ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ব্যাংকের উদ্বৃত্ত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের নির্দেশ

প্রকাশিত: ১০:২১, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

  ব্যাংকের উদ্বৃত্ত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের নির্দেশ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে নতুন করে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব পোর্টফোলিওতে সরাসরি বিনিয়োগ অথবা সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে এই বিনিয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশিত নয়টি শর্ত পরিপালন করে ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হবে। রবিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফ-সাইট সুপারভিশন থেকে এ বিষয়ে একটি সার্কুলার জারি করা হয়। সেখানে রেপোর মাধ্যমে অর্থ সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে মঙ্গলবার ব্যাংকগুলোর ঋণ ও আমানতের হার (এডিআর) রেসিও বাড়ানো হয়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক রকিবুর রহমান মনে করেন, শেয়ারবাজারে চলমান তারল্য সঙ্কট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যাংকের মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের তারল্য সঙ্কট কাটলে শেয়ারবাজার নতুন মাত্রা পাবে বলে তিনি জানিয়েছেন। জানা গেছে, গত তিন মাস ধরে শেয়ারবাজারে সূচকের ওঠানামা অব্যাহত রয়েছে। সূচক যা উঠেছে তার চেয়ে বেশি পতন হয়েছে। খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়ও বাজারের এই আচরণ নিয়ে চিন্তিত। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১৬ অক্টোবর বাজার সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দেন। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের মধ্যে পুঁজিবাজারকে নীতিগত সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংকের অগ্রিম ও আমানতের অনুপাত নির্ধারিত মাত্রা অপেক্ষা কম এবং এসএলআর (নগদ জমার হার) সংরক্ষণের পর অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। এসব ব্যাংকের জন্য আইনী সীমার মধ্যে থেকে পুঁজিবাজারে মৌলভিত্তিক ইন্সট্রুমেন্টে বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ব্যাংকসমূহের এরূপ বিনিয়োগে অংশগ্রহণ (নিজস্ব পোর্টফোলিওতে সরাসরি বিনিয়োগ অথবা সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে ঋণ প্রদান করত উক্ত কোম্পানির নিজস্ব পোর্টফোলিওর আকার বৃদ্ধির মাধ্যমে পরোক্ষ বিনিয়োগ) পুঁজিবাজারে তারল্য সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি একটি গতিশীল পুঁজিবাজার নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব পোর্টফোলিওতে সরাসরি বিনিয়োগ অথবা সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তারল্য বৃদ্ধির উদ্দেশে নিম্নক্ত শর্তাধীনে সাময়িক তারল্য সুবিধা প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শর্তগুলো হচ্ছে, তারল্য সুবিধা গ্রহণেচ্ছু ব্যাংকের সলো আই কনসোলিডেটেড উভয়ভিত্তিতে পুঁজিবাজার বিনিয়োগ ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০১৮ পর্যন্ত সংশোধিত) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত সার্কুলারে বর্ণিত সর্বোচ্চসীমার (ভিত্তিতে বিবেচ্য মূলধন উপাদানের ২৫% এবং কনসোলিডেটেড ভিত্তিতে বিবেচ্য মূলধন উপাদানের ৫০%) কম হতে হবে। তারল্য সুবিধা গ্রহণের পরও বর্ণিত বিনিয়োগ সীমা পরিপালন করতে হবে। একইসঙ্গে এই সুবিধার অধীনে প্রাপ্ত তারল্য শুধুমাত্র ব্যাংকের নিজস্ব পোর্টফোলিওতে সরাসরি বিনিয়োগ অথবা সাবসিডিয়ারি কোম্পানির নিজস্ব পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগের উদ্দেশে সংশ্লিষ্ট সাবসিডিয়ারি কোম্পানিকে ঋণ হিসেবে প্রদান করা যাবে। এই সুবিধা নিয়ে প্রাপ্ত তারল্য ব্যাংকের নিজস্ব পোর্টফোলিওতে বা সাবসিডিয়ারি কোম্পানির নিজস্ব পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগের জন্য নতুনভাবে পৃথক বিও একাউন্ট খুলতে হবে। এছাড়া ব্যাংকসমূহের অতিরিক্ত তারল্য হতে ট্রেজারি বন্ড বা বিল রেপোর মাধ্যমে এই তারল্য সুবিধা গ্রহণ করতে হবে। ট্রেজারি বন্ড বা বিলের রেপো মূল্যের ৫% মার্জিন হিসেবে রেখে তারল্য সুবিধা প্রদেয় হবে। নগদে রেপোর অর্থ পরিশোধে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখে সংশ্লিষ্ট সিকিউরিটিজের বাজারমূল্য আদায়যোগ্য অর্থ অপেক্ষা কম হলে তা ইতোপূর্বে গৃহীত মার্জিন হতে সমন্বয় করা হবে এবং সমন্বয়ের জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হলে ব্যাংক তা প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। সার্কুলারে বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে রেপোর মেয়াদ ২৮ দিন হলেও তহবিল ব্যবহারের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে তা সর্বোচ্চ ০৬ (ছয়) মাস পর্যন্ত ঘূর্ণায়মান রাখা যাবে। এরূপ রেপোর জন্য কোন অকশনের প্রয়োজন হবে না এবং সুদের হার হবে ৬%। এছাড়া এরূপ তারল্য সুবিধা গ্রহণের জন্য যাচিত অর্থের পরিমাণ উল্লেখপূর্বক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন এবং এতদুদ্দেশ্যে সদ্য খোলা বিও হিসাবের প্রমাণপত্রসহ মহাব্যবস্থাপক, ডিপার্টমেন্ট অব অফ-সাইট সুপারভিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর আবেদন করতে হবে। প্রদানযোগ্য তারল্য সুবিধার পরিমাণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে এবং পুনর্বিবেচনার জন্য কোন আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না। মেয়াদোত্তীর্ণ রেপো নবায়নের প্রয়োজন হলে তহবিল ব্যবহারের প্রমাণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিও একাউন্টের হিসাবসহ মহাব্যবস্থাপক, ডিপার্টমেন্ট অব অফ-সাইট সুপারভিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ৫ (পাঁচ) কার্যদিবস পূর্বে আবেদন করতে হবে। সার্কুলার জারির ৩ (তিন) মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর আবেদন দাখিল করতে হবে। এই সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশে প্রচলিত সংশ্লিষ্ট আইন এবং সময়ে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জারিকৃত অন্যান্য নির্দেশনার পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। বাড়ানো হয়েছে এডিআর ॥ গত মঙ্গলবারে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর অগ্রিম আমানত হার বা এডিআর (এডি রেসিও) এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য বিনিয়োগ আমানত হার (আইডিআর) বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে এডিআর সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ এবং আইডিআর সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ নির্ধারণ করে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক সিরাজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করা হয়। ওই সার্কুলারে বলা হয়েছে, প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর দ্বি-সাপ্তাহিক গড়ভিত্তিতে রক্ষিতব্য সিআরআর ও দৈনিক ভিত্তিতে রক্ষিতব্য এসএলআর বাদে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল দাঁড়ায় ৮১.৫০ শতাংশ এবং ইসলামী শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক ও প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য তা দাঁড়ায় ৮৯ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতের মূলধন ভিত্তি, তারল্য পরিস্থিতি, আন্তঃব্যাংক নির্ভরশীলতা এবং সর্বোপরি ব্যাসেল-৩ অনুসারে এলসিআর (লিক্যুইড কাভারেজ রেসিও) এবং এনএসএফআরের (নেট স্ট্যাবল ফান্ডিং রেসিও) নির্ধারিত মাত্রা সংরক্ষণের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত চলিত ব্যাংকগুলোর অগ্রিম আমানত হার (এডিআর) সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ (৮১.৫০ শতাংশ + অতিরিক্ত ৩.৫০ শতাংশ) এবং ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ও প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ (৮৯ শতাংশ + অতিরিক্ত ১ শতাংশ) নির্ধারণ করা হয়েছে। সার্বিক আর্থিক সূচকসমূহ বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অতিরিক্ত এডি রেসিও বাড়ানো হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কিছুটা দেরিতে হলেও শেয়ারবাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগ ইতিবাচক সিদ্ধান্তের একটি। এই উদ্যোগের ফলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে। একইসঙ্গে যাদের শেয়ার বিক্রি করে টাকা সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে, তাদের আর এটির প্রয়োজন পড়বে না।
×