ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

দলের রিপোর্ট, গোয়েন্দা রিপোর্ট- তবু দলে ‘দেহরক্ষী, খুনী, গুপ্তচর’!

প্রকাশিত: ০৯:১২, ১০ অক্টোবর ২০১৯

দলের রিপোর্ট, গোয়েন্দা রিপোর্ট- তবু দলে ‘দেহরক্ষী, খুনী, গুপ্তচর’!

আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের প্রার্থী, আওয়ামী লীগের সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই সম্পর্কে ব্যাপকভাবে প্রচার পেয়েছিল একটি তথ্যÑ আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে যেসব অঙ্গ সংগঠন এবং জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ার যোগ্য প্রার্থী বাছাই করে যাদের নাম পাঠানো হয়েছে, সেসব নাম বাছাই হয়েছে অনেক স্তরের গুরুত্বপূর্ণ মানুষের দ্বারা। এর মধ্যে প্রধান বাছাইকারী ছিল গোয়েন্দা বাহিনী, দ্বিতীয় দলের তৃণমূলের আন্তরিক নেতা-কর্মী। এই প্রার্থী বাছাইয়ের ফলে জাতি আশা করেছিল অন্তত ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগে গ্রহণযোগ্য, লেখাপড়ায় ভাল, মনোযোগী এবং সর্বোপরি দলের আদর্শ অনুসরণে আন্তরিক, সততায় বিশ্বাসী প্রার্থীকেই কমিটিগুলোর পদে নিয়োগ দেয়া হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, বাঙালীর ভাষা ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী এবং অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ছাত্র, যুবাদের পাওয়া একরকম কঠিন বলেই সবার ধারণা। তবে অন্তত নির্লোভ, সৎ, দুর্নীতি মুক্ত, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল যুবাদেরই গোয়েন্দাদের এবং তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বাছাই তালিকায় দেখা যাবে- এটাই ছিল জাতির আশা। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে উন্নয়নের অংশীদার হয়ে জাতি ছাত্রলীগ, যুবলীগের প্রধান পদগুলোতে দেখল, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ দূরে থাক, এরা দুর্নীতিগ্রস্ত। সহজ সরল গ্রাম থেকে আসা দরিদ্রের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যলয়ের গেস্ট হাউসে নির্যাতন করে এরা আনন্দ পায়! তুচ্ছ বিষয়ে মারামারিতে জড়ায়, ছাত্রীদের ওপর হামলা করে। এরপর তো জাতিকে হতভম্ব করে ছাত্রলীগের দুই উচ্চ পদাধিকারীর গাড়ি, ফ্ল্যাটের ভাড়া শুনে বোঝা গেল এরা কোন না কোন অছাত্রসুলভ অবৈধ আয়ের সঙ্গে জড়িত। এরা নাকি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কমিটির পদও মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করেছে! টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি শব্দটার সঙ্গে জাতি এতদিন ছাত্রদল, ছাত্রলীগের নাম যুক্ত হতে শুনেছে। কিন্তু পদ বিক্রি, জুয়ার মাধ্যমে অর্থ আয়Ñ এসবের কথা শোনেনি! বঙ্গবন্ধুর নিজ দলের ছাত্রলীগের একটি অংশ এতটা দুর্নীতিগ্রস্ত হবে এটা জাতি কখনও ভাবতে পারেনি। জাতিকে এত বড় আঘাত দেয়ার জন্য এসব কলঙ্কজনক কাজের কাজী, অপরাধীদের অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নতুবা তারা কমিটির পদ বিক্রি করার মতো দূরাচার পরবর্তী প্রজন্মকে পার্টির কমিটি গঠনে অনুসরণযোগ্য প্রক্রিয়া হিসেবে স্থায়ী করে দিয়ে যাবে। যা হোক, জাতিকে সবচাইতে বড় বিস্ময় হিসেবে আঘাত করেছে যে তথ্য দুটি তা হচ্ছেÑ বিসিবি পরিচালনা বোর্ডে খালেদা জিয়ার প্রাক্তন দেহরক্ষী এবং তারেক রহমানকে আওয়ামী লীগের সব গুপ্ত তথ্য পাচার করা গুপ্তচরের বুক ফুলিয়ে বছরের পর বছর বহাল তবিয়তে থাকতে পারা। হায় সেলুকাস, কি আশ্চর্য এই বাঙালী জাতি। ২০০৯ থেকে ক্ষমতায় থাকা বাঙালী কি নিজের শত্রুকে চিনতে পারল না? অথবা, চিনেও তার সঙ্গে এত মাখামাখি, ঘনিষ্ঠতা কি কারণে? এই প্রশ্ন ভোট প্রদানকারী বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী জনগণ করতেই পারে। এর উত্তর কি? তারেক যদি ঐ ব্যক্তির অধীনে পরিচালিত ক্যাসিনো থেকে