ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

টিভি নাটকের একাল-সেকাল

প্রকাশিত: ১৩:২৪, ১০ অক্টোবর ২০১৯

টিভি নাটকের একাল-সেকাল

একটা সময় ছিল যখন সপরিবারে নাটক উপভোগ করতেন এ দেশের নাটকপ্রেমী দর্শকরা। সামাজিক বক্তব্যধর্মী নাটকগুলোই দর্শকরা বেশ পছন্দ করতেন। শিক্ষামূলক নাটককেও দর্শকরা ফিরিয়ে দিতেন না। নাটকে ফুটে উঠত সামাজিক ও পারিবারিক মূলবোধ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টিভি নাটকের সেই চিরচেনা চেহারা মোটেও সুখকর নয়। দেশে এখন অনেক চ্যানেল, অনেক নাটক নির্মিত হচ্ছে কিন্তু মানসম্মত কাজ তেমন হচ্ছে কি? অভিযোগ রয়েছে, কিছু তরুণ অপেশাদার নাট্য নির্মাতা, প্রযোজক, বিজ্ঞাপন এজেন্সি বা চ্যানেল মালিক সিনিয়র শিল্পীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারছেন না। বর্তমানে টেলিভিশন নাটক নির্মিত হচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকাকেন্দ্রিক। দুই তিন জন শিল্পী নিয়েই এখনকার নাটক শেষ করা হচ্ছে। এমন অভিযোগ প্রায়ই শুনতে হয়। তা ছাড়া নাটকের সব টাকা নিয়ে যাচ্ছে নায়ক-নায়িকা দুটি চরিত্র, যে কারণে পরিবার ছাড়াই নির্মাণ হচ্ছে নাটক। এ ছাড়াও বর্তমান নাটকের মান নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। যেমন একঘেয়েমি, সুড়সুড়ি দেয়া কমেডি নাটক ও অভিভাবকহীন প্রেমিক-প্রেমিকাকেন্দ্রিক নাটক নির্মিত হচ্ছে হরহামেশাই। ফলে এখনকার নাটকে বাবা-মা, ভাই-ভাবি কিংবা মামা, চাচাবিহীন নাটক ক্রমেই বেড়ে চলেছে। যেখানে নাটক সামাজিক সচেতনতার মূল হাতিয়ার সেখানে অভিভাবকহীন নাটক বর্তমানে পারিবারিক বন্ধন হুমকিস্বরূপ। নায়ক-নায়িকাকে উপজীব্য করে গল্প তৈরি হওয়ায় ক্রমেই দর্শক হারাচ্ছে বোকাবাক্স। তাই তো ড্রয়িংরুম পরিবার নিয়ে নাটক দেখার গল্পটা এখন অতীত। এ জন্যই এখনকার নাটক দর্শকবিমুখতার অন্যতম কারণও বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। এ প্রসঙ্গে বর্ষীয়ান অভিনেত্রী দিলারা জামান বলেন, ‘এক সময়ে নাটকে মায়ের চরিত্রই ছিল মুখ্য। আমরা বলি মায়ের চেয়ে আপন কেউ নেই। অথচ এখনকার নাটকে সেই মা-ই বিলুপ্ত। বর্তমান নাটকে যাদের দেখনো হয় তারা কি আসমান থেকে এসেছে? এমনও শোনা যায় যে, মা-বাবাকে নিলে বাজেট বেড়ে যায়। আবার এমনও বলে বাবা-মা নিলে চলে না! তাই বলা চলে বর্তমান টিভি নাটক অভিভাবকহীন! ব্যাপারটি নিয়ে নাট্যনির্মাতা আকাশ রঞ্জন বলেন, ‘আমরা একটা চক্রের মধ্যে পড়ে গেছি। এখন বাজেট কমানোর জন্য নাটকে মা ও বাবা দুটি চরিত্রই কেটে ফেলা হয়। যেটা কোনভাবেই কাম্য নয়।’ আক্ষেপ করে জনপ্রিয় অভিনেত্রী আরজুমান্দ আরা বকুল বলেন, ‘বর্তমান নাটকের গল্পই লেখা হয় প্রেমকেন্দ্রিক। সামাজিক গল্পকারের অভাব। নাটক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। তবে এখনকার নাটকে সেই চিত্র খুঁজে পাই না। অথচ আগেকার নাটকে পরিবারের সবাই থাকতেন এবং সবাই পরিবার নিয়েই নাটক দেখতেন। একজন শিশু যখন নাটক দেখে তখন যদি দেখে নাটকে তার মতো কেউ নেই তখন সেই শিশুটি নাটক দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। টিভি নাটক আয়নার মতো আমারই কথা বলবে, সমাজের কথা বলবে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ দু-একটি ছোট চরিত্রের জন্য ডাকে। যারাই ডাকে না কেন শুরুতেই জানায়, নাটকের বাজেট কম। যখন প্রশ্ন করি বাজেট কম কেন তখন বলেন, মূল চরিত্র বাজেটের সিংহভাগ নিয়ে যাচ্ছে। তবে ভারতের নাটক পরিবারকেন্দ্রিক, গল্পনির্ভর। যার কারণে সবাই তাদের নাটক দেখছেও। অভিভাবকহীন নাটক কখনই বেশি দূর এগোতে পারে না। এ ছাড়াও সিনিয়র শিল্পীদের মূল্যায়ন করা হয় না। আগে শূটিং স্পট ছিল পরিবারের মতো। কিন্তু এখন আর তা নেই। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচালক বলেন, ‘আমাদের আসলে কিছু করার নেই। কারণ টিভি থেকে বলে দেয়া হয় এই গল্পের জন্য কাকে দিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা যখন সেই শিল্পীর কাছে সিডিউল চাই তখন তিনি নাটকের অর্ধেক টাকা দাবি করেন। এখন একটা নাটকে যে বাজেট থাকে তার থেকে ৭০ ভাগ টাকা নেন নায়ক ও নায়িকা। এমন হলে কীভাবে পরিবার নিয়ে সুন্দর একটি নাটক নির্মাণ করব। তবে ঘটনা যা-ই হোক, মা ছাড়া যেমন পরিবার অসম্পূর্ণ, তেমনি মায়ের চরিত্র ছাড়া নাটকও অসম্পূর্ণ। এমনটাই মনে করেন নাটকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু সেটা মনে করলেও বাজেট, স্বল্প সময়ে নাটকের কাজ শেষ করা এবং চ্যানেলের চাপ, এ কারণে আপাতত মাবিহীন নাটক বেশি নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু সেটা কারোর জন্যই কাম্য নয়।
×