ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষার্থীদের নতুন করে ১০ দফা ঘোষণা;###;হত্যাকারীদের বিচার, উপাচার্যের পদত্যাগ, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ;###;শেরে বাংলা হলের প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ ;###;দ্রুতবিচার আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি চায় ছাত্রলীগ

উত্তপ্ত বুয়েট ॥ দাবি আদায়ে একাট্টা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ১০ অক্টোবর ২০১৯

উত্তপ্ত বুয়েট ॥ দাবি আদায়ে একাট্টা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকারীদের বিচার, উপাচার্যের পদত্যাগ, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধসহ বিভিন্ন দাবিতে একাট্টা এবার বুয়েটের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দাবি অনুসারে পদত্যাগ করেছেন শেরে বাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জাফর ইকবাল। তবু টানা তৃতীয় দিনের মতো উত্তাল বুয়েটে শিক্ষার্থীরা নতুন করে ১০ দফা তুলে ধরে দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। উপাচার্যের পদত্যাগ, ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধসহ সাত দফা দাবি তুলেছেন বুয়েটের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষকরা। একাট্টা হয়ে আন্দোলনে নেমেছে বুয়েট এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন। হত্যায় জড়িতদের দ্রুতবিচার আইনে বিচারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। মঙ্গলবার উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলামের অবস্থানে বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা ঘোষণা অনুসারে বুধবার সকাল থেকেই বুয়েট শহীদ মিনারে জড়ো হতে থাকেন। এরপর শহীদ মিনারের সামনে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচী। এ সময় আগের দিনের সাত দফার সঙ্গে তিন দফা যুক্ত করে ১০ দফা দাবি তুলে না মানা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন তারা। বেঁধে দেয়া সময়ে দাবি পূরণ না হলে ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত রাখতে হবে। পুরনো দাবির সঙ্গে অবিলম্বে আবরার হত্যা মামলার চার্জশীট প্রকাশ এবং ১৫ অক্টোবরের মধ্যে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার দাবি তোলা হয় কর্মসূচী থেকে। শিক্ষার্থীরা বলেন, বেঁধে দেয়া সময়ে দাবি পূরণ না করা হলে ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের ১০ দফা ॥ আবরার ফাহাদের খুনীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ ও জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য অনুসারে শনাক্ত খুনীদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে জড়িতদের শনাক্ত করে শুক্রবার বিকেল ৫টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার করতে হবে। মামলার সব খরচ এবং আবরারের পরিবারের ক্ষতিপূরণ বুয়েট প্রশাসনকে বহন করতে হবে। শুক্রবার বিকেল ৫টার মধ্যে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক নোটিস জারি করতে হবে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্বল্পতম সময়ে আবরার হত্যা মামলার নিষ্পত্তি করার জন্য বুয়েট প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বুয়েট প্রশাসনকে সক্রিয় থেকে সমস্ত প্রক্রিয়া নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং নিয়মিত ছাত্রদের তথ্য দিতে হবে। আবরার হত্যা মামলার অভিযোগপত্রের কপি অবিলম্বে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করতে হবে। বুয়েটে ‘সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করতে হবে। ১৫ অক্টোবরের মধ্যে বুয়েটে সকল রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। এছাড়া ভিসি কেন ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও ঘটনাস্থলে যাননি এবং ৩৮ ঘণ্টা পরে উপস্থিত হয়ে কেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেছেন, কোন তিনি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্থান ত্যাগ করেছেন, তাকে ক্যাম্পাসে এসে আজ (বুধবার) দুপুর ২টার মধ্যে জবাবদিহি করতে হবে। আবাসিক হলগুলোতে র‌্যাগের নামে এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর সকল প্রকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে এবং এ ধরনের সন্ত্রাসে জড়িত সকলের ছাত্রত্ব প্রশাসনকে বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে আহসানউল্লাহ হল এবং সোহরাওয়ার্দী হলের পূর্বের ঘটনাগুলোতে জড়িত সকলের ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে ১১ অক্টোবর বিকেল ৫টার মধ্যে। আগে ঘটা এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ এবং পরবর্তীতে তথ্য প্রকাশের জন্য একটি কমন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কোন ওয়েবসাইট বা ফর্ম থাকতে হবে ও নিয়মিত প্রকাশিত ঘটনা রিভিউ করে দ্রুততম সময়ে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বুয়েটের বিআইআইএস এ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হবে। ১১ অক্টোবর বিকেল ৫টার মধ্যে দৃশ্যমান অগ্রগতি প্রদর্শন করতে হবে এবং পরবর্তী ১ মাসের মধ্যে কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু করতে হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রত্যেক হলের ফ্লোরের সব উইংয়ের দুই পাশে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে হবে। শেরে বাংলা হলের প্রভোস্টকে ১১ অক্টোবর বিকেল ৫টার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে। দুপুর ১২টায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা একটি বিশাল প্রতিবাদী মিছিল নিয়ে বুয়েট ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে একই সড়ক দিয়ে কয়েকটি এ্যাম্বুলেন্স এলে তারা সচেতনতার সহিত এ্যাম্বুলেন্সগুলোকে যাওয়ার সুযোগ করে দেন। এ সময় তারা বিভিন্ন ধরনের স্লোগানে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন। শেরে বাংলা হলের প্রভোস্টের পদত্যাগ ॥ শিক্ষার্থীদের দাবি অনুসারে দুপুরেই পদত্যাগ করেছেন শেরে বাংলা হলের প্রভোস্ট ড. জাফর ইকবাল খান। বুয়েটের শহীদ মিনারের পাশের রাস্তায় বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের মাঝে এসে বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ কে এম মাসুদ এ কথা জানান। এ সময় বুয়েটের অন্য শিক্ষকেরাও উপস্থিত ছিলেন। প্রভোস্টের পদত্যাগের বিষয়টি জানিয়ে এ কে এম মাসুদ জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে বুয়েটে বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজের পরিস্থিতি নেই। এখন যে ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে, তা স্থগিত করা হবে, না পরীক্ষা হবে, সে সিদ্ধান্ত একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠকে বসে নেবেন তারা। এর আগে শিক্ষক সমিতির এক জরুরী সভায় বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। সেই আলোচনার সিদ্ধান্তগুলো জানান তিনি। মাসুদ বলেন, আবরার হত্যার ঘটনায় বুয়েট উপাচার্যের অদক্ষতা ও নির্লিপ্ততায় তার পদত্যাগ দাবি করছে শিক্ষক সমিতি। তিনি বলেন, উপাচার্য যদি পদত্যাগ না করেন, তাহলে সরকারের কাছে দাবি, তাকে যেন অপসারণ করা হয়। দাবিতে সোচ্চার এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন ॥ বুয়েট ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে আবরার হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশ থেকে উপাচার্যের অপসারণ দাবি করেছে বুয়েট এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন। বুয়েট এ্যালামনাইয়ের সভাপতি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী সাত দফার লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিও জানিয়েছে বুয়েট এ্যালামনাই। সংগঠনটি বলেছে, আবরার হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা জানাই এবং অনতিবিলম্বে হত্যার সঙ্গে জড়িত সকলকে বিশেষ বিচার ট্রাইব্যুনালের আওতায় এনে দ্রুততম সময়ে বিচারের জোর দাবি জানাই। হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত সকল ছাত্রকে অনতিবিলম্বে বুয়েট থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করতে হবে। বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক দলসমূহের অঙ্গ সংগঠনভিত্তিক ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের সকল রাজনৈতিক কর্মকা- অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। বুয়েট প্রশাসনকে ঐতিহ্য পরিপন্থী যে কোন ধরনের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব ও প্রভাব মুক্ত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বুয়েট এ্যালামনাই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এই নির্মম হত্যাকা- বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দীর্ঘদিনের নির্লিপ্ততা, অব্যবস্থা ও ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যর্থতার ফল। অতীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রমের তদন্ত, বিচার ও শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে উপাচার্যসহ বুয়েট প্রশাসনের ধারাবাহিক অবহেলা