মাসিক কোটি টাকা পেতে পারে, তাহলে তার অন্য কোন আয়ের উৎসের প্রয়োজন পড়ে না। এ কারণেই সে লন্ডনে তার আয়ের উৎস হিসেবে জুয়া বা ক্যাসিনো উল্লেখ করেছে! তার দামী গাড়ির দরকার ছিল বলে মনে হয় না। গাড়ি তো তার লন্ডনের বিএনপি দলীয় ধনী ব্যক্তিরা তাকে উপহার দিয়েছিল বলে শুনেছি। তবু, বারো কোটি টাকার গাড়িও এই পরিচালক তাকে উপহার দিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। আরও জানা যাচ্ছে, সম্প্রতি ক্যাসিনো কা-ে ধরা পড়া যুবলীগ নামে পরিচিত ব্যক্তিরা আসলে ছিল ছাত্রদলের সদস্য! এরাও সন্ত্রাসীদের, আবার বড় বড় সরকারী কর্মকর্তাদের ক্যাসিনো, জুয়া থেকে অর্জিত হাজার কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছে বলে জানাচ্ছে। এটাও ঠিক, ক্যাসিনো ব্যবসা থেকে অর্জিত হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে রাখা সম্ভব নয়। সেজন্য এরা ৮-১০টি বাড়ি, ফ্ল্যাট কিনেও কেজি কেজি সোনা কিনেছে। কিছুদিনের মধ্যে নিশ্চয়ই আরও কিছু নাম প্রকাশ পাবে, যারা ক্যাসিনো-জুয়ার অর্থ গ্রহণ করেছে! হতে পারে সে খবরে আমরা, জনগণ দুঃখে, লজ্জায় মাথা নত করতে বাধ্য হব। এখন প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে গোয়েন্দা তথ্য, তৃণমূল থেকে প্রাপ্ত তথ্য প্রার্থী বাছাইয়ে মোটেও সঠিক ছিল না। তাহলে যারা ঐসব প্রার্থী সম্পর্কে সুপারিশ করেছিল, তাদের উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগের বদনাম ছড়িয়ে দলটির প্রতি সমর্থন হ্রাস করা কি? একই কারণে, আমার মনে হয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যেসব ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী জয়লাভ করেছিল, তারাই প্রকৃত আওয়ামী লীগের নয় তো? এখন কোন উপজেলায় কারা সঠিক দেশপ্রেমভিত্তিক রাজনীতি করে এবং কোন রকম দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়নি, এমন সৎ, আদর্শবান রাজনীতিকদের খুঁজে বের করা আওয়ামী লীগের প্রথম কাজ হবে। জনগণ এতদিন কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপের অপেক্ষায় ছিল। এখন তারা সন্তুষ্ট। তবে অপেক্ষায় আছে কখন সেই বেসিক ব্যাংক ধ্বংসকারী বাচ্চু বা শেয়ারবাজার থেকে সাধারণের অর্থ লুট করা, বড় বড় দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী, আমলা, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবীসহ দুর্নীতিবাজ পেশাজীবীদের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ প্রদর্শন করে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যদের বিচারের আওতায় আনা হবে। দেশ বা রাষ্ট্রকে উন্নত অর্থনীতির দেশ করতে হলে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে শক্ত আইনী ভিত্তি দিতেই হবে। ক্যাসিনো বা জুয়ায় নানা কৌশল ব্যবহার করা হয়। নতুবা ক্যাসিনোতে মফস্বল থেকে আসা বেকার তরুণদের সহায়সম্বল বিক্রি করে খেলতে এসে তার টাকা ঐ পরিচালকদের হাতে চলে যায় কেন? তারা কেন সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়? যারা ক্যাসিনো চালায় তারা কেন কখনও সর্বস্বান্ত হয় না? বরং দেখা যায়, তাদের লাভের টাকা রাখার জায়গা নেই! এবার মূল খেলাÑ ক্যাসিনো বা তাসের খেলায় আসা যাক। আমরা মহাভারতে পাশা খেলার দানে হেরে একজন নারী, স্ত্রী দ্রৌপদীকে খেলার পণ হিসেবে ধরতে দেখি পা-বদের। এরপরও যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের কাছে পাশার দানে হেরে গেলে দুর্যোধন দ্রৌপদীর শাড়ি ধরে টানাটানি করে! অর্থাৎ, জুয়া বা পাশা খেলা অতীতকাল থেকে সব সমাজে প্রচলিত ছিল এবং আছে। আমাদের ছোটবেলায় যে কোন বার্ষিক প্রদর্শনীতে, যেখানে কৃষিজ, শিল্পজ, কুটির শিল্প, আবার পুতুল নাচ, মাকড়সা কন্যা দেখানো হতো, সেখানে পাশাপাশি জুয়া খেলা, তাসের খেলাও চল্ত। সার্কাস পার্টি এলে সেখানেও নানারকম খেলার পাশে জুয়া খেলাও চলত। তবে, সেসব