ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের কালো দিন!

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ইতিহাসের কালো দিন!

আজ ২৬ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাংলাদেশের ইতিহাসে বিচারহীনতার সংস্কৃতির এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর খুনীদের বাঁচাতে কলঙ্কিত এই অধ্যাদেশটি জারি করে খন্দকার মোশতাক। অধ্যাদেশটিতে উল্লেখ করা হয়, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটে থাকুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রীমকার্টসহ কোন আদালতে বা ট্রাইব্যুনালে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনী বৈধতা দেন জিয়াউর রহমান। সংশোধনীটি পাস হয় ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল ‘সংবিধান আইন ১৯৭৯’ (পঞ্চম সংশোধনী)। এর আগে খুনী চক্রকে বিশ্বের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেন মেজর জিয়া। পঞ্চম সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ ও অন্যান্য আইন এবং উক্ত মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোন ফরমান দ্বারা এই সংবিধানের যে সকল সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলোপসাধন করা হইয়াছে তাহা এবং ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে গিয়া কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত কোন আদেশ কিংবা প্রদত্ত কোন দণ্ডাদেশ কার্যকর বা পালন করিবার জন্য কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশ, কৃত কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ, অথবা প্রণীত, কৃত বা গৃহীত বলিয়া বিবেচিত আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং ঐ সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তৎসম্পর্কে কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোন কারণেই কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেয়ায় ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে যায়। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বৈধতা দেয়া না হলে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই ১৫ আগস্টের খুনীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া যেত। জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি সাত্তার, এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পাওয়া খুনীরা প্রকাশ্যেই চলাফেরা করত। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। ওই বছর ২৩ জুন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এরপরই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া আইনী বাধা অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (রহিতকরণ) বিল, সপ্তম সংসদে উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ নবেম্বর আইনটি সংসদে পাস হয়। ১৪ নবেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়। ফলে মোশতাকের জারি করা এবং জিয়ার সময় বৈধতা পাওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বিলুপ্ত বলে গণ্য হয়। মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী এই অধ্যাদেশ বাতিলের মাধ্যমে ঘোচানো হয় ২১ বছরের কলঙ্ক। খুলে যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ। আইনী প্রক্রিয়া শুরু হয়। সর্বশেষ ২০০৯ সালে লিভ-টু-আপীল-এর মাধ্যমে এর বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আপীল শেষে বারো জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন মহামান্য আদালত। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি খুনী পাঁচজনের ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বাকি ছয়জন এখনও পলাতক। বাংলাদেশের বয়স আজ ৪৮ বছর। এই ৪৮ বছরের ৩৫ বছরই আমাদের লেগেছে ইনডেমনিটির কলঙ্কিত অধ্যায়ের সমাপ্তি টানতে। তাই ২৬ সেপ্টেম্বর বাঙালীর মনে এক দাগ কাটা অধ্যায়। দিনটি সে কারণে স্মৃতিময় এবং কালোদিন। ইতিহাসের এই কলঙ্কিত অধ্যায়ের অবসান হয়েছে সত্যি, কিন্তু ঘুরেফিরে বাঙালীর জাতীয় জীবনে এই কালো দিন আজও অমোচনীয়।
×