ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফুটবলার তৈরির পাইপলাইন

প্রকাশিত: ১২:৫৭, ৯ অক্টোবর ২০১৯

ফুটবলার তৈরির পাইপলাইন

২০১৪ : মোহামেডান ২-০ ব্রাদার্স। ২০১৮ : আবাহনী ১-০ ফরাশগঞ্জ। ২০১৯ : নোফেল ১-০ সাইফ। ওপরে দেয়া সাল, দল এবং স্কোরলাইন দেখে নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন এগুলো ফুটবল খেলা সংক্রান্ত কিছু। তবে এগুলো কোন আসরের খেলার ফল, তা নিশ্চয়ই অনুমান করাটা কিঞ্চিত কষ্টকরই। উত্তরটা বলে দিই ... এগুলো বাফুফে আয়োজিত অনূর্ধ-১৮ ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনালের ফল। একটু খতিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন এই তিনটি আসরে ভিন্ন ভিন্ন দল ফাইনাল খেলেছে। সর্বশেষ ফাইনালে খেলে শিরোপা জিতেছে এমন একটি দল, যারা বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল থেকে অবনমিত হওয়া দুটি দলের একটি! এ থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়Ñ যুব বা বয়সভিত্তিক ফুটবলে সঠিক প্রশিক্ষণ পেলে যেকোন দলই চ্যাম্পিয়ন হতে পারে। এখানে বড় ক্লাব বা ছোট ক্লাব কোন বিষয় নয়। আরেকটি ব্যাপারÑ এই ঘরোয়া যুব ফুটবল থেকে যেসব খেলোয়াড় নজর কেড়েছে, তাদের যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়, তাহলে আগামীতে বা অদূর ভবিষ্যতে তাদের অনেকেই যে জাতীয় দলে ঠাঁই করে নিতে পারে, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কাজেই ভবিষ্যতের জাতীয় দলের ফুটবলার তৈরি করতে হলে এরকম টুর্নামেন্ট আয়োজনের কোন বিকল্প নেই, এ কথা বলাই যেতে পারে। বাংলাদেশের পুরুষ ফুটবল একটা সময় তলানিতে চলে গিয়েছিল। তৃণমূল পর্যায়ে ফুটবল চর্চা বন্ধ থাকায় পাইপলাইনে পর্যাপ্ত ফুটবলার তৈরি হচ্ছিল না। এর কুপ্রভাব পড়ে জাতীয় দলের পারফরম্যান্সের ওপর। সেদিক দিয়ে অনেকটাই এগিয়ে গেছে মহিলা ফুটবল। তবে অনেক দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) বোধদয় হয়েছে। তারা গত কয়েক বছর ধরে তৃণমূল এবং বিভিন্ন বয়সভিত্তিক ফুটবলের ওপর জোর দিয়েছে। তারই সর্বশেষ উদাহরণ ওয়ালটন অ-১৮ ফুটবল টুর্নামেন্ট। যাতে প্রিমিয়ার লিগে অংশ নেয়া ১২ ক্লাবের যুব দল অংশ নেয়। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হন বসুন্ধরা কিংসের রাশেদুল ইসলাম, ফাইনাল সেরা নোফেলের মো. রাকিব। এছাড়া ছয়জন (সাইফের ইমন মোল্লা, নোফেলের আরমান হোসেন আবির, ঢাকা আবাহনীর মোহাম্মদ ইকবাল, চট্টগ্রাম আবাহনীর মোহাম্মদ রাসেল, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের রাহুল তালুকদার এবং বসুন্ধরা কিংসের রায়হান বেপারী) সর্বাধিক গোলদাতার পুরস্কার জেতেন। ফেয়ার প্লে ট্রফি পায় সাইফ। চ্যাম্পিয়ন নোফেল পায় গোল্ডেন ট্রফি, মেডেল ও তিন লাখ টাকা। রানার্সআপ সাইফ পায় সিলভার ট্রফি, মেডেল ও ২ লাখ টাকা। মজার ব্যাপার হচ্ছে এবারের আসরের চ্যাম্পিয়ন নোফেলের কোচ আকবর হোসেন রিদন হচ্ছেন রানার্সআপ সাইফের কোচ কামাল বাবুর শিষ্য! ফাইনালের আগের দিনই রিদন বলেছিলেন, গুরুকে ফাইনালে হারাতে চান। তবে ফাইনালের দিন গুরুর দলকে হারাতে পারেননি। তবে নিজেও হারেননি। কেননা বিরূপ আবহাওয়ার কারণে খেলাই যে অনুষ্ঠিত হয়নি ১ অক্টোবর। সেই খেলা গড়ায় তার পরেরদিন ২ অক্টোবর। এবং তাতেই বাজিমাত করেন। শিষ্যের কাছে গুরুর হার। আকবর হোসেন রিদনের কাছে কামাল বাবুর পরাজয়! কমলাপুর স্টেডিয়ামে ওয়ালটন অ-১৮ ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনালে নোফেল স্পোর্টিং ক্লাব ১-০ গোলে সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। মজার ব্যাপারÑ এই আসরের গ্রুপ পর্বেও এই দুই দল পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল। সেই ম্যাচটি ড্র হয়েছিল ১-১ গোলে। নোফেলের কোচ রিদন ফাইনাল শেষে বলেন, ‘আন্ডারডগ হিসেবেই আমরা এই আসরে খেলা শুরু করেছিলাম। আর এখন আমরা চ্যাম্পিয়ন। ভীষণ ভাল লাগছে। আমার যে কোচিং দর্শন এবং লক্ষ্য ছিল, সেটা পূরণ করতে পেরেছি। কেউ বিশ্বাসই করতে পারেনি আমার দল শিরোপা জিতবে।’ রিদন সফল হয়েছেন বিপক্ষ দলের খেলা বিশ্লেষণ করে। তার দল ফাইনালে খেলেছে মূলত ডিফেন্ডিং করে এবং কাউন্টার এ্যাটাক স্টাইলে। এভাবেই তারা প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। রিদন বলেন, ‘এভাবেই ভাগ্যক্রমে গোলটি পেয়ে যাই। মাত্র একজন খেলোয়াড়কে সামনে রেখে বাকিরা ডিফেন্ড করে খেলে। অনেকেই বলতে পারেন এভাবে খেলে কি গোল করা সম্ভব কি না, আমি বলবো অবশ্যই সম্ভব। আমার ছেলেরা সেটা করে দেখিয়েছে।’ নোফেলের সিনিয়র দল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ থেকে অবনমিত হয়ে গেলেও অ-১৮ ফুটবলে তাদের যুব দল ঠিকই শিরোপা জিতেছে। তারা যে জিততে পারে, এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন রিদন এবং খেলোয়াড়দেরকেও বিশ্বাস করিয়েছেন। তার ফল তো দেখাই যাচ্ছে। রিদনের দলের ৯ খেলোয়াড় তার নিজের স্টার ফুটবল একাডেমির। বাকিরা বিভিন্ন জেলার এবং বিভিন্ন একাডেমির। তিনি শুধু ট্যাকটিক্স নিয়ে কাজ করেছেন। এই আসরের আগে তার দল ৩টি প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলে। এটাই ছিল তাদের প্রস্তুতি। রিদন বলেন, ‘ওই প্রস্তুতি ম্যাচগুলো খেলার পরেই আমি বুঝতে পারি আমার দলের কোথায় শক্তিমত্তা, কোথায় দুর্বলতা। সেই অনুযায়ীই আমি দলের খেলার স্টাইল, ফর্মেশন ... এগুলো ঠিক করে ফেলি। আমার দলের ফর্মেশন ছিল মূলত ৫-৪-১। তবে এ্যাটাকে গেলে সেটা হয়ে যায় ৩-৪-৩।’ কামাল বাবু রিদনের গুরু। প্রায় ২০ বছর তার কোচিংয়ে তিনি বিভিন্ন ক্লাবে খেলেছি। তিনি কামাল বাবুর কোচিংয়ের সব কলাকৌশলই জানেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তার দলকে হারানোটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো। এটা আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি, অনেক স্মরণীয় ব্যাপার। আমি মাত্রই ‘বি লাইসেন্স’ করেছি। এর আগে নোফেল সিনিয়র দলের সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করেছি। হেড কোচ হিসেবে এই প্রথম কাজ করছি। কোচ হিসেবে প্রথম এ্যাসাইনমেন্টেই সাফল্য পেয়ে ভীষণ রোমাঞ্চিত। কোচ হিসেবে মানুষ আমাকে মনে রাখুক, এটাই আমার চাওয়া।’ সাইফের যুব দলটা গত ২-৩ বছর ধরে কমলাপুর স্টেডিয়ামেই অনুশীলন করে আসছে। নোফেলের যুব দলটাও তাই। রিদন তখন দেখেছেন সাইফের খেলোয়াড়দের খেলার ধরন, কৌশলগুলো। এগুলো জানা থাকায় এই দলের বিরুদ্ধে ফাইনালে খেলতে তার সুবিধাই হয়েছে বলে জানান। রিদন মনে করেন প্রিমিয়ার লিগে আবারও ফিরে আসতে নোফেলের যুব দলের এই শিরোপাজয় অনেক অনুপ্রেরণা জোগাবে সিনিয়র দলকে। আরও জানান, যুব দলের কিছু খেলোয়াড়কে সিনিয়র দলেও নেয়া হবে। ম্যাচ শেষে অনেক আপসেট দেখা গেছে সাইফের কোচ কামাল বাবুকে। ডাগ আউটের বেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। প্রথমে তো কথাই বলতে চাননি! একটু জোরাজুরি করলে শুধু সংক্ষেপে বলেন, ‘খারাপ খেলেছি, তাই হেরে গেছি। ওরা ভাল খেলেছে তাই জিতেছে।’ পরে অবশ্য অনেক কথাই বলেন। সারাক্ষণ তো ম্যাচে সাইফই বল ধরে রাখল, আক্রমণ করল। তাহলে নোফেল ভাল খেলে কিভাবে? কামাল এর ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ‘আমরা সারাক্ষণই এ্যাটাক করলাম। অথচ গোল পেলাম না। ওরা ভাল খেলেছে বলেই তো গোল খায়নি। উল্টো তো ওরাই গোল পেয়ে গেল আমাদের লেফট ব্যাকের ভুলে। তাহলে ওরাই তো ভাল খেলেছে নাকি?’ আমার ছেলেরা নার্ভাস ছিল না। চাপেও ছিল না। আমরা নোফেলকে আন্ডার এস্টিমেটও করিনি। আসলে ওদের দুভার্গ্য যে গোল করতে পারেনি। গোল মিস করলে প্রতিপক্ষ এর ফায়দা নিয়ে গোল করবে, এটাই স্বাভাবিক। আর এটাই হয়েছে। আমরা অতিরিক্ত মিস করেছি, এর মাসুলও দিয়েছি।’ কামাল আরও বলেন, ‘এটা দুনিয়ার সবাই জানে যে, যেকোন আন্ডারডগ দলই বড় দলের বিরুদ্ধে জিতে যেতে পারে। আজও তাই হয়েছে। নোফেল আরামবাগ ও শেখ রাসেলের মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়েছে। কাজেই তাদের পুরোপুরি আন্ডারডগও বলা ঠিক নয়।’ জাতীয় দল যেমন গোল করতে পারে না, তেমনি সাইফও এই ম্যাচে গোল করতে পারেনি ... এটা কামালকে মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘এটা তো আমাদের জাতিগত সমস্যা! অথচ বছরের অধিকাংশ সময়ই স্ট্রাইকাররা গোল করার অনুশীলন করলেও ম্যাচে গিয়ে আসল কাজটা করতে পারে না। এটাই জাতিগত সমস্যা।’ এই আসর থেকে কামালের এটাই প্রাপ্তিÑ নয় জন দক্ষ ও সম্ভাবনাময় ফুটবলার পেয়েছেন, যারা আগামী বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে খেলবে।
×