ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গোথেনবার্গ বুক ফেয়ার ॥ অতসীর মেলা ভ্রমণ

প্রকাশিত: ০৭:৩৮, ৯ অক্টোবর ২০১৯

 গোথেনবার্গ বুক ফেয়ার ॥ অতসীর মেলা ভ্রমণ

বহু বছর আগে বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রতিদিন বুলেটিন বের করত অতসী তখন যে পত্রিকায় কাজ করত সে পত্রিকা। ওর কাজ ছিল প্রতিদিন মেলা ঘুরে একটি করে লেখা তৈরি করা। প্রথাগত প্রতিবেদন নয়, অতসী লিখত নিজের মতো করে। দারুণ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল লেখাগুলো। এত বছর পর সুদূর সুইডেনের গোথেনবার্গ বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে সে সব কথা মনে পড়ে ওর। চেহারা-চরিত্রপ্রবণতা সব দিক থেকে বাংলা একাডেমি আয়োজিত মেলা থেকে এ মেলা একেবারেই আলাদা। প্রথম দিন রীতিমতো হোঁচট খেয়েছে অতসী। মেলা বলতে আজন্ম পরিচিত স্টল, প্যাভিলিয়নে ভিড়ে ঠাসা উন্মুক্ত চত্বরের ধারণাই গাঁথা ছিল মনে। এখানে এসে অবাক। এগারো হাজার দু’শ’ একানব্বই স্কয়ার মিটার আয়তনের মেলা পুরোটাই ইনডোর। সম্ভবত এদেশের আবহাওয়ার জন্য এমন আয়োজন। কনকনে শীত। দিনে কয়েকবার বৃষ্টি। বৃষ্টি হলে শীতের প্রকোপ আরও বাড়ে। বেশিরভাগ সময়ই মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া। এতসব সামলে খোলা মাঠে মেলা করা বেশ কঠিনই। বিশ্বের বৃহত্তম এবং প্রাচীনতম ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার আয়োজনও এমন। ছিমছাম সাজানো স্টল। দৈর্ঘ্যন্ডেপ্রস্থে কোনটাই খুব বেশি বড় বা ছোট নয়। একটার সঙ্গে অন্যটার সঙ্গতি রেখে সাজানো। স্টল বা প্যাভিলিয়ন প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা নেই। সেরা প্যাভিলিয়নের জন্য পুরস্কার নেই। কোনটা প্রাসাদোপম, কোনটা দীনহীন চেহারা নিয়ে করুণা প্রার্থীর মতো দাঁড়িয়ে নেই। পুরো মেলা একটি ছন্দোবদ্ধ ঐক্যে সাজানো। ক্রেতা-দর্শক আছে প্রচুর, তবে ঠেলাঠেলি বা উপচেপড়া ভিড় নেই। মেলা আয়োজকদের পরিসংখ্যান মতে এবার ভিজিটর এসেছেন ছিয়াশি হাজার এক শ’ বত্রিশজন। চমৎকার অনুভূতি নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে অতসী খেয়াল করে অমর একুশে গ্রন্থমেলার মতো এখানেও ক্রেতার চেয়ে দর্শক বেশি। তবে আমজনতার হৈচৈ নেই। এর কারণ বুঝতে দেরি হয় না। এ মেলায় ইচ্ছে হলেই কেউ ঢুকতে পারে না। আগে থেকে রেজিস্ট্রেশন করা থাকলে তবেই তার জন্য দ্বার উন্মোচিত, নইলে নয়। অতসীর মনে হয় একুশের বইমেলায়ও এমন ব্যবস্থা করলে মেলায় আগতদের ঘোরাঘুরি, বই কেনা ইত্যাদি স্বস্তিদায়ক হতো। সত্যি বলতে এই ভিড়ের ভয়ে গত ক’বছর ধরে অতসী বইমেলায় যাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। ‘প্রাণের মেলা বইমেলা’ বলে আবেগের স্রোতে ভাসতে ভাসতে বইমেলা যে ডুবছে আগাছার স্তূপে মেলায় গেলে তা ভীষণভাবে টের পাওয়া যায়। বাঙালীর সবকিছুতেই আবেগের ঘটা একটু বেশি। হ্যাঁ, বড় কিছু অর্জনের জন্য আবেগ থাকা দরকার। তবে একই সঙ্গে যৌক্তিক এবং বাস্তবানুগ থাকাও জরুরী। ভাষা আন্দোলনের পর সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের এবং বাংলাকে বিকশিত করার কথা ছিল। কথা ছিল বাংলা হবে আন্তর্জাতিক মানের যে কোন ভাষার সমতুল্য। