোপ-আমেরিকা অথবা উপমহাদেশীয় অঞ্চল ঘুরে এসেও নাড়ির টানে বরাবরই ছিল ‘গ্রামকেন্দ্রিক’। কোন কোন শিল্পসমালোচকের মতে, সুলতানের হাত ধরেই বাংলাদেশের রাখালি শিল্প পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।
তরুণ শিল্পী সুলতানের ঝুলিতে অল্প বয়সেই যোগ হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও শিল্পানুরাগী শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর মতো গুণীজনের পৃষ্ঠপোষকতা। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি কলকাতা আট কলেজে (১৯৪০) ভর্তি হলেন ঠিকই কিন্তু ১৯৪৪ সালে বেরিয়ে পড়েন ভারত ভ্রমণে। কাশ্মীরের পাহাড়ী সবুজ, সিমলার উপজাতির দল তাকে বিমোহিত করে যার দরুন তিনি ছবি এঁকে নজর কাড়েন মিসেস হার্ডসন নামে জনৈক কানাডিয়ান ভদ্রমহিলার। মিসেস হার্ডসনের উদ্যোগেই সুলতানের প্রথম প্রদর্শনী ১৯৪৬ সালে সিমলায়। ভারত পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণের মধ্যদিয়ে সুলতানের জীবনে আসে এক নতুন অধ্যায়। তখন তিনি পাড়ি জমান লাহোরে, সখ্য গড়েন আবদুর রহমান চুগতাই, শাকের আলী, শেখ আহমেদসহ অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে। তারপর ৪৮-এ লাহোরে ও ৪৯-এ করাচিতে তার প্রদর্শনী হয়। ৫০-র দশকে এই শিল্পীর জীবনে যুক্ত হয় অন্য আরেকটি মর্যাদা; আর্ট ইন পাকিস্তান (অৎঃ রহ চধশরংঃধহ) নামক গ্রন্থে তাকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময়ী শিল্পী হিসেবে অভিহিত করা হয়, যেটির ব্যত্যয় পরবর্তীতে ঘটেনি। তার কিছুকাল পরেই ১৯৫৩ সালে সুলতান ফিরে আসেন স্বদেশের মাটিতে, চিরচেনা নড়াইলে। এ কালপর্বকে কোন কোন সমালোচক সুলতানের আধ্যাত্মিক পর্ব হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। এ সময় তিনি ধ্যান-সাধনা করেন ও হয়ে ওঠেন জীবন্ত কিংবদন্তি। আনুমানিক ১৯৭৪ অবধি সুলতানের এই কর্মযজ্ঞ বহাল থাকে এবং ধারণা করা হয় এ সময় তিনি খুব কমসংখ্যক শিল্পকর্ম রচনা করেন, বা করে থাকলেও তার কোন হদিস আজও পাওয়া যায়নি। এই মতামতের পেছনে একটি ব্যাখ্যা রয়েছে যেমন, সুলতান ছবি আঁকার জন্য যেসব কাগজ ব্যবহার করতেন তা সময় সাপেক্ষে বিলীন হওয়ার প্রবণতা রাখত সেজন্য ছবি একে থাকলেও উদ্ধার হয়নি। ১৯৭৬-এর প্রদর্শনীর পর সুলতানের জীবনে আসে নতুন আবহাওয়া, পাল্টাতে থাকে প্রেক্ষাপট, নাম-যশ-খ্যাতি কুড়িয়ে তিনি যথারীতি চিত্রশিল্পী হিসেবে আখ্যা পেয়ে যান ও আলোচনায় চলে আসেন। ১৯৮৭ সালের ঢাকাস্থ গ্যোটে ইনস্টিটিউটে (জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে) তার আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সুপ্রসন্ন ভাগ্যের অধিকারী, সৃজনশীলতার অন্যতম পুরোধা সুলতান স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার থেকে ১৯৮৪ সালে একমাত্র শিল্পী হিসেবে ‘রেসিড্যান্ট আর্টিস্ট’ সম্মাননা অর্জন করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর এই প্রথিতযশা শিল্পী পরলোক গমন করেন।