ও ব্যর্থতা এই নির্মম হত্যাকা-ের মদদ জুগিয়েছে। অবিলম্বে উপাচার্যের অপসারণসহ প্রশাসনের আমূল পরিবর্তন করে এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের মান অতীতের মতো সমুন্নত রাখতে সুযোগ্য, নির্ভীক ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের পদায়ন করতে হবে। র‌্যাগিং এবং অন্যান্য অজুহাতে ছাত্রছাত্রী নির্যাতন নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। ক্যাম্পাসে সকল ছাত্রের সর্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আবরার হত্যাসহ ইতিপূর্বে সংঘটিত অন্যান্য ছাত্র নির্যাতনের ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ বিচার কার্য অবিলম্বে সম্পন্ন করে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের পাশে ডিএসডব্লিউ ॥ সিসিটিভি ক্যামেরার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, মুমূর্ষু আবরারের কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক (ডিএসডব্লিউ) অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। ভিডিও ফুটেজের স্ক্রিনশট নিয়ে একটি ব্যানার বের করেছে শিক্ষার্থীরা। আবরারের পাশে তিনি কি করছিলেন, জানতে চাইলে সে সময়ের পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন মিজানুর রহমান। দুপুরে বুয়েটের শহীদ মিনারের পাশের রাস্তায় বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের মাঝে এসে বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ কে এম মাসুদ বুয়েট উপাচার্য সাইফুল ইসলামের পদত্যাগ দাবি করেন। এ সময় মিজানুর রহমানও শিক্ষক সমিতির সঙ্গে এক হন। তিনি এসে প্রথমে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন। তাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করা হলে তিনি তার ব্যাখ্যা দেন। সে দিন রাতে কি ঘটেছিল, মিজানুর রহমানের কাছে তা জানতে চান শিক্ষার্থীরা। ওই ভিডিও ফুটেজে তার উপস্থিতির কারণও জানতে চান আন্দোলনকারীরা। মিজানুর রহমান বলেন, রবিবার রাত পৌনে তিনটার দিকে শেরে বাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ এবং সহকারী প্রাধ্যক্ষ তার বাসায় যান। তারা এসে দরজা ধাক্কা দেন। দরজা খোলার পর তিনি দেখেন, দুজন সিঁড়ির ওপর বসে আছে। ছাত্রকল্যাণ পরিচালক তাদের জিজ্ঞেস করেন, কি অবস্থা? উত্তরে সহকারী প্রাধ্যক্ষ জানালেন, তার হলে একটি মার্ডার (হত্যা) হয়েছে। মিজানুর রহমান বলেন, তখন তার পোশাক বাইরে বের হওয়ার উপযোগী না থাকায়, কাপড় বদলে আসার জন্য ভেতরে যান তিনি। এরপর প্রাধ্যক্ষ এবং সহকারী প্রাধ্যক্ষকে নিয়ে তিনি শেরে বাংলা হলে যান। ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যাদের ছবি তোমরা দেখাচ্ছ, তারা সবাই ওখানে ছিল। তাদের সঙ্গে আমিও ছিলাম। সাদা পাঞ্জাবি পরা লোকটি ডাক্তার। তোমরা যদি এই ছবির ব্যাখ্যা চাও, তাহলে বলছি। ডাক্তার আবরারের নাকে ও বুকে হাত দিয়ে বলেন, ছেলেটা অনেক আগে মারা গেছে। এ সময় যারা উপস্থিত ছিল, তারা ডাক্তারকে চাপ দেয়, লাশ যেন এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তার জানিয়ে দেন, তার একার পক্ষে এই ডেডবডি (লাশ) নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ সময় উপস্থিত ছাত্ররা চিৎকার করে জানতে চান, কারা ডাক্তারকে লাশ সরিয়ে নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল। মিজানুর রহমান বলেন, আমার কোন দুর্বলতা থাকলে তো আমি এখানে আসতাম না, আমি ব্যাখ্যা দিচ্ছি। ডাক্তার যখন বললেন আবরার মারা গেছে, তখন ছেলেরা আমাদের লাশ সরিয়ে নেয়ার প্রেসার দিচ্ছিল। আমি বললাম, এটা পুলিশ কেস, আমি লাশ সরাতে পারব না। এদের মধ্যে আমি শুধু রাসেলকে চিনি। ও চাপ দিচ্ছিল। বাকিরা কোন কথা বলছিল না। আমি ভিসিকে ফোন করি। অনেক রাত হলেও তিনি ফোন ধরেন। তাকে আমি বললাম, এই অবস্থা। উনি বললেন, পুলিশকে ফোন কর। পুলিশ যেভাবে বলবে, সেভাবে কাজ করতে হবে। ভিসির সঙ্গে কথা বলে মিজানুর রহমান উপস্থিত ছাত্রদের জানিয়ে দেন, এটা যেহেতু মার্ডার কেস, লাশ তিনি সরাতে পারবেন না। এরপর প্রধান সিকিউরিটি গার্ড আসেন। চকবাজার থানায় খবর দেয়া হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসেন। পুলিশের সঙ্গে একজন ডাক্তার ছিলেন। তারা লাশের সুরতহালের কাজ শুরু করেন। মিজানুর রহমান বলেন, আবরারের ট্রাউজারের একটা অংশ যখন ওঠানো হয়, তখনই বুঝতে পারি আবরারের গায়ে মারের দাগ আছে। সেই ছবি তোমরা দেখেছ। ছবিতে মারের দাগ স্পষ্ট ছিল। ডাক্তার তখন বলেন, শরীরের ওপরের অংশেও দাগ থাকতে পারে। কিন্তু ওই জায়গায় তা পরীক্ষা করা সম্ভব না। কাজেই লাশটা তখন হলের ক্যানটিনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরীক্ষা