ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা জেএসএস ও ইউপিডিএফ

প্রকাশিত: ১০:২৭, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা জেএসএস ও ইউপিডিএফ

মোয়াজ্জেমুল হক/জীতেন বড়ুয়া ॥ পাহাড়ে আঞ্চলিক দুই রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট) দুই গ্রুপ করে চার গ্রুপ হয়ে এদের ক্যাডারদের হাতে এখন অত্যাধুনিক ভারি অস্ত্রের ছড়াছড়ি। ফলে পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরছে। এতে করে সাধারণ পাহাড়ী বাঙালীদের মাঝে ভর করেছে ভয়ানক আতঙ্ক। মূলত সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি নিয়ে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে লিপ্ত রয়েছে এ দুটি সংগঠনের প্রতিটি উপগ্রুপ। এসব সন্ত্রাসীদের হাতে সাধারণ মানুষ ছাড়াও এমনকি পুলিশ ও সেনা সদস্যরাও টার্গেট হচ্ছেন। এদের প্রাণহরণের সংখ্যাও বাড়ছে। সেনা চৌকি যেখানেই হ্রাস করা হয়েছে সেখানেই পাহাড়ী দুর্বৃত্তদের অপকর্মের ডালপালা বিস্তৃতি লাভ করেছে। শান্তির জন্য সাধারণ মানুষদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরই আস্থা যেখানে ক্রমশ বাড়ছে, সেখানে সেনা তৎপরতাও টহল সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। শান্তি চুক্তি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হবে যখন পাহাড়ে ভূমি কমিশনের কার্যকারিতা পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে। অথচ বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, পাহাড়ী আঞ্চলিক দল ও তাদের সঙ্গে থাকা স্বার্থান্বেষীরা চায় না ভূমি কমিশন সেখানে কার্যকর হোক। পাহাড়ে শান্তি চুক্তির পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৮ সালে চুক্তিবিরোধী যে সংগঠনটি জন্ম নেয় সেটি হচ্ছে ইউপিডিএফ। গত প্রায় দু’যুগেরও বেশি সময়ে চুক্তিবিরোধী সশস্ত্র এ সংগঠনটি অর্থাৎ ইউপিডিএফের হাতে ৮৫ জেএসএস কর্মীসহ শতাধিক সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অপহৃত হয়েছে আরও শতাধিক। বর্তমান সময়ে এদের সঙ্গে যোগ হয়েছে সংস্কারপন্থী জেএসএস এবং গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ। এসব বিভক্ত সংগঠনের অস্ত্রধারীদের নিজ নিজ আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলছে অহর্নিশ। এ দুই সংগঠনের বিভক্তি চার গ্রুপের সদস্যদের হাতে প্রাণহাণির তালিকা দীর্ঘ। তিন পার্বত্য জেলায় সামাজিক অপরাধের বাইরে খুনের সংখ্যা ২ হাজার ২৫০ জনেরও বেশি। আর অপহৃত হয়েছে ২ হাজার ৪০২ জন। নিহতদের অধিকাংশই বাঙালী। বাঙালীরা খুন হয়েছেন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও চাঁদাবাজির ঘটনার শিকার হয়েছে। অন্যদিকে পাহাড়ীদের অধিকাংশই নিহত হয়েছেন দলীয় কোন্দলের কারণে। সাম্প্রতিক সময়ে গত এক বছরে কয়েকটি সশস্ত্র হামলায় নিহতদের অধিকাংশই আঞ্চলিক রাজনৈতিক স্বার্থের বলি। সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, পাহাড়ে পুলিশের সংখ্যা কম থাকায় চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য সমতলের চেয়ে বহুগুণে বেশি। চাঁদাবাজদের শাস্তির তেমন রেকর্ড পাহাড়ে নেই। ফলে চাঁদাবাজরা বেপরোয়া। চাঁদাবাজির কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ আদায়ে এদের হাতে রয়েছে ভারি অস্ত্রশস্ত্র। অভিযোগ রয়েছে প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে চোরাপথে এসব ভারি অস্ত্র আনছে জেএসএস ও ইউপিডিএফের ক্যাডাররা। চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যের ফলে পাহাড়ের বিভিন্ন স্থান থেকে পাহাড়ী বাঙালীদের কেউ কেউ এলাকা ছেড়েছে। প্রাণঘাতী বিরোধ বিশেষ করে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, নাড়াইছড়ি, পানছড়ি, রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই, রাজস্থলী, লংগদু, বাঘাইছড়ি ও নানিয়াচর উপজেলায় নিজেদের অন্তদ্বন্দ্ব চরম রূপ নিয়েছে। ফলে অস্ত্রধারী ক্যাডাররা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন স্থানে প্রায়শ বন্দুকযুদ্ধ, গোলাগুলি, হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজির ঘটনায় সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। একের পর এক হত্যাকা-ের ঘটনা সংঘটিত হলেও হত্যাকা-ের মূল হোতাদের অধিকাংশ ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরা বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমএম মঞ্জুরকে সরাসরি হত্যার হুমকি দিয়েছে। সন্ত্রাসীদের গুলিতে এক সেনা সদস্যের প্রাণহানির অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে। সূত্র জানিয়েছে, শান্তি চুক্তির দীর্ঘ ২২ বছর পর সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে শান্তিশৃঙ্খলা নিয়োজিত সেনা সদস্যদের টার্গেট করেছে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। ইতোমধ্যে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে পর পর তিনটি ঘটনায় উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। এ তিন ঘটনায় উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে অত্যাধুনিক ভারি অস্ত্রশস্ত্র। আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে এ ধরনের ভারি অস্ত্র কিভাবে এবং কোনপথে আসছে তা নিয়েও উৎকণ্ঠার শেষ নেই। গত ২৬ আগস্ট খাগড়াছড়ি দীঘিনালা এলাকার ধরাগম এলাকায় সশস্ত্র পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা সেনা টহল দলের উপর অতর্কিত গুলি চালায়। সেনাবাহিনীও আত্মরক্ষার্থে গুলিবর্ষণ করে। এতে তিন সন্ত্রাসী নিহত হয়। নিহত ৩ জনই ইউপিডিএফের সশস্ত্র শাখার সদস্য। এর আগে ২৩ আগস্ট রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে সেনাবাহিনীর ওপর সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ইউপিডিএফের শীর্ষ সন্ত্রাসী শান্তিময় চাকমা ওরফে সুমন চাকমা প্রাণ হারায়। এর আগে ১৮ আগস্ট রাঙ্গামাটির রাজস্থলীতে সন্ত্রাসীদের আকস্মিক হামলায় প্রাণ হারান এক সেনা সদস্য। সেনাবাহিনীর রাঙ্গামাটির রিজিওনের রাজস্থলী আর্মি ক্যাম্প থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দক্ষিণে পোয়াইতু মুখ নামক এলাকায় নিয়মিত সেনা টহল দলের ওপর হামলার এ ঘটনা ঘটে। এর আরও আগে ১৮ মার্চ ৫ম উপজেলা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন শেষে ফেরার পথে জেএসএসের অতর্কিত হামলায় পুলিশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তা মিলে প্রাণ হারায় ৮ জন। পাহাড় নিয়ে বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানিয়েছেন, শান্তি চুক্তির দুই দশক পেরিয়ে গেলেও সমৃদ্ধির জনপথ তিন পার্বত্য জেলায় অশান্তির আগুনের লেলিহান শিকার ছড়িয়ে দিচ্ছে আঞ্চলিক এই দুই দলের বিভক্ত চার গ্রুপের সশস্ত্র ক্যাডাররা। এই আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর পারস্পরিক বিরোধ, অব্যাহত সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও জাতিগত বিদ্বেষের কারণে পাহাড়ী জনপথে সাধারণ মানুষের জীবন অনেকাংশে বিপন্ন। শান্তি চুক্তির অধিকাংশ ধারা ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। শুধুমাত্র ভূমি জরিপসহ কয়েকটি ইস্যুতে সরকার ও জেএসএসের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। সূত্রমতে, শান্তি চুক্তির অধিকাংশ ধারা যেখানে বাস্তবায়ন ইতোমধ্যে সরকার করেছে সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেবলি অবনতি ঘটাচ্ছে পাহাড়ী দুর্বৃত্তরা। শান্তি চুক্তির আগে পাহাড়ে জেএসএসের কাছে অস্ত্রের সীমাবদ্ধতা ছিল। এখন সে অস্ত্র ছড়িয়ে গেছে ক্যাডার বাহিনীর হাতে। শুধু তাই নয়, সীমান্ত পথে প্রতিবেশী দুই দেশ থেকে চোরাই অস্ত্র এরা দেদারসে এনে সমতল ভূমির দুর্বৃত্তদের কাছে মোটা অংকের বিনিময়ে বিক্রি করছে।
×