ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অনেকে ভাবতেই পারেননি তিনি বাংলাদেশের মানুষ

প্রকাশিত: ১১:২২, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

অনেকে ভাবতেই পারেননি তিনি বাংলাদেশের মানুষ

মোরসালিন মিজান ॥ জাতিসংঘের অধিবেশন চলছে। বাংলাদেশের হয়ে অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমেরিকা থেকে এ সংক্রান্ত নানা খবর আসছে প্রতিদিন। তার আগেও অনেক নেতা জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ভবিষ্যতেও করবেন। তবে জাতিসংঘে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতি যে আলো ছড়িয়েছিল তা আজও ইতিহাস হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু সেদিন বাঙালিত্বের গৌরব আর শৌর্য বীর্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। লম্বা চওড়া স্মার্ট সুদর্শন নেতাকে মঞ্চে দেখে অনেকে ভাবতেই পারেননি, তিনি বাংলাদেশের মানুষ! অধিবেশনে উপস্থিত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এমন তথ্য। তারা বলছেন, বাঙালীর সংগ্রাম আত্মত্যাগ এবং ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দিতেই জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। শুধু বাংলায় ভাষণ দেয়া নয়, সেই ভাষণে বিশ্বরাজনীতির বিশ্লেষণ এবং বাংলাদেশের ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। উপস্থিত দেশগুলোর নেতারা অভিভূত হয়ে শুনেছিলেন শেখ মুজিবের বক্তৃতা। করতালিতে ফেটে পড়েছিল অধিবেশন কক্ষ। ১৯৭৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত অনুমোদনক্রমে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ। এর কয়েক দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুই প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বপ্ন এবং এই অঞ্চলের জনগণের আকাক্সক্ষার কথা দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরেন। বাংলাদেশ কেন সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিল, কোন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের, সে ইতিহাস চমৎকারভাবে উঠে আসে বক্তৃতায়। নিউইয়র্ক সময় বিকেল ৪টায় শেখ মুজিবুর রহমানকে বক্তৃতার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এ সময় সাধারণ সভার সভাপতি আলজিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল আজিজ ব্যুতফলিকা নিজ আসন থেকে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে নেন। বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়ান গলাবন্ধ কোট, কালো ফ্রেমের খুব মানানসই চশমা, আর ব্যাকব্রাশ করা চুলের বঙ্গবন্ধু। দীর্ঘদেহী স্মার্ট সুদর্শন শেখ মুজিবকে দেখে অভিভূত হয়েছিলেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। নাতিদীর্ঘ ভাষণের সূচনায় বঙ্গবন্ধু বলেন ‘আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগিদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালী জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বাঙালীর দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনভাবে বাঁচিবার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচিবার জন্য বাঙালী জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহারা বিশ্বের সব জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাক্সিক্ষত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লাখ লাখ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন।’ ভাষণে তিনি স্বাধীন বাংলার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশের সংগ্রামে সমর্থনকারী সব দেশ ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম সার্বিক অর্থে শান্তি এবং ন্যায়ের সংগ্রাম ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আর সে জন্যই জন্মলগ্ন হইতেই বাংলাদেশ বিশ্বের নিপীড়িত জনতার পাশে দাঁড়াইয়া আসিতেছে।’ সেই সময়ের বিশ্ব রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ পাওয়া যায় তাঁর ভাষণে। বাঙালীর মহান নেতা বলেন ‘একদিকে অতীতের অন্যায় অবিচারের অবসান ঘটাইতে হইতেছে, অপরদিকে আমরা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হইতেছি। আজিকার দিনের বিশ্বের জাতিসমূহ কোন পথ বাছিয়া নিবে তাহা লইয়া সঙ্কটে পড়িয়াছে। এই পথ বাছিয়া নেয়ার বিবেচনার উপর নির্ভর করিবে আমরা সামগ্রিক ধ্বংসের ভীতি এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়া এবং ক্ষুধা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়াইয়া তুলিয়া আগাইয়া যাইব অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তোলার পথে আগাইয়া যাইব যে বিশ্ব মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করিয়া তুলিবে। এবং যে বিশ্ব কারিগরি বিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তোলার অবস্থা সৃষ্টি করিবে।’ এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রথম হইতেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এই নীতিমালার উপর ভিত্তি করিয়া জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করিয়াছে।’ কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশই কষ্টলব্ধ জাতীয় স্বাধীনতার ফল ভোগ করিতে সক্ষম করিয়া তুলিবে বলে মত দেন তিনি। প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশের অভ্যুদয় বস্তুতপক্ষে এই উপমহাদেশে শান্তির কাঠামো এবং স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অবদান সৃষ্টি করিবে। ইহা ছাড়া আমাদের জনগণের মঙ্গলের স্বার্থেই অতীতের সংঘর্ষ ও বিরোধিতার পরিবর্তে মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।’ বাঙালীর উদারতার বহির্প্রকাশ ঘটিয়ে বক্তৃতায় তিনি বলেন ‘আমরা আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও নেপালের সঙ্গে শুধুমাত্র প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কই প্রতিষ্ঠা করি নাই, অতীতের সমস্ত গ্লানি ভুলিয়া গিয়া পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক করিয়া নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করিয়াছি।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখ-তার প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী সব দেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখিবে। আমাদের অঞ্চলের এবং বিশ্বশান্তির অন্বেষায় সব উদ্যোগের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকিবে।’ বাঙালীর ক্ষমতা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানতেন বঙ্গবন্ধু। সে কথা বিশ্ববাসীকে আরও একবার জানিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘জনাব সভাপতি, মানুষের অজেয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখিয়া আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিতে চাই। আমাদের মতো যেসব দেশ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, এই বিশ্বাস তাহাদের দৃঢ়। আমরা দুঃখ ভোগ করিতে পারি। কিন্তু মরিব না। টিকিয়া থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করিতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি। আমাদের লক্ষ্য স্বনির্ভর। আমাদের পথ হইতেছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা।’ বক্তৃতার শেষ অংশে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের অবতারণা করে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজেদের শক্তির ওপর আমাদের বিশ্বাস রাখিতে হইবে। আর লক্ষ্য পূরণ এবং সুন্দর ভাবীকালের জন্য আমাদের নিজেদের গড়িয়া তুলিবার জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা আগাইয়া যাইব।’ জানা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শেষ হলে সাধারণ সভার সভাপতিসহ অন্যরা দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করেন। একই রকম প্রশংসা করা হয়েছিল জাতিসংঘের ডেলিগেট বুলেটিনে। এতে বঙ্গবন্ধুকে ‘কিংবদন্তির নায়ক মুজিব’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল। ভাষণ বিশ্লেষণ করে লেখা হয়েছিল ‘অতীতের অনগ্রসরতা, যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও প্রতিকূল বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভয়াবহ ফলশ্রুতি হিসেবে যে অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলা অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশের নেতা মুজিব তাঁর বক্তব্যে সেটি তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন।’ বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে এই অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সে সময়ের তরুণ নেতা তোফায়েল আহমেদ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, তখন জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা ছিল মাত্র ছয়টি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে তাই ইংরেজীতে বক্তৃতা করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য, বাংলাদেশের জন্য আজীবন সংগ্রাম করা বঙ্গবন্ধু নিজের মাতৃভাষাকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করতেই বাংলায় বক্তৃতা করেন। ভাষণ শেষে তাঁকে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বুকে জড়িয়ে ধরেন। আলিঙ্গন করেন। তাদের অনেকের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তখন তারা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শুধু তোমাদের নয়, সারাবিশ্বের নিপীড়িত মানুষের নেতা। তোফায়েল আহমেদ জানান, জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব এ ভাষণের প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় আমি আনন্দিত ও গর্বিত। তাঁর দেয়া ভাষণটি সহজ গঠনমূলক ও অর্থবহ।’ জাতিসংঘে বসে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছেন রাজনীতিবিদ আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও। অত্যন্ত তরুণ বয়সে এ ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছিলেন তিনি। সেই সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু আসলে বঙ্গবন্ধুই। তাঁর সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। দেশের মতো বিদেশের মাটিতেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। জাতিসংঘে কেবল একজন সরকার প্রধান হিসেবে যাননি তিনি। বরং ‘ক্রিয়েটর অব এ নিউ নেশন’ হওয়ায় পুরো হাউসের দৃষ্টি ছিল তাঁর দিকে। এদিন বিরল সম্মান দেখানো হয় তাঁকে। পরের কথাটি আরও চমকপ্রদ। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, লম্বা চওড়া অত্যন্ত সুদর্শন বঙ্গবন্ধুকে দেখে অনেকে ভাবতেই পারেননিÑ তিনি বাংলাদেশের মানুষ! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার সময়ও সবাই উপস্থিত থাকেন না। কিন্তু বাঙালীর নেতা বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার সময় পুরো হাউস ছিল কানায় কানায় পূর্ণ ছিল বলে জানান তিনি। দীর্ঘ সময় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে কাটানো ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামও অভিন্ন অনুভূতির কথা জানান। তিনি বলেন, জাতিসংঘে ভাষণ দেয়ার কয়েক দিন আগে নরওয়ে কনফারেন্সে বক্তৃতা করেন বঙ্গবন্ধু। সে ভাষণটিও ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এর পর পরই জাতিসংঘে বক্তৃতা করেন তিনি। অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা সচেতনভাবেই জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন। জাতির জনকের ওই ভাষণের আবেদন আজও ফুরোয়নি। বক্তৃতাটি থেকে আজকের নেতাদের অনেক কিছু শেখার আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
×