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের এত বছর পর বাংলার ভবিষ্যত ভাবলে অতসী সত্যিই শিউরে ওঠে। এত সমৃদ্ধ একটি ভাষা উত্তর উপনিবেশীয় রাজনীতি ও অর্থনীতির খপ্পরে পড়ে দিন দিন বদ্ধ ডোবায় পরিণত হচ্ছে। শিল্পোন্নত দেশগুলো পুঁজির জোরে ভাষার ওপরও আধিপত্য করে যাচ্ছে। মনটা ভার হয়ে ওঠে অতসীর। গোথেনবার্গ বইমেলার যে বৈশিষ্ট্যটি অতসীর সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি কাড়ে তা হলো সেমিনার। মেলার মধ্যেই জায়গায় জায়গায় ছোট ও বড় পরিসরে সেমিনার চলছে। কোথাও বড় স্টেজের ওপর চার-পাঁচজন আলোচক গোল হয়ে বসে আছেন, উপস্থাপক একজন একজন করে প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলছেন। দর্শক সারিতে মনোযোগী দর্শকশ্রোতা তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আলোচনা শুনছেন। আবার দু’জন বসতে পারে এরকম ছোট স্টেজে একজন আলোচক ও উপস্থাপক কথা বলছেন, দর্শকরা দাঁড়িয়ে শুনছেন। কোথাও স্টেজ ছাড়াই মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে আলোচকের সঙ্গে কথা বলছেন উপস্থাপক, দর্শকরা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা শুনছেন। অতসীর আশ্চর্য লাগে পায়ে পায়ে এরকম আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে অথচ কোথাও কোন শব্দ দূষণ নেই। ওর মনে হয় কতটুকু শব্দ হলে পাশের আলোচক কিংবা ক্রেতা দর্শকের শ্রুতি উৎকট শব্দে আক্রান্ত হবে না তার যথাযথ পরিমাপ ওরা করে নিয়েছে। মাইক্রোফোন যে চলছে তা ওই নির্দিষ্ট জায়গায় না গেলে বোঝা যায় না। এ বছর মেলায় সেমিনার হয়েছে তিন শ’ চব্বিশটি। আট শ’ ত্রিশটি দেশের অংশগ্রহণে মোট প্রোগ্রাম হয়েছে চার হাজার এক শ’ পঁচাশিটি। তাক লাগে অতসীর। ভাবা যায়, ছাব্বিশ সেপ্টেম্বর থেকে ঊনত্রিশ সেপ্টেম্বর, চার দিনের বইমেলায় এত প্রোগ্রাম! আসলে এগুলোই এ মেলার প্রাণ। বইমেলাকে কেন্দ্র করে স্ক্যান্ডিনোভিয়ান দেশগুলোর জমজমাট সাহিত্য উৎসব হয় এখানে। উত্তর ইউরোপের সবচেয়ে বড় সাহিত্য উৎসব এটি। আর ফ্রাঙ্কফুর্টের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা। গথিয়া টাওয়ারের নিচে অনুষ্ঠিত উৎসবের বিশাল দক্ষযজ্ঞ দেখে মেলা কর্তৃপক্ষের এ পরিসংখ্যান নিয়ে অতসীর মনে কোন সন্দেহ জাগে না। আয়োজকদের একজনের সঙ্গে কথা হয়েছিল ওর। বেশ উজ্জ্বল মুখে বলছিলেন তিনিÑ ‘সেমিনার প্রোগ্রাম ইজ দ্য হার্ট অব দ্য ফেয়ার’। নিশ্চয়ই। অতসী একমত না হয়ে পারেনি। বিশাল সমুদ্রে স্রোতের মতো লোকজনের আসা-যাওয়া। নিচের দুই ফ্লোরজুড়ে বইমেলা। সম্ভবত আন্ডারগ্রাউন্ড। তার ওপরের তলায় বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের নিয়ে পূর্ব নির্ধারিত অনুষ্ঠানমালা। প্রকাশক এবং প্রকাশনা সংশ্লিষ্টদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। সেখানে লেখক-দর্শক কারও প্রবেশাধিকার নেই। গোথেনবার্গ বইমেলা দু’হাজার উনিশের থিম কান্ট্রি দক্ষিণ কোরিয়া। ‘থিম কান্ট্রি’ কনসেপ্টটি কলকাতা বইমেলাতেও দেখেছে অতসী। বছর কয়েক আগে বাংলাদেশ ছিল ওদের থিম কান্ট্রি। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এখনও এরকম কিছু চালু হয়েছে বলে মনে পড়ে না ওর। অবশ্য অতসীর ওর ধারণা এটা এমন কিছু নয়, একটি দেশকে সম্মান জানানো ছাড়া। বলা হয়, থিম কান্ট্রি করার মধ্য দিয়ে দেশটির কৃষ্টি-কালচার তুলে ধরা হয়। তা সংশ্লিষ্ট দেশের তেমন উল্লেখযোগ্য কৃষ্টি কালচার চোখে পড়েনি অতসীর। কলকাতা বইমেলাতে না, এখানেও না। ওর মনে হয় এটা দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক চাঙ্গা রাখার একটি সাংস্কৃতিক প্রকরণ। আগামী বছর দক্ষিণ কোরিয়া এবং সুইডেন যৌথভাবে দুু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ষাট বছর উদ্যাপন করবে। সম্ভবত সে উপলক্ষেই এ বছর ওদেশকে থিম কান্ট্রি করা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, কোরিয়ান পাবলিশার্স এ্যাসোসিয়েশন এবং অনুবাদ সাহিত্য ইনস্টিটিউশন মেলার সহযোগী অংশগ্রহণকারী। থিম সেøাগানÑ ‘সাউথ কোরিয়া জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি এ্যান্ড মিডিয়া এ্যান্ড ইনফরমেশন লিটেরেসি।’
×