ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে

প্রকাশিত: ০৮:৫০, ৯ অক্টোবর ২০১৯

 আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে

‘যায় যাবে প্রাণ তাহে, প্রাণের চেয়েও মান বড় আমি বোঝাব শাহেনশাহে’-কবির এই পঙ্ক্তিমালার বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া আজ কঠিন। এখানে প্রাণের চেয়েও ‘মান’ বড় করে দেখার মানুষ হাতেগোনা। সামাজিক অবক্ষয়, ঘুষ, দুর্নীতির সঙ্গে সঙ্গে ‘মুই কি হনুরে’-এই ভাব-প্রভাব সমাজ-রাষ্ট্রের চারপাশে। আবার এই ভাব-প্রভাব ব্যক্তি ও মহলের বিরুদ্ধে আমরাও কেমন জানি নীরবতা পালন করি, নীরব আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকি। দেখেও না দেখার ভান করি। নিজেকে বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করি। এটি আমার জন্য নয়, এই কাজ আমার নয়-বলে এড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণ করি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পূর্ব পুরুষ-নারী মুক্তিযোদ্ধারা একবারের জন্যও ভাবেননি, এই মুক্তিযুদ্ধ তাঁদের নয়, একটিবারের জন্যও চিন্তা করেননি- এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে গিয়ে আবার নিজ পরিবার-পরিজনদের মাঝে ফিরে আসতে পারবে কিনা। বরং নেতার নেতৃত্বে উদ্বেলিত হয়ে, সাহস-বিশ্বাস সঞ্চয় করে নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিয়ে জীবন বিলিয়ে দিয়ে হলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার সূর্য উদিত করার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ আর দুই লাখেরও বেশি নারীর সম্ভ্রব বিনাশ হয়েছে। এই স্বাধীনতা, এই দেশ, এই স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব কারও দয়ায় বা উপহার হিসেবে আমরা গ্রহণ করিনি। বরং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অর্জিত এই বাংলাদেশ, এই স্বাধীনতা। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার সাধ গ্রহণ করতে না করতে এই দেশেরই কিছু বিশ্বাসঘাতক নরপশু জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। নেতার নেতৃত্বশূন্যে পাকিস্তানী ভাবধারায় রাষ্ট্রপরিচালনা করার মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার যে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল, তা আজও বন্ধ হয়নি। বরং আধুনিক সময়ে ষড়যন্ত্রের কৌশল পরিবর্তন হয়েছে। রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অনুপ্রবেশ ঘটেছে, ঘটিয়েছে। অর্থবিত্ত দিয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার কৌশল নির্ধারণ করেছে। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অর্থবিত্ত আর প্রতিপ্রত্তিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও মহলকে। ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ বলে মেজর জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে টাকার ক্ষমতা বুঝিয়ে রাজনীতিকে এক প্রকার বিক্রি করে দিয়েছে। আবার রাজনৈতিক দল-সংগঠনগুলোকে ব্যবসায়িক দোকানঘর বানানোর ষড়যন্ত্রটি পরবর্তী রাজনীতিবিদরাও আর সেটি বন্ধ করতে পারেনি বরং এই ধারাকেই অব্যাহত রেখেছে। তাই নমিনেশন বাণিজ্য এখন মোটামুটি ওপেন-সিক্রেট বলেই সবাই জানে। এমনকি, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও লন্ডনে বসে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা বিএনপির অনেক নেতাই প্রকাশ্যে তুলেছেন। তারেক জিয়ার বিচারের দাবিও তুলেছে। অন্যদিকে এরশাদের জাতীয় পার্টিও এই মনোনয়ন বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ থেকে নিজেদের আড়াল করতে পারেনি। অন্যান্য দল অনেকটা পর্দার আড়ালেই এই মনোনয়ন বাণিজ্য করেছে বলে প্রতীয়মান। রাজনীতিতে টাকার বিনিময়ে সংগঠনের পদ-পদবী দেয়া, ইউনিয়ন নির্বাচন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন বাণিজ্যকরণই শুধু নয়, সরকারী বা বেসরকারী অফিস বা বাড়ির দারোয়ান নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনেকে এই বাণিজ্যিক হিসাব-নিকাশ করতে ভুল করে না। শত যোগ্যতা থাকার পরেও, সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও চাকরি পেয়ে থাকে বাণিজ্যিক হিসাব-নিকাশ করা ব্যক্তি ও মহল। তাহলে, এই বাণিজ্যিক হিসাব-নিকাশের ফল যোগ্যতার আসনে অযোগ্যদের কাছ থেকে ভাল কিছু আশা করি কিভাবে? এই ধরুন, ফ্রিডম পার্টির নেতা খালেদ যখন টাকার বিনিময় ঢাকা মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়ে যায়, কোন অফিসের পিয়ন যদি টাকার বিনিময় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়, তাহলে পিয়ন যেমন প্রতিনিয়ত টাকার কথা চিন্তা করবে তেমনিভাবে রাজনীতিতে নিজের নাম লেখানো খালেদ বা আরও অন্য কেউ; সেও টাকার বিনিময় রাজনীতি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইবে-এটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। খালেদ, জিকে শামীম ও অনলাইন ক্যাসিনোর সেলিম প্রধান ব্যক্তি ও মহল প্রতিনিয়ত তারেক জিয়াকে টাকা দিয়ে থাকতো। আবার মোহামেডান ক্লাবের পরিচালক লোকমান তারেক জিয়ার বাসায় গিয়ে শুধু ক্রিকেট খেলার টিকেট নয়, মাসোহারা দিয়ে আসতো। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য সদ্য ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে আসা এক ছাত্রনেতাও তার প্রভুকে নিয়ে লন্ডনে তারেক জিয়ার সঙ্গে মিটিং করেছে। মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেছে। কে কয়টা আসন নেবে, কে মন্ত্রী হবে, কে প্রধানমন্ত্রী হবে আবার কাকে রাষ্ট্রপতি বানানো হবে- তাও নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করেছে। তার কারণ একটাই, অবৈধভাবে এবং টাকার বিনিময়ে রাজনীতিতে এসে রাজনীতির পদ-পদবী ব্যবহার করে অবৈধভাবে অর্থবিত্তের মালিক হয়ে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার ষড়যন্ত্রে মত্ত। তারা জানে, বাংলাদেশে একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ আছে যারা আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করে না, ক্ষমতা ও অর্থবিত্তবান হওয়ার জন্য রাজনীতি করে। আর এটা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও স্পষ্ট হয়েছে। যেমন- ঐক্যফ্রন্টের নামে ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতিবিদদের কলাকৌশল এবং তাদের মূলধারার রাজনীতি; এ প্রজন্ম ভাল করেই অবলোকন করেছে। অর্থাৎ, ঘুণে খাওয়া রাজনীতিতে টাকার বিনিময় দল-সংগঠনের পদ-পদবী পাওয়া ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে, সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে মাদক ও জুয়ার অভয়ারণ্য গড়ে তুলবে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে ভ্রান্তপথে পরিচালিত করবে, ভিতর থেকে ঘুণে খাওয়া জাতিতে রূপান্তর করবে- এটাই স্বাভাবিক। আমাদের মনে রাখতে হবে, অশিক্ষিত লোক আর যাই হোক কোন স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যেমন যোগ্য নয়, যোগ্যতা বহন করে না; তেমনি আদর্শহীন বা দেশপ্রেমিক নয় এমন ব্যক্তিও আর যাই হোক, রাজনীতিতে তাদের পদ-পদায়ন হলে রাজনীতি কলুষিত হবে, সমাজ-রাষ্ট্র এবং জাতির ভবিষ্যত হবে অন্ধকার। শুধু আমরা নয়, এ পৃথিবী পেয়েছিল এক মহামানব ও দেশপ্রেমিক নেতা। যিনি নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের জন্য, মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে আন্দোলন-সংগ্রামে দীর্ঘ ২৩ বছর কারাভোগ করেছিলেন। কিন্তু তার ‘মান’ ‘সম্মান’ আর ‘আদর্শ’ বিক্রি করেননি। শত-সহস্র বাধা বিপত্তি আর লোভ-লালসাকে পাশ কাটিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। শোষণ আর বৈষম্যের শৃঙ্খল থেকে বাঙালী জাতির স্বাধীনতা আনার জন্য যার নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি বিশ্ব মানচিত্রে নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছে; সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। শত্রুর বুলেটের নির্মম যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর কঠিন সময়েও আমরা ভয়ে, আতঙ্কে কিংবা কাপুরুষের মতো নীরবতা পালন করেছি। দেশপ্রেম আর সাহস নিয়ে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারিনি। বরং স্বাধীনতাবিরোধী মহল যখন বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দিনের পর দিন পুরস্কৃত করেছে, তখনও আমরা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি। আমাদের ব্যর্থতায় শত্রুপক্ষ সাহসী হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র গঠনে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। আধুনিক বাংলাদেশে কতিপয় মানুষের শোষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কে দলীয় আর কে আত্মীয়- এটাকে তিনি ভুলে গিয়ে বরং সময়ের সবচেয়ে সাহসী এবং উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। মাদক, জুয়া আর সমাজ-রাষ্ট্রে বৈষম্য সৃষ্টিকারী ব্যক্তি ও মহলের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা একাই যেন লড়ে যাচ্ছেন। আর আমরা...? ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া লোকজনের কারণে সামাজিক বৈষম্য বাড়ে এবং সৎভাবে যারা আয়-উপার্জন করেন তাদের সন্তানরা হতাশায় ভোগেন। শিশুরা তো বুঝতে পারে না, তাই তার মা-বাবার কাছে জানতে চায়-‘ওরা যদি দামী গাড়িতে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে পারে, দামী পোশাক পরতে পারে, আমরা কেন পারি না?’ এমন পরিস্থিতিতে একটি সমাজ এগোতে পারে না। এমন পরিস্থিতির অবসানের জন্যই একটি আঘাত দেয়ার প্রয়োজন ছিল। সেটি করা হচ্ছে সামগ্রিক স্বার্থে।’-বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কথাগুলো আমার কথা, আপনার উপলব্ধি, আমাদের কম-বেশি তিক্ত অভিজ্ঞতার বহির্প্রকাশ। তাহলে এখানেও আমাদের নীরবতা কেন? আমি মনে করি, দলমত নির্বিশেষে আমাদের সবাইকে সরকার প্রধান শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়াতে হবে। আঙুল ফুলে বটগাছ ওয়ালা ব্যক্তি ও মহলের বিরুদ্ধে সবার আগে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। এদের ফুটানি শুধু মস্জিদ, মন্দির কিংবা গির্জায় নয়, সমাজ-রাষ্ট্রের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। তাই বৈষম্য দূর করতে, মানবিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে এবং সমাজ-রাষ্ট্রকে দূষণমুক্ত করতে হলে শেখ হাসিনার পাশে থেকে আমাদেরও ঘুরে দাঁড়াতে হবে, কাজ করতে হবে। আগামী প্রজন্মের জন্য, আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে ঘুরে দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)
×