ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জামায়াত শিবির কানেকশন

সন্দেহ ছিল আবরারকে, দেখা গেল হত্যায় জড়িত তিনের সম্পর্ক

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ১০ অক্টোবর ২০১৯

সন্দেহ ছিল আবরারকে, দেখা গেল হত্যায় জড়িত তিনের সম্পর্ক

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার ফাহাদ রাব্বীকে পিটিয়ে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে তিন ছাত্রের পরিবার জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ওই তিন ছাত্র এক সময় গোপনে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ আছে। এমন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে গভীর অনুসন্ধান চলছে। বিভিন্ন সময় নানা ইস্যুতে আবরার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিত। সেসব স্ট্যাটাস আপত্তিকর ছিল বলে গ্রেফতারকৃতদের দাবি। স্ট্যাটাসগুলো পর্যালোচনা করে হত্যাকারীরা আবরার শিবির করত বলে ধারণা করে। এজন্য ঘটনার দিন আবরারকে ডেকে নিয়ে সে শিবির করে কিনা এবং হলে শিবিরের তৎপরতা সর্ম্পকেও জানতে চায়। আবরার রাজনীতি করে না বলে জানায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মারধরের একপর্যায়ে আবরারের মৃত্যু হয়। তদন্তে আবরারের পরিবার বা তার জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে কোন সংশ্লিষ্টতার তথ্য মেলেনি। এদিকে হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আরও এক বুয়েট শিক্ষার্থীকে আটক করেছে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ নিয়ে মোট ১৪ জন গ্রেফতার হলো। মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার হওয়া তিন জনকে প্রত্যেককেই পাঁচদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, ঘটনার সূত্রপাত হয় গত প্রায় চার মাস আগে। নানা ইস্যুতে আবরার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতো। বিশেষ করে রাজনৈতিক ইস্যুতে দেয়া স্ট্যাটাসগুলো নিয়ে ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার নেতাদের মধ্যে একধরনের অসন্তোষ ছিল। ধারবাহিকভাবে স্ট্যাটাস দেয়া অব্যাহত থাকায় আবরার জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী এবং সে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে বদ্ধমূল ধারণার জন্ম হয় বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর অনেকের মধ্যে। এজন্য দীর্ঘদিন ধরেই আবরার শিবিরের রাজনীতি করে কিনা, সে বিষয়ে খোঁজখবর রাখছিল তারা। কিন্তু কোনকিছুতেই তার সর্ম্পকে সুস্পষ্ট কোন তথ্য পাচ্ছিল না। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়। আবরার শিবিরের রাজনীতি করে কিনা বা জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী কিনা তা নিশ্চিত হতে চাইছিল ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা ও কর্মী। এজন্য গত ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাহাদকে শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্য একটি রুমে নিয়ে সে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি করে কিনা বা জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী কিনা এবং হলে শিবিরের তপৎরতা সর্ম্পকে জানতে চায়। আবরার জানায়, সে রাজনীতি করে না। হলে শিবিরের তৎপরতা সর্ম্পকে তার কোন ধারণা নেই। মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আবরার শিবির করে না বলে হত্যাকারীদের জানায়। আবরারের কথা বিশ্বাস করতে পারেনি হত্যার সঙ্গে জড়িতরা। তারা আবরারকে মারধর করতে থাকে। মারধরের সঙ্গে তাকে বার বার একই বিষয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করে হত্যাকারীরা। বার বার আবরার একই উত্তর দিয়েছে। এতে মারধরের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। মারধরের একপর্যায়ে আবরারের মৃত্যু হয়। আবরারের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। পিতা বরকত উল্লাহ এনজিওকর্মী। মায়ের নাম রোকেয়া বেগম। তিনি কিন্ডার গার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে আবরার বড় ছিল। তার ছোট ভাই ঢাকা কলেজের ছাত্র। তিনি আরও জানান, নিহত আবরার ও তার পরিবারের বিষয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। এখন পর্যন্ত অনুসন্ধানে আবরার বা তার পরিবারের জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী বা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে হত্যাকা-ে জড়িতদের মধ্যে ৩/৪ জনের পরিবার জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী বলে তথ্য মিলেছে। শুধু ওই ৩/৪ জনের পরিবার নয়, তাদের আত্মীয়স্বজনরাও জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী। কোন পরিবার জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। যদিও এই পুলিশ কর্মকর্তা ওই ৩/৪ শিক্ষার্থীর নাম প্রকাশ করেননি। ওইসব শিক্ষার্থীরা এক সময় শিবিরের রাজনীতি করত বলে প্রচার থাকলেও এখনও তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাদের সম্পর্কে ও তাদের পরিবারের সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। হত্যাকা-ে মোট ১৯ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এর বাইরে হত্যাকা-ে কেউ ইন্ধন