ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নেটফ্লিক্সের ইতিহাস

সিনেমা বনাম অনলাইন স্ট্রিমিং

প্রকাশিত: ১৩:২৩, ১০ অক্টোবর ২০১৯

সিনেমা বনাম অনলাইন স্ট্রিমিং

রিড হ্যাস্টিংসের মাথায় অনলাইন স্ট্রিমিংয়ের ধারণা প্রথম এসেছিল ১৯৮০ সালে। একটি গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে তিনি প্রথম এ রকম একটি মাধ্যমের কথা ভাবেন। কিন্তু তখন ইন্টারনেট নিজেই ছিল প্রাথমিক অবস্থায়। ১৯৯৭ সাল থেকে ডিভিডি ব্যবহার করে তার যাত্রা শুরু। তারা শুরুতে সিনেমার ডিভিডি ভাড়া বা বিক্রি করত। ১৯৯৯ সাল থেকে তারা সাবক্রিপশন পদ্ধতি চালু করে। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে কেউ নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিভিডি ভাড়া নেয়া যেত। ২০০২ সাল নাগাদ কোম্পানিটি মার্কিন শেয়ার বাজারে যুক্ত হয়। ২০০৫ সালে তাদের গ্রাহক ৪ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। ২০০৭ সাল থেকে নেটফ্লিক্স অনলাইন স্ট্রিমিং শুরু করে। তখন শুধু কম্পিউটার থেকেই স্ট্রিমিং করা যেত। ২০১০ সাল নাগাদ ইন্টারনেট আছে এমন যে কোন ডিভাইসে নেটফ্লিক্স দেখার ব্যবস্থা চালু হয়। এতদিন তাদের সেবা আমেরিকা এবং কানাডাতে ছিল। ২০১১ সালে আমেরিকা মহাদেশের বাকি দেশগুলোতে চালু হয় নেটফ্লিক্স। পরের বছর ইউরোপ এবং ২০১৫ সালে সারা বিশ্বে নিজেদের সম্প্রচার শুরু করে নেটফ্লিক্স। ২০১৭ সালে তাদের গ্রাহক সংখ্যা ১০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। ওই বছরই সেরা ছোট ডকুমেন্টারি ফিল্ম বিভাগে অস্কার জিতে নেটফ্লিক্সের নির্মিত ‘দ্য হোয়াইট হেলমেট’। বিতর্ক কোথায়? বেশ কয়েক বছর ধরেই বক্স অফিসকেন্দ্রিক সিনেমাগুলোর সঙ্গে এক অলিখিতি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে নেটফ্লিক্স। অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের এই ওয়েবসাইটে একজন গ্রাহক তুলনামূলক কম অর্থে বিনোদনের অনেক উপাদান পেতে পারেন। ২০০৭ সালে শুরুর পর থেকে অতিকায় এক জগত গড়ে তুলছে নেটফ্লিক্স। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর খোঁচা শুরু থেকেই আছে। প্রথমত হলেই যদি না প্রদর্শিত হয় তাহলে আবার কিসের সিনেমা বলে তাকে? দ্বিতীয়ত শিল্পমানের দিক থেকে সিনেমাগুলো বেশ নিচু মানের। হ্যাঁ প্রথম দিকের সিনেমাগুলোকে দ্বিতীয় অভিযোগ দেয়াই যায়। কিন্তু ধীরে ধীরে নেটফ্লিক্স তাদের সিনেমার মানকে উন্নত করে। নেটফ্লিক্সের বড় সাফল্য আসে ‘রামা’ ছবির মাধ্যমে। সেরা পরিচালনা, সেরা চিত্রগ্রহণ এবং সেরা বিদেশী ভাষার চলচিত্রে অস্কার তুলে নেয় সিনেমাটি। এই সিনেমার অস্কার পাওয়া যেন বিতর্কের আগুনে আরও ঘি ঢালছে। অস্কারের নিয়ম অনুযায়ী লস এ্যাঞ্জেলসের প্রেক্ষাগৃহে অন্তত ৭ সপ্তাহ সিনেমা প্রদর্শিত হতে হবে। সমালোচকরা বলছেন শুধুমাত্র অস্কারে মনোনয়ন পেতে তড়িঘড়ি করে সিনেমাগুলো হলে নামমাত্র মুক্তি দেয়া হয়। ফলে নষ্ট হচ্ছে সিনেমার সৌন্দর্য। রোমা নির্মাণে খরচ হয়েছে ১৫ মিলিয়ন ডলার। অথচ ছবিটির প্রচারেই ২৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করছে নেটফ্লিক্স। এটা থেকেই বোঝা যায় তারা কি পরিমাণ মরিয়া ছিল একটি অস্কারের জন্য। অস্কারজয়ী অভিনেত্রী হেলেন মিরেনের মতে, হলে বসে সিনেমা দেখার মতো আর কিছুই হয় না। সমালোচকদের তালিকাতে আছেন স্টিভেন স্পিলবার্গও। তবে অনেকের মতেই অনলাইনভিত্তিক সিনেমা সময়ের চাহিদা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষ নেটফ্লিক্সের দিকে ঝুঁকবে। তার ফলে হলে সিনেমা দেখা কমবে না। বুলবুল বিশ্বাস মনে করেন, অনলাইন স্ট্রিমিং সময়ের চাহিদা। দিনশেষে দর্শকদের সন্তুষ্টিটাই বড়। তিনি আরও জানান, ‘নানা কারণে সময়ের স্বল্পতায় দর্শকের হলে যাওয়া কমে গেছে আর সে জায়গাটাই নিচ্ছে নেটফ্লিক্স। বাংলাদেশের কথা বললে সিনেমা শিল্পই ধ্বংস। স্পষ্ট করেই বলতে পারি এটা নিয়ে কারোর মাথাব্যথাই নেই। সিনেমাই যেখানে নেই সেখানে হল এবং অনলাইনের দ্বন্দ্ব আসবে কিভাবে? ভাল বাজেট পেলে বাংলাদেশের অনলাইন সিনেমা শিল্পও গড়ে উঠবে।’ নেটফ্লিক্স এবং থিয়েটার নিয়ে কথা হল নির্মাতা রায়হান রাফির সঙ্গেও। তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তিকে আঁটকে রাখা যায় না। টেলিফোন আসার পর কিন্তু চিঠি বিলুপ্ত হয়নি। আমাদের এটাকে সাধুবাদ জানাতেই হবে। এমন সিনেমা বানাতে হবে যেটা হল এবং অনলাইন দুই জায়গাতেই চলবে। শুধু অনলাইনের সিনেমা হলে অনেক সময়ই সেটা মানসম্মত হয় না। এ ছাড়াও প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা শেষ হওয়ার পর যদি কেউ দেখতে চায় তাহলে অনলাইন তাদের জন্য খুব ভাল অপশন।’ কান উৎসবে নেটফ্লিক্স বিতর্ক সিনেমা জগতের গুণী ব্যক্তিদের একটা বড় অংশই নেটফ্লিক্সের সিনেমাকে ‘সিনেমা’ বলতেই নারাজ। চলচিত্রের মর্যাদাপূর্ণ সব আসরেও নেটফ্লিক্সের ছবি দেখতে চান না। এবারের কানে মূল প্রতিযোগিতার বাইরের ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটে স্থান পেয়েছিল নেটফ্লিক্স ছবি ‘উন্ডস’। বিগত দুই বছরের মতো এবারেও কানে অংশ নিতে পারেনি অনলাইন স্ট্রিমিংভিত্তিক কোন ছবি। কান আসতেই আবারও সেই পুরনো আগুনে ঘি ঢালছে। নেটফ্লিক্স ভক্তদের প্রশ্ন ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটে অংশ নিতে পারলে কেন মূল প্রতিযোগিতায় নয়? একদিকে নেটফ্লিক্স যখন বড় আসরে তাদের ছবি অন্তর্ভুক্ত করতে যুদ্ধ করে যাচ্ছে তখন নেটফ্লিক্সের সিনেমাকে পরিপূর্ণ ‘সিনেমা’ নয় তকমা দিয়ে কাজটি আরও কঠিন করে দিচ্ছেন অনেকেই। বাংলাদেশ এবং নেটফ্লিক্স দিন দিন দেশে বেড়ে চলেছে নেটফ্লিক্স গ্রাহকের সংখ্যা। তারুণ্য মেতেছে নেটফ্লিক্স জ্বরে। বাংলাদেশ থেকে বছরে ২২ কোটি ডলার আয় করলেও সরকারকে কোন রাজস্ব দিতে হচ্ছে না তাদের। নির্মাতাদের মতে নেটফ্লিক্সকে করের আওতায় আনা উচিত। এই খাত থেকে হওয়া আয় দেশের সিনেমা শিল্পের উন্নয়নে ব্যবহার করা উচিত। নেটফ্লিক্স ছাড়াও দেশীয় বেশ কয়েকটি অনলাইন স্ট্রিমিং চলছে দেশে। তবে দর্শকরা তাদের সেবাতে খুশি নন। তাদের আশা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় স্ট্রিমিংগুলো উন্নত হবে।
×