করে দেখা হয়। সুরতহাল যারা তৈরি করছিলেন, তারা তখন লাশের ছবি নেন। তিনি বলেন, সুরতহাল কমপ্লিট করার জন্য লাশের বিস্তারিত তথ্যের দরকার ছিল। বাবার নাম, বাড়ি কোথায় এসব লাগত। ওদের মধ্যেই কেউ একজন আবরারের ফোন এনে দেয়। আমি জানি না, ওরা কারা। সিকিউরিটি গার্ড আবরারের কল লিস্ট থেকে বাবা বা মার নাম দেখে ফোন করে। তখন তাদের নাম, বাড়ির ঠিকানা পাওয়া যায়। সুরতহাল তৈরি করার সময় হলের প্রাধ্যক্ষ, সহকারী প্রাধ্যক্ষ, ডাক্তারের সঙ্গে আমিও ছিলাম। আমাদের সামনে রেখে লাশের ছবি তোলা হয়। আমাদের সবার স্বাক্ষর নেয়া হয়। তখনও হয়ত পুলিশের কাজ শেষ হয়নি। কখন লাশ নিতে পারবে সে ব্যাপারে ওপর থেকে ইনস্ট্রাকশন (নির্দেশনা) চাচ্ছিল তারা। কিছুক্ষণ পর পুলিশের গাড়িতে আরেকজন সিনিয়র কর্মকর্তা আসেন। পুলিশের গাড়িতে লাশ তুলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। দ্রুতবিচার আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি ছাত্রলীগের ॥ আবরার ফাহাদ হত্যায় জড়িতদের দ্রুতবিচার আইনে বিচারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। আবরার হত্যাকা-ের প্রেক্ষিতে সংগঠনের নেয়া নানা পদক্ষেপের পাশাপাশি সংগঠনের দাবিও তুলে ধরেন সভাপতি জয়। বলেন, আমরা দাবি জানাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই হত্যাকা-ের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। আবরার হত্যা মামলাটি দ্রুতবিচার আইনের আওতায় এনে এবং হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয় সে উপযোগী করে পুরো মামলাটি পরিচালনা করা হয়। এদিকে ছাত্রলীগের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, আবরারকে নির্যাতনের সময় নেতাকর্মীরা ‘মদ্যপ’ ছিলেন। এ ঘটনায় ছাত্রলীগ ১১ জনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারও করেছে। ঘটনার পরপরই ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দ্রুততার সঙ্গে বিভিন্ন সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেয়া হয় জানিয়ে আল নাহিয়ান জয় বলেন, সব প্রকার পরিচয়ের উর্ধে উঠে হত্যাকা-ে জড়িতদের বিচারের দাবি জানিয়ে আনুষ্ঠানিক শোক প্রকাশ ও নিন্দা জানানো হয়েছে। দুই সদস্য বিশিষ্ট একটি সাংগঠনিক তদন্ত কমিটি গঠন এবং কমিটিকে ২৪ ঘণ্টার ভেতর রিপোর্ট জমাদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার পূর্বেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ১১ জনকে ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত কেউ যদি ব্যক্তি উদ্যোগে কোন অপরাধ কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তারাও বিচারের হাত থেকে রক্ষা পাবে না; অতীতেও পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে না। সভাপতি বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কখনই কোন প্রকার সন্ত্রাসী কর্মকা-কে প্রশ্রয় দেয় না, উৎসাহ প্রদান করে না। সংগঠনের পরিচয়-পদবি ব্যবহার করে কতিপয় ব্যক্তির অতি উৎসাহী হয়ে সংঘটিত কোন কর্মকা-কে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অতীতের ন্যায় বর্তমানে এবং ভবিষ্যতেও প্রশ্রয় দেবে না। সম্প্রতি সংঘটিত আবরার হত্যাকা-ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আবারও তা প্রমাণ করেছে। জয় আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই নৃশংস হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত এজাহারভুক্ত ১৯ জনের মধ্যে ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছে। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দাবি জানাই, পলাতক অপর অভিযুক্তদেরও যেন স্বল্প সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। একই সঙ্গে এজাহারভুক্ত ১৯ জনের বাইরে আরও যদি কেউ এই হত্যাকা-ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে তাদেরও যেন অনুসন্ধানের মাধ্যমে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হয়। এ বিষয়ে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ারও আশ্বাস দেন তিনি। বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে। এ বিষয়ে জয় বলেন, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, বিভিন্নভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা, দেশবিরোধী চুক্তির ধোঁয়া তুলে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি ও কটূক্তিমূলক বক্তব্য প্রদান প্রভৃতির মাধ্যমে কতিপয় নামসর্বস্ব, কর্মী ও কর্মসূচীবিহীন, ব্যানারনির্ভর ছাত্র সংগঠন ও সে সব সংগঠনের নেতারা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে।
×