ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

শুধু উন্নয়নে কাজ হবে না শান্তিও দরকার

প্রকাশিত: ১১:২২, ৮ অক্টোবর ২০১৯

 শুধু উন্নয়নে কাজ হবে না  শান্তিও দরকার

শেখ হাসিনা এখন শক্ত হয়ে গেছেন। পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন কাদের তিনি আত্মীয় মনে করেন। অভিযান, ক্যাসিনো সব মিলিয়ে জমজমাট কাহিনী। ঘরের শত্রু বিভীষণ বলে একটা কথা আছে। সে সব দুশমন জামায়াত-বিএনপি মিলিয়ে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যা সিনেমাকেও হার মানায়। শেখ হাসিনা দমন করতে জানেন। তিনি সফল না হলে এ দেশ এগোবে না। তাই তাঁকে সমর্থন করার পাশাপাশি কিছু কথা বলা দরকার। বাংলাদেশের উন্নয়ন বা অগ্রগতি এখন আর বলে বোঝানোর বিষয় নয়। আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি সেটা টের পাই সবার আগে। এককালে হাড় জিরজিরে মানুষের চেহারা, পোশাক এমনকি তাদের জীবনেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের হাওয়ায় বাংলাদেশের মানুষের জীবনে যোগ হয়েছে সামাজিক মিডিয়া। যে যাই বলুক এর গুণ ও প্রসার প্রমাণ করে আমরা নিজেদের প্রকাশ করতে চাই। এককালে বা কিছুদিন আগেও আপনার আমার সবার বলার মতো কোন জায়গা ছিল না। কেউ লিখত, কেউ বলত আর বাকিরা শুনতো বা দেখত। এখন সবাই বলতে পারেন, লিখতে পারেন। এটা ভাল না মন্দ সে বিচারে যাবার আগে বলি, সব বিষয়ে প্রস্তুতি বলে একটা বিষয় থাকে। আমাদের সামাজিক মিডিয়া হঠাৎ খুলে যাওয়ার কারণে সে বিচার বা প্রস্তুতি দানা বাঁধতে পারেনি। যে কারণে সবচেয়ে বিভ্রান্তি আর ঝামেলায় আছে তারুণ্য। তাদের কাছে অতীত যেমন ধোঁয়াশা, তেমনি তারা বর্তমান নিয়েও দোলাচলে আর ভবিষ্যত নিঃসন্দেহে কুয়াশায় মোড়ানো। এখন এমন এক সময় মানুষ যখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার দায় আমাদের নিতেই হবে। যন্ত্র যখন থেকে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছে, তখন থেকে তার আবেগ ইমোশনও বন্দী হয়েছে সময়ের হাতে। ছুটে চলার এই গতিময় জীবনকালে মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই একেকটি সত্তা। তাদের কারও সময় নেই অন্যের জন্য দিনরাত ব্যয় করে। চাকরিজীবী বাবা-মা দুজন যখন সংসারের জন্য খাটেন, তখন তাদের কি সময় থাকে সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি সময় দেয়ার? এর মধ্যে জুটেছে ফেসবুক-টুইটার এসব। আমার এক সহকর্মী একবার গল্প করছিল, তার তিন-চার বছরের মেয়েটি নাকি ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে জানিয়েছে, সে আগামী জীবনে মোবাইল হতে চায়। শুনে তো মায়ের আক্কেলগুড়ুম। এ কেমন কথা? পরে খবর নিয়ে জানল, মেয়ের এই শখের কারণ মা-বাবার দিনরাত মোবাইলে মুখ গুঁজে থাকা। সে চায় মনোযোগ। তার ধারণা সে যদি মোবাইল হতো তবে মা-বাবার কোলে কোলে, হাতে হাতে ঘুরে বেড়াত। সাংঘাতিক এই ঘটনা। সমাজবিজ্ঞানীরা এর কি ব্যাখ্যা দেবেন জানি না, তবে এটা বুঝি এভাবেই মনযোগ ও আকর্ষণের চেহারা পাল্টে গেছে। তারুণ্যের ব্যাপারে যেসব ভয় ও বিপদ ওৎঁ পেতে আছে, সেগুলো জানার পরও আমরা মনোযোগী না। এখনকার স্কুল-কলেজ সবজায়গায় হাতে হাতে মোবাইল। ক’জন অভিভাবক খবর রাখেন কি আছে এতে? কি তারা দেখে? কাদের