খেলায় কেউ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে কেঁদে কেটে চলে গেছে এমন খবর কখনও শুনিনি। বরং যারাই খেলেছে, সবার কিছু না কিছু লাভ হয়েছেÑ এটা ছোটকালে দেখেছি। রাশিয়ান উপন্যাসে ‘রুলেত’ খেলার কথা বারংবার এসেছে। সব দেশেই ক্যাসিনো বা জুয়া খেলা নানারূপে বিদ্যমান। ‘স্লামডগ মিলিওনিয়ার’ নামের মুম্বাই ছবিতে কিংবা ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’র মতো প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে অর্থ আয়ের বিষয় আছে, যেখানে শেষ প্রশ্নটি অর্থাৎ পঞ্চাশ লাখের পরের প্রশ্নটি নিয়ে সবসময় একটি কৌশল অবলম্বন করা হয়, যাতে দেখা যায় দরিদ্র ছেলেটি শেষ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জয়ী হয় এবং সে কারণে ভয়ঙ্কর এক গুণ্ডা-সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে ঐ পরিচালক ওকে হত্যা করতে প্রয়াস চালায়। এই উদাহরণটি দিচ্ছি এ কারণে যে, ক্যাসিনোতে প্রত্যেক দানে কে জিতবে, সম্ভবত এটা আগেই কৌশলে ঠিক করে রাখা থাকে। নতুবা, ক্যাসিনো পরিচালকরাই সব দান জিতে অসীম অর্থের মালিক হচ্ছেন কিভাবে? আমার মনে হয় না, নানা প্রকৃতির জুয়া খেলা, ক্যাসিনো হোক, রুলেত হোক বা ভিন্ন নামে, বিশ্বের সব দেশে প্রচলিত থাকায় এটি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব। বরং, কোন খেলাধুলার ক্লাবে জুয়া একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত এবং খেলোয়াড়দের দক্ষতা মান বিনষ্টকারী একটি অপকর্ম হিসেবে গণ্য করতে হবে। খেলাধুলার ক্লাবগুলো পরিচালনার জন্য বাজেট থাকবে, নিয়মিত অডিট হবে, খেলোয়াড় বা কোচেরা ঠিকমতো পারিশ্রমিক পাবে- এর স্বচ্ছ ব্যবস্থা থাকতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। খেলাধুলাপ্রেমিক প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই বড় ব্যবায়ীদের এসব ক্লাবের স্পন্সর হতে বলতে পারেন। প্রয়োজনে সরকারও ক্লাবগুলোকে অনুদান দিতে পারে। মোট কথা, কোন ক্যাসিনো, জুয়া খেলাধুলার ক্লাবে থাকতে পারবে না। এটি পৃথিবীর অন্য কোন দেশেও নেই। বিনোদন ক্লাবগুলোতে তরুণ-তরুণীদের জন্য সঙ্গীতের, ব্যান্ডের গানের আয়োজন হয়। এখানেও ক্যাসিনো থাকে না। ক্যাসিনোর জন্য বিখ্যাত লাস ভেগাসে বড় বড় ক্যাসিনো প্যালেস আছে, যেখানে বয়স্ক, খুব ধনী ব্যক্তি-নারী পুরুষের সমাগম হয়। ওখানে অপ্রাপ্ত বয়স্ক, তরুণ-তরুণীরা যায় না। তবে, ঐ প্যালেসগুলোর বাইরের চারদিকে থাকে কাঁচা ফুল-পাতা দিয়ে তৈরি অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য এবং তার পাশে জলনৃত্য, যা খুবই উপভোগ্য। ভেতরে যেখানে রুলেত খেলা হয় সেখানে সদস্যরাই শুধু প্রবেশ করতে পারে। ওখানে কোন অপকৌশল অবলম্বন করা হয় বলে মনে হয় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলছি, জনগণ প্রশ্ন তুলেছে যুবলীগের বহুল পরিচিত নেতাকে গ্রেফতার করতে কি কারণে দুই সপ্তাহ সময় লেগে গেল? দ্বিতীয়ত, সেই দুই খল নেতাকে রিমান্ডে না দিয়ে সরাসরি কারাগারে ও পরে হাসপাতালে পাঠানো হলো কেন? এরকম নয়তো, রিমান্ডে প্রশ্নোত্তরে তারা ক্যাসিনোর সুবিধাভোগী হিসেবে বড় বড় কর্মকর্তা, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, নেতাদের নাম ঠিকানা বলে দিতে পারে! জাতি এরকম সন্দেহ করছে। প্রধানমন্ত্রীকে বলব, সবরকম অন্যায়ের উর্ধে উঠে নিরপেক্ষতাকে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সব অপরাধীর প্রতি সমান তদন্ত, বিচার ও শাস্তির নিশ্চয়তা গ্রহণ করতে হবে। নতুবা ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নামের অতি গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপটি অনেক সাহসের সঙ্গে গ্রহণ করার পরও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। তা যেন না হয়- জাতি এটি আকাক্সক্ষা করে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×