শিল্পী সুলতান ছিলেন মরমী সাধক। শিল্পিত সাধনাকে কাজে লাগিয়ে তিনি মাটির গন্ধ শুঁকে তা পটে চিত্রায়িত করেছেন। সেজন্য স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে তার চিত্রে মেটে রঙের উপস্থিতি প্রাধান্য পায়। তবে, কেউ কেউ বলেন সুলতানের কাজে তার আধ্যাত্মিকতার চর্চা অনুপস্থিত বরং তিনি অনেক বেশি প্রকৃতি ঘেঁষা। আবার সেই প্রকৃতি গৌণ রূপে উপস্থাপিত হচ্ছে মানুষের সামনে। মানুষ প্রকৃতিকে শাসন করছে। কৃষকের শাসনে মাটি ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। সুলতানের কাছে ছবি আঁকাটাই ছিল মুখ্য। মাধ্যমের স্থায়িত্ব নিয়ে তিনি কখনোই চিন্তা করেননি, করলে হয়ত আরও শক্ত এবং স্থায়ী তলের ওপর ছবি আঁকতেন। নিজের হাতে রং তৈরি করে সেটি দিয়ে ছবি আঁকতেন বলে তার ছবিতে সম্পৃক্ততা বেশ লক্ষণীয়। তবে, ছবি আঁকার নান্দনিকতায় মুগ্ধ সুলতানের কাজ প্রায়ই ঐকতানহীন; কখনও তিনি আঁকতেন চিত্রার পাড়ে নারীদের পানি সংগ্রহের দৃশ্য, আবার কখনও আঁকতেন হত্যাযজ্ঞ, কখনও বা সেটি পরিবর্তিত হয়ে জমি দখলের সংগ্রামে রূপায়িত হচ্ছে, আবার কখনও সেটি গ্রামের মাছ কাটা নারীর কাছে ফিরে আসছে। সুলতানের এই বিষয়বস্তুর ক্রমাগত পরিবর্তন, বা লম্ফন তার যাপিত জীবনের ঐকতানহীনতা কে বা তার জীবনের খামখেয়ালীপনাকেই মূলত দৃশ্যায়িত করে। সুলতানের চিত্রকর্মে অঙ্কিত পুরুষ অবয়বগুলো পাশ্চাত্যের গুরুশিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর ভাস্কর্যের মতোই পেশিবহুল তবে, সেটিতে নাটকীয়তা নেই। সেই পেশিতে আছে শক্তি, সৃষ্টির গর্জন, পুরাতন ভেঙ্গে নতুনকে গড়ার প্রত্যয়। তার চিত্রে নারীরাও প্রদর্শিত হয়েছে একই ভঙ্গিতে। সেটির জন্য নারীদের শরীর কিছুটা অনাবৃত রাখতে হয়েছে তাকে। কিন্তু, সুলতানের নারী পাশ্চাত্যের অনাবৃত নারীদের মতো নয়। সুলতানের আঁকা আপাত অনাবৃত নারীর মধ্যে কোন যৌন আকাক্সক্ষার প্রকাশ নেই, নেই কোন আবেদনের সুড়সুড়ি। এই বৈশিষ্ট্যটি পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী প্যল গঁগ্যার তাহিতি দ্বীপে নারীকে বিষয়বস্তু করে অঙ্কিত চিত্রের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। সুলতানের উদ্দেশ্য, দ্যর্থ্যহীন কণ্ঠেই বলতে হয়, শুধুমাত্র মানব শরীরের নান্দনিকতা উপস্থাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং প্রকৃতির সঙ্গে তার রূপ এবং গাঠনিক পরিবর্তনের সঙ্গেও তা সম্পর্কিত ছিল। তাই সেগুলো অনমনীয় হলেও বরাবরের মতোই ছিল মার্জিত।
সুলতানের চিত্রের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল তার জীবনের মতোই ধ্রুব সত্য- ‘ভাবালুতা’। নিঃসন্দেহে মানব সুলতান আবেগপ্রবণ ছিলেন। বাংলাদেশে বিমূর্তায়নের স্বর্ণযুগে বসেও তিনি সেইদিকে মনোনিবেশ করেননি, এঁকেছেন স্বদেশের মাটি ও মানুষকে। সুলতানের চিত্রভাষা শিল্পী জয়নুল আবেদীনের মত বাস্তববাদী না হলেও সেগুলোর শিশুসুলভ আধো বোধগম্য আধো স্পষ্ট ভাষা দর্শকের হৃদয়ে আলোড়ন তোলে, পেশির টানে সে তেজ উদ্বেলিত, রচনাভঙ্গিতে সেগুলো সুস্পষ্ট। সুলতানের দৈত্যাকৃতি ক্যানভাস তার মতই উন্মেষক যেন প্রতিকৃতিগুলো বেরিয়ে আসবে। তবে, আফসোসের বিষয়- সুলতানের শিল্পদর্শন বা তার চিত্রকর্মের অনুকরণ পরবর্তীতে আর অনুসৃত হয়নি। সুলতানের চিত্রভাষা হতে পারত বাংলাদেশের একটি প্রগতির পুরোধা। কিন্তু, অধরা সুলতান অধরাই রয়ে গেলেন, থেকে গেলেন দুর্বোধ্য। প্রয়াণ দিবসে মহান এই শিল্পীর আত্মার শান্তি কামনা করছি। বিনম্র শ্রদ্ধা...
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: