ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুর্গতিনাশিনী দুর্গাতত্ত্ব

প্রকাশিত: ১১:২০, ৮ অক্টোবর ২০১৯

 দুর্গতিনাশিনী দুর্গাতত্ত্ব

সৃষ্টির আদি মহাশক্তি দুর্গা দেহদুর্গেরও মূলশক্তি। মানুষের দেহও একটি দুর্গ বিশেষ। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম- এই পঞ্চভূতে দেহ নির্মিত। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য- এই ষড়রিপু আক্রমণ করে দেহের মূলশক্তি- প্রাণশক্তিকে। জীবের প্রাণ ব্রহ্ম সনাতন। এই প্রাণ নিজের স্বরূপে বিকশিত হয় নিজের সাধনায়। প্রাণশক্তির উদ্বোধনে, উপলব্ধিতে সাধক হন মহাশক্তিধর। তাই সাধক যখন শক্তির সাধনা করে প্রাণশক্তিকে বিকশিত করতে চায়, তখন দেহস্থ ষড়রিপু বাধা দেয়ার জন্য প্রবলভাবে ছুটে আসে। রিপু-অসুরেরা চায় দেবশক্তির স্বর্গরাজ্য অধিকার করতে। যদি সাধকের সাধনা দুর্বল হয়, তবে সাধক সাধনায় ভ্রষ্ট হন রিপুর তাড়নায়। তখন অসুরেরা অধিকার করে স্বর্গরাজ্য। স্বর্গরাজ্য ফিরে পেতে আবার শুরু হয় দেবাসুর সংগ্রাম। সাধক যখনই রিপুর দ্বারা পথভ্রষ্ট হন তখনই দৈবীশক্তি তাঁকে রক্ষা করেন। তাই সাধকের কাছে দেবী দুর্গা নিজের এবং বিশ্বের মূলশক্তির আধার। দেবী দুর্গার অপর নাম দশভুজা। সাধকের সাধনায় যেন কোন বিঘ্ন না ঘটে, তাই জগৎমাতা দশ হাত দিয়ে দশদিক থেকে তাঁকে রক্ষা করেন। দশভুজা দশ প্রহরণ বা অস্ত্র দিয়ে সাধকের শত্রুকে দমন করেন। সাধক সাধনায় সফল হলে এমনিভাবে দশ অস্ত্র দিয়ে নিজের ষড়রিপুকে দমন করতে পারবে। দেবী ত্রিভঙ্গি ত্রিগুণময়ী ও ত্রিগুণাত্মিকার প্রতীক হয়ে সর্বদা প্রসন্নবদনে সাধকের সাধনায় স্বর্গীয় প্রশান্তি দান করেন। ত্রিনয়নী মহাদেবী ত্রিকালের প্রতীক বা সর্বকাল বিস্তারী। সর্বদ্রষ্টী দেবীর এক নয়ন চন্দ্রালোকের মতো রাত্রিকে দেখে, আরেক নয়ন সূর্যালোকের মতো দিনকে দেখেঅ তৃতীয় নয়ন দিবারাত্রির সন্ধিস্থল সন্ধ্যায় ও ঊষায় দেখে। অতসী ফুলের মতো দেবীর অঙ্গকান্তি সাধক সাধনার বলে নিজনেত্রে প্রত্যক্ষ করতে পারে। মহাদেবী সর্বদা নবযৌবনা সম্পন্না ও মহাজ্যোতির্ময়ী। দেবীর জটা বৈরাগ্যের প্রতীক। তাঁর কপালে অবস্থিত অর্ধচন্দ্র স্বর্গীয় অধ্যাত্ম শান্তি প্রাপ্তির প্রতীক। মহামায়ার অঙ্গেশোভিত নানা অলঙ্কার দেবীর শক্তির বিভূতির প্রতীক। মহাদেবী সিংহবাহনা। তামসিক পশুশক্তির অধিপতি সিংহ। সাধক সাধনাবলে নিজের দেহের তামসিক শক্তিকে সাধনশক্তিকে রূপান্তর করে থাকেন। এ কারণেই সিংহ দেবীর পক্ষে মহিষাসুরকে আক্রমণ করে। মহিষাসুর দেহস্থ প্রবল রিপুর প্রতীক। সাধনকালে দেহে দেবীশক্তি জাগ্রত হলেই ইন্দ্রিয়জাত রিপু তাকে গ্রাস করতে চায়। তখনই শুরু হয় সংগ্রাম। সাধক সাধনশক্তিতে রিপুজাত অসুরকে সংগ্রামে পরাজিত করে জয়ী হন। মহিষাসুর রজোগুণের প্রতীক এবং তা ক্ষণে ক্ষণে নিজের রূপ বদলায় বলে দেবী নিজের বাম পা মহিষাসুরের বুকে স্থাপন করেছেন। দেবীর ডান পা তমোগুণের প্রতীক সিংহের ওপরে। শিব মঙ্গল ও স্থিরত্বের প্রতীক। শিব ক্রিয়াতীত, গুণাতীত, শুভ্র, নিত্য ও নিরঞ্জন। শিব সত্য ও সুন্দর। শিবের শিরে কু-লিনীর প্রতীক সাপ। সাধক কুন্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করে উর্ধে শিরে সহস্রেরে উত্থিত করেন। শিব বৃষবাহন। বৃষ ক্রোধের প্রতীক। ক্রোধ অবদমিত এবং বীর্যে রূপান্তরিত হয়ে সাধন সহায়ক হয়। শরৎজননীর দুই ছেলে গণেশ ও কার্তিক। গণেশ স্থির সাধক ও সিদ্ধিদাতা। গণেশের লম্বোদর-সাধনা কর্মের প্রতীক। গণেশের বাহন মুষিক। মুষিক অবিরাম অবিশ্রান্ত কাটতে পারে। মুষিককে কিছুতেই কোথাও বন্দী করে রাখা যায় না। সে বন্ধন ছেদ করে মুক্ত হয়ে যায় বলে মুষিক বন্ধন মুক্তির প্রতীক। দেব সেনাপতি কার্তিক দেবশক্তির পরিচালক। সাধক গণেশের মাধ্যমে অর্জিত শক্তিকে কার্তিকের মাধ্যমে জাগ্রত করে তাকে সাধনামুখী করে। কার্তিকের অস্ত্র ধনু। প্রনব (ওঁ) ধনু, শর হচ্ছে আত্মা আর শরের লক্ষ্য ব্রহ্ম। কার্তিকের বাহন ময়ূর। কামভাব ময়ূরের কম থাকে। সাধক যখন কার্তিক অবস্থা প্রাপ্ত হন তখন তারও কামভাব কমে যায়। সরস্বতী বিমল বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রতীক। তাঁর শুভ্রবসন জ্ঞানের নির্মল শুভ্রতার নির্দেশক। দেবীর বীণা সাধকের মেরুদ-। মেরুমধ্যস্থ সুষু¤œা মার্গে সাধক ক্রিয়াবান থাকলে বিশুদ্ধাখ্যা চক্রে উত্থিত হয়ে শুভ্রজ্যোতি দর্শন করেন। তখন সাধক সর্বজ্ঞানের অধিকারী হন। সরস্বতীর বীণা অনাহত ধ্বনির প্রতীকও বটে। পুস্তক জ্ঞানচর্চার প্রতীক। সরস্বতী হংসবাহনা। হংস হচ্ছে প্রাণ। হংস জীবাত্মা। জীবাত্মা যখন সাধনার ফলে পরমাত্মায় লয় প্রাপ্ত হয় তখন হয় পরমহংস অবস্থা। হংস সার গ্রহণ করে, অসার ত্যাগ করে। লক্ষ্মী ঔশ্বর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এই ঐশ্বর্য আধ্যাত্মিক যোগকর্মলব্ধ ঐশ্বর্য-বিভূতি। সরস্বতী স্তর অতিক্রম করলে সাধক পূর্ণ অধ্যাত্ম ঐশ্বর্য লাভ করেন। পেঁচক লক্ষ্মীর বাহন। যখন কেউ দেখে না তখন পেঁচক সেই অন্ধকারের মধ্যেও জ্যোতিরেখা দেখতে পায়। সাধক লক্ষ্মী অবস্থা প্রাপ্ত হলে ঘন ঘোর তমসায়ও জ্যোতি দেখতে পারেন। মহালয়া থেকে দেবী পক্ষ শুরু। মহালয়া মানে মহাকূটস্থ দর্শন ক্ষেত্র। মহালয়ায় মহাকূটস্থ দর্শন করে সাধক ক্রমান্বয়ে প্রথমা থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত তিথিতে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম- এই পঞ্চভূতকে শোধন করেন। ষষ্ঠী তিথিতে তখন তাঁর হয় আত্মবোধন। সপ্তমীতে বুদ্ধি জয়, অষ্টমীতে অহঙ্কার জয়, অষ্টম অবস্থার পরে আরও উত্তরণ। অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিলগ্নে সন্ধিপূজা। নবমীতে নবম অবস্থাÑ অহংবোধ বিনাশের পরবর্তী স্তর। দশমীতে দশম অবস্থার পূর্ণ বিজয়। বিজয়াতে জয় সকল বাসনা। তখন দেবী শক্তির নিরঞ্জন। দেবী শিবের সঙ্গে মিশে নিরঞ্জন হয়ে যান। একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী ও চতুর্দশী অবস্থা শুধু সাধনগম্য, অনির্বচনীয়। পঞ্চদশীতে পূর্ণিমা-মহাজ্যোতির উদ্ভাস। এ পূর্ণিমা লক্ষ্মী পূর্ণিমা। সাধক তখন সর্বঐশ্বর্য লাভ করে সিদ্ধ অবস্থায় উত্তীর্ণ হন। এই পূর্ণিমাকে বলা হয় কোজাগরী পূর্ণিমা। কঃ জাগর? কে জাগ্রত? প্রাণই জাগ্রত দেহমধ্যে। এই প্রাণের উপলব্ধি সাধকের তখন পূর্ণভাবে ঘটে। প্রাণন ক্রিয়ার তথা আত্মক্রিয়ার তথা যোগক্রিয়ার একটি পূর্ণ অধ্যায় মহালয়া থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত প্রকাশিত। দুর্গাপূজা করা হয় দুর্গতি নাশ করার জন্য। দুর্গতি দুঃখময় গতি। প্রাণ অবলম্বন করে সাধনা না করলেই দুঃখ। প্রাণভিত্তিক যোগক্রিয়া মহাসুখময় গতি দান করে। তাই প্রত্যেক প্রতিমা পূজার প্রথমেই করতে হয় প্রতিমার প্রাণ প্রতিষ্ঠা। মহাশক্তি দুর্গা পূজা করে আমরা আত্মবলে বলীয়ান হব, মহাশক্তির অধিকারী হব, হব মহাসত্যের অধিকারী। সনাতন ধর্মের সকল পূজাকর্মে ও দেবদেবীর প্রতিমা রূপায়ণে আত্মোপলব্ধি তথা ব্রাহ্মোপলব্ধির ইঙ্গিত করা হয়েছে। দুর্গাপূজাও সেই সাধন শক্তি অর্জনের নির্দেশ। এখানেই দুর্গাপূজার তাত্ত্বিক রহস্য। জয় শারদ জননী। লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ
×