সঙ্গে তাদের আলাপ হয়? কারা এদের আসল বন্ধু? জানি এ বিষয়গুলোর খবর রাখা অসম্ভব। সেটা বাস্তবে হয়ত পারাও যাবে না। কিন্তু না রাখলে আপনি কি করে জানবেন তার মনোজগতে কি হাওয়া বইছে? কোন স্বপ্ন, কোন আনন্দ-বেদনায় বিভোর তাদের আগামী? আমাদের রাজনীতি এগুলোর খবর রাখে না। খবর রাখে না আমাদের সমাজ। তারা যেসব বিদ্যালয়-কলেজ বা প্রতিষ্ঠানে যায় সেখানকার কারও কি সময় আছে তাদের নিয়ে ভাবার? আমি ব্যক্তিগতভাবে এই প্রজন্মকে বলি হেড ডাউন প্রজন্ম। কেন? রাস্তাঘাট-অফিস-আদালত-বাস-ট্রেন সব জায়গায় দেখবেন মানুষের বিশেষত তরুণ-তরুণীদের মাথা নিচু। তারা ঘাড় নামিয়ে হাতের মোবাইলে বা অন্য কোন ডিভাইসের বাটন চাপিয়ে কিসব দেখছে। চিরুউন্নত মম শিরের কবি এসব দেখলে আপনা থেকেই স্তব্ধ হয়ে যেতেন। আমি যন্ত্রকৌশল বা আধুনিকতার বিরুদ্ধে না। কিন্তু প্রশ্ন এই, এরা যদি এভাবেই বড় হয়ে উঠে দেশের হাল ধরবে কারা? কাদের হাতে নিরাপদ থাকবে আমাদের আগামী? আপনি একজন ভাল তরুণ বা তরুণী পাবেন না, যারা আগামী দিনে রাজনীতিতে আসতে চায়। এতবড় একটা বিপদ দেখেও আমাদের সমাজ নিশ্চুপ। যারা এখন রাজনীতিতে আসে বা করে তাদের কথা না বলাই ভাল। এরা সেই সব যুবক যারা খবরের কাগজ জুড়ে আতঙ্ক। যারা কুপিয়ে বিশ্বজিতের মতো সামান্য দর্জির জীবন নিতে জানে। যাদের ভয়ে মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য বাদ দিয়ে ঘরে বসে থাকে। যাদের মস্তানী আর সন্ত্রাসী ছাড়া কাজ করা যায় না। এই তারুণ্যে তারা নেই, যারা এদেশকে মুক্ত করেছিল। তারা নেই যাদের হাতে সমাজ পথ খুঁজে পেয়েছিল। তারাও নেই যারা নানাভাবে জীবনকে আকর্ষণীয় ও মধুর করে তুলত। চ্যালেঞ্জ নিতে না জানা এই প্রজন্মকে রাজনীতি বানিয়েছে মস্তান। অথবা নিস্পৃহ। এর থেকে মুক্ত হতে না পারলে আগামী দশকে বাংলাদেশ প্রবেশ করবে প্রায় নেতৃত্বহীনতার এক চরম দুর্দশাময় বাস্তবতায়। আজকের এই স্বার্থপর সমাজে তারুণ্য জেনে গেছে রাজনীতিতে তাদের আরোহণ নেই। আছে নিম্নগামিতা। যে কোন দলে আপনি রক্তের উত্তরাধিকারে ভেসে যাবেন। মেধা সেখানে নগণ্য। তাই আমাদের দেশের তারুণ্য লড়াই করতে চায় না। অথচ ভারতের বিরুদ্ধে বলা মানুষেরা একবারও ভাবেন না রাহুল গান্ধী পথে পথে ঘুরছে ঠাঁই করে নেয়ার জন্য। এর নাম সংগ্রাম। দেশে যত সমস্যা যত ধরনের বিবাদ আর বিরাগ সব চলছে মধ্যবয়য়সীদের কেন্দ্র করে। বয়স্কজনেরা যেমন নেই, তারুণ্যও নেই। তাই শঙ্কা জাগে। কবে আমরা আবার একটা বিনির্মাণমুখী সমাজে ফিরতে পারব। মিডিয়া থেকে জীবন সর্বত্র এদের উদ্বোধন চাই। কথায় না কাজে। বাঙালীর জীবনে এখন আনন্দ-বেদনা সব প্রায় সংঘাতময়। দেশের এত উন্নয়ন, এত অগ্রগতি, এত সম্ভাবনার পরও এই একঘেয়ে রাজনীতিনির্ভর জীবন থেকে মুক্ত হতে হলে নতুন কিছু করা প্রয়োজন। সেই দরকার মেটাতে যে শক্তি, যে মেধা, যে চিন্তা তা আছে তারুণ্যে। বয়সী মানুষেরা অভিজ্ঞতা দিয়ে সহায়তা করবেন । তাদের এটাও জানতে হবে কখন সরে যেতে হয়। কখন জায়গা করে দিতে হয় নতুনদের। নতুন প্রাণের সংযোগ আর নতুন রক্তের ঢেউ ছাড়া বাংলাদেশ কখনও তার গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে না। একাত্তরে বা এর পরের সব ঘটনাতেই তার প্রমাণ আছে। তাই নব আনন্দে জাগতেই হবে এদেশকে। [email protected]
×