বা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত কিনা সে বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত তদন্তে গ্রেফতার হয়ে পাঁচদিনের রিমান্ডে থাকা তেরো জনের মধ্যে তিনজনের পরিবার জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে বেরিয়ে এসেছে। যার মধ্যে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলের পরিবারও আছে। তার পরিবার জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। এমনকি তার আত্মীয়স্বজনরাও জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী এবং ওই আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। মেহেদী হাসান রাসেল বুয়েটের ১৩তম ব্যাচের ছাত্র। তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তার পিতার নাম রুহুল আমিন। মায়ের নাম ঝর্ণা আমিন। বাড়ি ফরিদপুর জেলার শালথা থানাধীন সূর্যদিয়া এলাকার রাঙ্গারদিয়া গ্রামে। তিনি বুয়েটের শেরেবাংলা আবাসিক হলের ৩০১২ নম্বর কক্ষে থাকতেন। এছাড়া রিমান্ডে থাকা মুহতাসিম ফুয়াদের পরিবারও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ১৪তম ব্যাচের ছাত্র তিনি। বুয়েট ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন শেরেবাংলা হলের ২০১০ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র। তার পিতা নাম মোঃ আবু তাহের। মায়ের নাম সালমা ইয়াসমিন। বাড়ি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানাধীন দৌলতপুর এলাকার লাঙ্গলমোড়া গ্রামে। অপরজন ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন। তিনি ১৫তম ব্যাচের ছাত্র। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। শেরেবাংলা হলের ৩০৭ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র। তার রোল নম্বর ১৫। পিতার নাম মাকসুদ আলী। মায়ের নাম রাশিদা বেগম। বাড়ি রাজশাহী জেলার পবা থানাধীন চৌমাহানি এলাকার কাপাসিয়া গ্রামে। প্রসঙ্গত, গত ৬ অক্টোবর রাত তিনটার দিকে আবরারকে হলের দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির কাছ থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ছাত্র ও হলের শিক্ষকরা। তাকে দ্রুত ঢাকা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হয়। সোমবার ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা ফাহাদকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পর সিসি ক্যামেরার ফুটেজে হত্যাকা- সম্পর্কে ধারণা পায় পুলিশ। সোমবার দুপুরেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে লাশের ময়নাতদন্ত হয়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢামেক ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান মোঃ সোহেল মাহমুদ জানান, ফাহাদকে বাঁশ বা স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা পেইনের (ব্যথা) কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আবরারের পিতা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে ১৯ ছাত্রকে আসামি করে চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সোমবার পুলিশ অভিযান চালিয়ে হত্যাকা-ে জড়িত ১০ জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা সবাই ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার নেতা। গ্রেফতারকৃতদের সবাইকে ছাত্রলীগ থেকে সারাজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (২৪)। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহতামিম ফুয়াদ। তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার। বুয়েটের ১৫তম ব্যাচের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। উপ-সমাজকল্যাণ সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল। ১৬তম ব্যাচের বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাতুল ইসলাম জিওন। নেভাল আর্কিটেকচার মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। গ্রন্থনা ও গবেষণা সম্পাদক ইশতিয়াক মুন্না। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ছাত্রলীগ কর্মী মুনতামির আল জেমি, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। মোজাহিদুর রহমান ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাছান রবিন। তাদের পাঁচদিনের রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি পুলিশ। অন্যদিকে মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ঝিগাতলা থেকে বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শামসুল আরেফিন রাফাত (২১), ডেমরা থেকে বুয়েটের পানিসম্পদ বিভাগের ১৬তম ব্যাচের ছাত্র মনিরকে ও সন্ধ্যায় গাজীপুরের বাইপাল থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের ছাত্র আকাশকে আবরার হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। বুধবার তাদের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে আদালতে সোর্পদ করেন ডিবির পরিদর্শক ওয়াহেদুজ্জামান। শুনানি শেষে প্রত্যেককে পাঁচদিনের রিমান্ডে পাঠান ঢাকার মহানগর হাকিম তোফাজ্জাল হোসেন। এদিকে বুধবার আবরার হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বুয়েটের ইলেক্ট্র্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র শাখাওয়াত ইকবাল অভিকে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দক্ষিণ বিভাগ।
×